হিল ভয়েস, ৯ আগস্ট ২০১৯, তাড়াশ, সিরাজগঞ্জ: এখন প্লাস্টিকের সামগ্রীর রমরমা ব্যবসা। হরেক রকম বাহারি প্লাস্টিক সামগ্রী পৌঁছে গেছে অজপাড়াগাঁয়ে। বাদ যায়নি গৃহস্থালি কাজে ব্যবহূত কুলা, চালুন, দাঁড়িপাল্লা, ধামাসহ নানান জিনিসপত্র। এসব প্লাস্টিক পণ্যের কারণে বাঁশ-বেতের তৈরি গৃহস্থালি জিনিসপত্র এখন আর চলে না। আর এ কারণে পেশা হারাতে বসেছেন চলনবিলের আদিবাসী পল্লীর অনেক পরিবার, যারা এসব জিনিসপত্র তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। প্লাস্টিক শিল্পের আগ্রাসনে এককালের ঐতিহ্যবাহী আদিবাসীদের তৈরি কুটির শিল্পসামগ্রী এখন বিলুপ্তির পথে। উত্তরের সমতলের আদিবাসীদের মধ্যে চলনবিল অধ্যুষিত সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া, পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, নাটোরের গুরুদাসপুর, সিংড়া উপজেলার বিভিন্ন জনপদে প্রায় ৪০-৪৫ হাজার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বাস। তাদের মধ্যে ওরাঁও, মাহাতো, তেলী, তুড়ি, রবিদাস, কনকদাস, সাঁওতাল, বড়াইক, সিংসহ একাধিক সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর কিছু পরিবার বংশপরম্পরায় তাদের হাতে তৈরি বাঁশ-বেতের কুটির শিল্পসামগ্রী বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
একসময়ে চলনবিল অধ্যুষিত আদিবাসী পল্লীগুলোতেও যেসব নারী-পুরুষ কৃষি ও ইটভাটা শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন, সেই পরিবারগুলোতে আষাঢ় থেকে অগ্রহায়ণ পর্যন্ত চার মাস অভাব-অনটন থাকত। সংসার বাঁচাতে তখন আদিবাসী পরিবারগুলোতে কুটির শিল্পসামগ্রীর বিকিকিনি ছিল অন্যতম উপায়। আদিবাসীদের কিছু পরিবার এসব পণ্য তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। আর কিছু পরিবার তৈরি পণ্য বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে কুটির শিল্পের ভূমিকা ছিল এমনই- এভাবেই বিষয়টি ব্যাখ্যা করলেন তাড়াশ-রায়গঞ্জ ওরাঁও ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক যোগেন্দ্র নাথ টপ্য।
তাড়াশ উপজেলার মাধাইনগর গ্রামের হৈমন্তী ওরাঁও (৭৫) বলেন, চলনবিলের মানুষের গৃহস্থালি কাজকর্মে আদিবাসীদের তৈরি জিনিসপত্র একসময় অপরিহার্য ছিল। হাট-বাজারে প্রয়োজনের তাগিদেই কৃষিজীবী পরিবারগুলো আদিবাসীদের তৈরি নানা কুটির শিল্পসামগ্রী স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবহার করতেন বছরের পর বছর, যা পরিবেশবান্ধবও ছিল।
যেমন, খেজুর গাছের পাতা দিয়ে মাদুর বা পাটি বা সপ, মাছ রাখার বাঁশের তৈরি খালৈই, মাছ ধরার পলো, চাল বাছার বেতের তৈরি কুলা, ধান চালনা (চালুন), খৈ চালনা (খৈচালা), বাড়িতে কোনো অতিথি এলে বসতে দেওয়ার জন্য বাঁশের মোড়া, হাঁস-মুরগি লালন-পালনের জন্য বাঁশ দিয়ে তৈরি টপা, বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বাঁশ ও পাটের দড়ির খাটিয়া বা খাটলি, মাটি আনা-নেওয়ার জন্য বাঁশের তৈরি টুকরি, ধান-চালসহ বিভিন্ন ফসল মাপার জন্য বেতের তৈরি দাঁড়িপাল্লা, ঢাকি, মুড়ি-মুড়কি খাওয়ার জন্য বেতের তৈরি কাঠা, ধানের বীজ বপনের জন্য বেত দিয়ে তৈরি ধামা, ঘরবাড়ি পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে ব্যবহার করা হতো বিন্নার ফুল দিয়ে তৈরি ঝাড়ূ বা সাফটা, গরুর মুখে দেওয়ার জন্য বাঁশের টোনা-টুরি। এ ছাড়াও আদিবাসীদের বিয়েতে অপরিহার্য ছিল বাঁশের তৈরি পেটারী ইত্যাদি।
তবে কালের পরিক্রমায় সভ্যতার বিকাশে অজপাড়াগাঁয়ে শুধু নয়, সর্বত্রই প্লাস্টিক সামগ্রীর বিবিধ ব্যবহারের ফলে চলনবিলের আদিবাসীদের বাঁশ, বেতের তৈরি এসব সামগ্রী বিলুপ্তির খাতায় নাম লেখাতে চলেছে। এদিকে মানুষ বন-জঙ্গল কেটে ফেলার কারণে বেত প্রায় দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেছে। বাঁশের দামও বেশ চড়া, মাছ শিকারে বাঁশের তৈরি উপকরণ আর চলে না। আগের মতো গরুর পাল না থাকায় তাদের মুখে বাঁশের ঠুুলি-টুরিও পরাতে হয় না।
তাড়াশের দত্তবাড়ী গ্রামের কলেজ শিক্ষক প্রদীপ মাহাতো মনে করেন, গৃহস্থালি কাজের ব্যবহার হচ্ছে প্লাস্টিক সামগ্রী। এখন মানুষজন গৃহস্থালি কাজে বাঁশ-বেতের জিনিস ব্যবহার করতে চায় না। একসময় যেসব আদিবাসী পরিবার কাজ না থাকার সময়ে জীবিকা নির্বাহের তাগিদে কুটির শিল্পের প্রতি নজর দিত, সে সুযোগ এখন আর নেই। ফলে বাঁশ-বেতের তৈরি কুটির শিল্পের সঙ্গে জড়িত আদিবাসী অনেক পরিবার পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। কারিগররা অন্য পেশায় যাচ্ছেন, কাজের জন্য অনেকেই শহরে দিকে ছুটছেন।
রায়গঞ্জের গোপালপুর গ্রামের আদিবাসী পল্লীতে মোহন কনকদাসের বাড়িতে এখনও স্বল্প পরিসরে তৈরি হয় বাঁশ-বেতের তৈরি সামগ্রী। মোহন কনকদাস (৫২) জানান, তার বাবা মৃত পলান কনকদাস বাঁশ-বেতের সামগ্রী তৈরি করে সংসার চালাতেন। বাবার সেই ব্যবসা রপ্ত করে এখন সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। স্ত্রী বিনোদিনীকে নিয়ে দিনভর বাঁশ-বেতের সামগ্রী বানিয়ে বিক্রি করে কোনো রকমে চলছে সংসার। তিনি আরও জানান, তিনি ও তার বিধবা বোন ললিতা কনক দাস ছাড়া এ গ্রামে আর কেউ এই কুটির শিল্পের কাজ করেন না।
সিরাজগঞ্জ জেলা আদিবাসী ফোরামের সভাপতি সুশীল মাহাতো জানান, চলনবিলের ওরাঁও, মাহাতোসহ কিছু আদিবাসী সম্প্রদায়ের বা গোষ্ঠীর লোকজন একসময় কুটির শিল্পসামগ্রী তৈরি করতেন। সভ্যতার অগ্রগতিতে বর্তমানে সেসব পণ্যের চাহিদা না থাকাসহ নানা কারণে কুটির শিল্পে তাদের আগ্রহ নেই।
এ প্রসঙ্গে তাড়াশ ইউএনওর অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. ওবায়েদুল্লাহ জানান, কুটির শিল্পের জন্য সরকারের নানামুখী পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে। চলনবিল একটি বৃহৎ এলাকা। এ এলাকার আদিবাসীদের কুটির শিল্প রক্ষায় সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে।
উৎস: সমকাল, ৯ আগস্ট ২০১৯