হিল ভয়েস, ৩ জুন ২০২১, পটুয়াখালী: পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার মৌটুটিয়াখালীতে (ছ আনিপাড়া) পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ছয়টি রাখাইন পরিবারকে উচ্ছেদ প্রক্রিয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ উক্ত ছয়টি পরিবারকে উচ্ছেদের জন্য বার বার চাপ দিয়ে আসছে বলে জানা গেছে। রাখাইন আদিবাসীরা প্রতিবাদ জানালেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছে না এবং এমনকি কোনো ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে না বলেও জানা গেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ছ আনি পাড়া নামে প্রায় তিনশ’ বছরের পুরনো রাখাইন গ্রামটির ৬টি পরিবারে প্রায় ২৮জন সদস্য রয়েছে। পায়রা বন্দরের জন্য জমি অধিগ্রহণের সময় গ্রামটাকে বাদ দিতে দাবি জানিয়ে আসছিল পাড়াবাসী। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাদের দাবির প্রতি তোয়াক্কা না করে বারংবার নোটিশ দিয়ে আসছিল কয়েক মাস আগে থেকে।
এদিকে নিয়ম অনুযায়ী অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণও দেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ করছেন ভুক্তভোগীরা। উল্টো প্রতিদিন নানা যানবাহন ও যন্ত্রপাতি নিয়ে একটু একটু করে গ্রামের বিভিন্ন জায়গা ভাঙা হচ্ছে বলে স্থানীয়রা নিশ্চিত করেছেন।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে স্থানীয় ভুক্তভোগী চিংদামো রাখাইন জানান, ‘বন্দর কর্তৃপক্ষ ছ আনা পাড়াবাসীকে বন্দরের জন্য নির্মিত গুচ্ছগ্রামে স্থানান্তরিত করতে চাইছে। সেই গুচ্ছগ্রাম বাঙালি অধ্যুষিত ধানখালীতে অবস্থিত। যেখানে তারা থাকতে চাইছেন না। কেননা, আদিবাসীরা একটু নিরিবিলি, নিজেদের মতো করে থাকেন। তারা শত বছরের পুরনো ঐতিহ্য, বটগাছ, বৌদ্ধ মন্দির এবং সাংস্কৃতিক নানা উপাদান ছেড়ে বাঙালি অধ্যুষিত সেই গুচ্ছগ্রামে থাকতে চান না।’ কিন্তু প্রশাসনকে তারা এটা জানালেও প্রশাসন নির্বিকার এবং সর্বশেষ গত ৮ জুন ২০২১ পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের পিডি ও ক্যাপ্টেন এম নুরুজ্জামান তাদেরকে ডেকে এক সপ্তাহের ভেতর গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে নির্দেশ দেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা চাই আমাদের বাপ-দাদার ভূমিতে বাস করতে। কিন্তু সরকারের যদি খুব প্রয়োজন হয় তবে তারা আমাদেরকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ ও সময় দিক। আর যদি পুনর্বাসন করতে হয় তবে আমাদেরকে রাখাইন অধ্যুষিত পাড়ায় পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হোক। তবে আমাদের গাছ-গাছালি আর অন্যান্য সম্পত্তি বিক্রি এবং স্থানান্তরের জন্য পর্যাপ্ত সময় দেয়া হোক।’ এদিকে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের নির্মাণ কাজের ফলে ক্রমান্বয়ে কর্তৃপক্ষের বালি এসে জায়গা-জমিতে এসে জমে গেছে এবং চাষযোগ্য জমিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
এবিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘ষাট কিংবা সত্তরের দশকে পটুয়াখালীতে ৬০-৭০ হাজার রাখাইন ছিল। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় কমতে কমতে আজ মাত্র আড়াই হাজারে নেমে এসেছে। তাদের পুকুর, জমি, শশ্মান দখল হয়ে যাচ্ছে। দেশান্তরিত হয়ে যাচ্ছেন এই আদিবাসীরা, এভাবে চলতে পারে না।’
তিনি আরো বলেন, ‘সর্বশেষ পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ উন্নয়নের নামে তাদের উচ্ছেদের যে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সেটাও নিয়ম মাফিক হচ্ছে না। যদি তাদেরকে উচ্ছেদ করতেই হয় তবে পুনর্বাসন এবং ক্ষতিপূরণের যে নিয়ম রয়েছে সেটা মেনে তাদের সম্পদের চেয়ে কয়েকগুন ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং তাদের চাহিদামত জায়গায় পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। পায়রা বন্দরের বিভিন্ন কার্যক্রমে তাদের সন্তানদেরকে যুক্ত করতে হবে যাতে তারা সে উন্নয়নের সুফল পান। ’
এদিকে এবিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য মেইনথেইন প্রমিলা বলেন, ‘যে গ্রামে উচ্ছেদের প্রক্রিয়া চলছে সেই রাখাইন গ্রামের পত্তন ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মেরও আগে এই গ্রামের জন্ম। কাজেই সরকার এটিকে ‘ন্যাশনাল হ্যরিটেজ’ হিসাবেও সংরক্ষণ করতে পারতো। কিন্তু পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ যে কাজ করছে তার মাধ্যমে সরকার বা রাষ্ট্রের সম্মান কমবে বৈ বাড়বে না।’ কাউকে ‘উচ্ছেদ’ করে করা উন্নয়ন ‘প্রকৃত উন্নয়ন’ হয় না বলেও অভিমত দেন এই আদিবাসী নারী নেত্রী।
তিনি আরো বলেন, ‘একটি প্রভাবশালী মহল অনেক আগে থেকেই এই গ্রামের রাখাইনদের উচ্ছেদের পরিকল্পনা করে আসছে। এখন সেই প্রভাবশালী মহল এবং পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ মিলে এই উচ্ছেদ পরিকল্পনা করছে। জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্রের ১০ নং অনুচ্ছেদে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, আদিবাসী অধ্যুষিত জায়গায় কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের পূর্বে স্থানীয়দের মতামত নিতে হবে, সেটাও করা হয়নি।’ যদি জোর পূর্বক উচ্ছেদ করে তবে ‘রোহিঙ্গা’ জনগোষ্ঠীর উপর যে ‘বল প্রয়োগ’ করা হয়েছে সেটার সামিল হবে বলেও মনে করেন তিনি। তবে যদি উচ্ছেদই করতে হয়, ক্ষতিপূরণের প্রকৃত নিয়ম মেনে এবং ভুক্তভোগীরা যেখানে পুনর্বাসিত হতে চায় সেখানেই পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।