হিল ভয়েস, ১৬ জুলাই ২০২১, রাঙ্গামাটি: বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাধীন রাজস্থলী উপজেলার গাইন্দ্যা ইউনিয়ন এলাকায় এক বিধবা বৃদ্ধা জুম্ম নারী ও তার পরিবারকে ব্যাপক হয়রানি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সেনাবাহিনী প্রায়ই তার বাড়িতে গিয়ে ওই বৃদ্ধাকে খোঁজ করে, ক্যাম্পে গিয়ে দেখা করার নির্দেশ দিয়ে এবং বিভিন্ন অভিযোগ তুলে হুমকিও প্রদান করে হয়রানি ও মানসিকভাবে নিপীড়ন করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ওই বৃদ্ধা জুম্ম নারীর নাম মুরুঙ্গী তঞ্চঙ্গ্যা (৫৮), স্বামী-মৃত ভালাধন তঞ্চঙ্গ্যা, গ্রাম-ঘিলামুখ আমতলী পাড়া, গাইন্দ্যা ইউনিয়ন। বর্তমানে মুরুঙ্গী তঞ্চঙ্গ্যা তার বড় ছেলের বউ ও বউয়ের এক ছোট ভাই নিয়ে বাড়িতে থাকেন। তার তিন ছেলের মধ্যে দুই ছেলে মিথ্যা মামলায় রাঙ্গামাটি কারাগারে এবং অন্য ছেলেটিও ভয়ে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে বেড়াচ্ছে বলে জানা গেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গতকালও (১৫ জুলাই ২০২১) বিকাল ৪:৩০ টার দিকে রাজস্থলী সেনা ক্যাম্পের ১৬ জনের একদল সেনা সদস্য মুরুঙ্গী তঞ্চঙ্গ্যার বাড়িতে গিয়ে প্রথমে বাড়ি ঘেরাও করে, এরপর বাড়িতে ব্যাপক তল্লাশি চালায় এবং মুরুঙ্গী তঞ্চঙ্গ্যাকে খোঁজ করে। এসময় মুরুঙ্গী তঞ্চঙ্গ্যা বাড়িতে ছিলেন না এবং জুমের কাজে বাইরে ব্যস্ত ছিলেন। সেসময় তার বড় ছেলের বউ চম্পা চাকমা (৩২) ও বউয়ের এক ছোট ভাই বাড়িতে অবস্থান করছিল।
তল্লাশির সময় সেনা সদস্যরা বাড়ির লোকদের বের করে দেয় এবং উপস্থিত বাড়ির লোকজন ও বাড়ির বিভিন্ন জিনিসপত্রের ছবি তুলে নেয়।
এরপর সেনা সদস্যরা মুরুঙ্গী তঞ্চঙ্গ্যার ছেলের বউ চম্পা চাকমাকে বলে যে, বুড়ির (মুরুঙ্গী তঞ্চঙ্গ্যা) ছেলে শান্তিবাহিনীতে কাজ করে। আগামীকাল (১৬ জুলাই) যেন মুরুঙ্গী তঞ্চঙ্গ্যা ও গ্রামের কার্বারি রাজস্থলী সেনা ক্যাম্পে গিয়ে তাদের সাথে দেখা করে। যদি দেখা না করে তাহলে অনেক অসুবিধা হবে। প্রায় ঘন্টাখানেক সেখানে অবস্থান করার পর সেনাদলটি ক্যাম্পে ফিরে যায় বলে জানা গেছে।
এদিকে উক্ত ঘটনার পর বৃদ্ধা মুরুঙ্গী তঞ্চঙ্গ্যা ও তার পরিবারের মধ্যে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা গেছে। আজ (১৬ জুলাই) তার সেনা ক্যাম্পে গিয়ে দেখা করার নির্দেশ থাকলেও কয়েকজন মুরুব্বির পরামর্শে তিনি সেনা ক্যাম্পে যাননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন গ্রামবাসী বলেন, তাদের আশঙ্কা, ক্যাম্পে দেখা করতে গেলে সেনা সদস্যরা বৃদ্ধা মুরুঙ্গী তঞ্চঙ্গ্যাকে নির্যাতন করতে পারে। এই বয়সে মুরুঙ্গীর পক্ষে তা সহ্য করা সম্ভব হবে না।
উল্লেখ্য, এর আগেও সেনাবাহিনী একাধিকবার মুরুঙ্গী তঞ্চঙ্গ্যাকে নানা হুমকি দিয়ে ভীতি প্রদর্শন এবং খোঁজ করেছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, কয়েক বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ার পর বিধবা মুরুঙ্গী তঞ্চঙ্গ্যা তিন ছেলে নিয়ে নিজের ভূমিতে বাগান-বাগিচা এবং জমিতে-জুমে চাষাবাদ করে কোনোমতে জীবিকা নির্বাহ করছিলেন। ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রায় দুই মাস পূর্বে রাজস্থলী এলাকায় সেনামদদপুষ্ট এএলপি (আরাকান লিবারেশন পার্টি) বা এমএলপি (মগ লিবারেশন পার্টি) এবং সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ইত্যাদি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আবির্ভাব ও সশস্ত্র তৎপরতা শুরু হলে এলাকার পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে ধাবিত হয়। এক পর্যায়ে স্থানীয় জনসংহতি সমিতি ও পার্বত্য চুক্তির সমর্থক জনগণের উপর একদিকে সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন ও মিথ্যা মামলা এবং অপরদিকে এমএলপি, সংস্কারপন্থী ও গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ ইত্যাদি সন্ত্রাসী সংগঠনের চাঁদাবাজি, অপহরণ, মারধর ও হামলার ফলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠে।
এক পর্যায়ে ২০১৯ সালে সেনাবাহিনী মুরুঙ্গী তঞ্চঙ্গ্যার বড় ছেলে ইন্দ্রবান তঞ্চঙ্গ্যা (৩৫)-কে গ্রাম থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে মিথ্যা মামলায় জড়িত করে পুলিশের নিকট সোপর্দ করে। ২৫ মে ২০২১ জামিন নিয়ে ইন্দ্রবান তঞ্চঙ্গ্যা রাঙ্গামাটি জেল থেকে মুক্ত হলে, ঐদিনই সেনাবাহিনী তাকে আবার জেল গেইট থেকে ধরে নিয়ে যায় এবং বাঘাইছড়ির জনৈক বসু চাকমা হত্যা মামলায় জড়িত করে আবার ইন্দ্রবান তঞ্চঙ্গ্যাকে জেলে প্রেরণ করা হয়।
অপরদিকে ৮ মে ২০২১ তারিখে সেনাবাহিনী রাজস্থলী উপজেলার সীমান্তবর্তী কাপ্তাই উপজেলায় শশুর বাড়িতে বেড়াতে এসে ভালুক্যা এলাকা থেকে মুরুঙ্গী তঞ্চঙ্গ্যার ছোট ছেলে সোনারাম তঞ্চঙ্গ্যা (২৬)-কে ধরে নিয়ে যায় এবং মিথ্যা মামলায় জড়িত করে জেলে প্রেরণ করে।
জানা গেছে, ইন্দ্রবান তঞ্চঙ্গ্যা ও সোনারাম তঞ্চঙ্গ্যা অনেক আগে জনসংহতি সমিতির বিভিন্ন গণতান্ত্রিক কর্মসূচিতে সহযোগিতা করলেও দীর্ঘদিন ধরে তারা নিষ্ক্রিয় রয়েছে।
এদিকে মুরুঙ্গী তঞ্চঙ্গ্যার মেজো ছেলে ধনরাজ তঞ্চঙ্গ্যা (৩১), যিনি একসময় পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের রাজস্থলী থানা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কাজ করতেন, বর্তমানে তিনি সেনাবাহিনীর মিথ্যা মামলা ও গ্রেপ্তারের ভয়ে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে গেছেন বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন গ্রামবাসী সেনাবাহিনী কর্তৃক অসহায় বৃদ্ধা মুরুঙ্গী তঞ্চঙ্গ্যাকে উপর্যুপরি হয়রানি ও অমানবিক আচরণে গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।