হিল ভয়েস, ৩ মে ২০২১, বিশেষ প্রতিবেদক: সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় আদিবাসীরা প্রয়োজনীয় পানি সংকটের সম্মুখীন হচ্ছেন। বিশেষ করে বান্দরবানের বিভিন্ন উপজেলায় বহুদিন ধরে স্থানীয় আদিবাসীদের প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহের নির্ভরযোগ্য উৎস ঝিরি, ঝরনা, ছড়া ও বিভিন্ন পানির প্রবাহ থেকে নির্বিচারে পাথর উত্তোলনের ফলে সেই পানিপ্রবাহ শুকিয়ে যাচ্ছে। গ্রীষ্ম মৌসুম শুরু হওয়ায় স্থানীয় আদিবাসীরা পানি সংকটের মুখোমুখী হচ্ছেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। অন্যদিকে পার্বত্য আরেক জেলা রাঙ্গামাটির বরকল, বিলাইছড়ি, জুড়াছড়ি বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেকসহ বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলের আদিবাসীরা সুপেয় পানির সংকটে ভুগছেন বহুদিন ধরে। বলা হচ্ছে সময়মতো পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়া এবং কাপ্তাই হ্রদের পানি কমে যাওয়া তথা ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কমে যাওয়ার কারণেই এ ধরণের পানি সংকটের মুখোমুখি হচ্ছেন আদিবাসীরা। এ বিষয়ে ‘পানি সংকটে জুম পাহাড়ের মানুষ’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল সংলাপের আয়োজন করে আদিবাসীদের মিডিয়া সংস্থা আইপিনিউজ।
আইপিনিউজ এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আন্তোনি রেমা’র সঞ্চালনায় উক্ত ভার্চুয়াল সংলাপে অংশ নেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি’র (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার উন্নয়ন সংস্থা জাবারাং কল্যাণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা, প্রাণ বৈচিত্র্য গবেষক ও লেখক পাভেল পার্থ, বান্দরবানের প্রথম আলোর প্রতিনিধি বুদ্ধজ্যোতি চাকমা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অনুরাগ চাকমা, রাঙ্গামাটির আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী এডভোকেট সুস্মিতা চাকমা, বান্দরবানের উন্নয়ন সংস্থা হিউমেনিটেরিয়ান ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মংমং সিং মারমা ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম ম্যানেজার জাহেদ হাসান প্রমুখ।
বিশিষ্ট পরিবেশ আইনবিদ ও বেলা’র নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, পানি যেখানে থাকবে না সেখানে জীবন থাকবে না। কাজেই পানি সংকট যেহেতু চলে আসছে সেখানে আরো নানা ধরণের সংকট তৈরী হবে।
তিনি আরো বলেন, বিধি বা আইন অনুযায়ী পাহাড়ে কোনো ইটভাটা থাকার কথা নয়। কাজেই যতগুলো ইটভাটা আছে সেগুলোর বৈধ কোনো ছাড়পত্র থাকার কথা নয়। সেই ইটভাটাসমূহের তালিকা তৈরী করে আইনি লড়াই চালানো জরুরী বলেও মনে করেন তিনি। তাছাড়া যে জায়গায় পানির তীব্র সংকট আছে, যে ঝিরি ও ঝর্নাগুলোর পানি শুকিয়ে যাচ্ছে সেগুলোর তালিকা তৈরী করে সেগুলোর সার্ভে, অবস্থান এবং শুকিয়ে যাওয়ার প্রভাব নিরূপণ করা জরুরী বলেও মনে করেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, সমাজে আজকাল আইনি লড়াই বা হাইকোর্টের রায় তেমন চাপ তৈরী করতে পারছে না। কিন্তু তাসত্ত্বেও আমাদেরকে তা করতে হবে। প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষা, পাথর উত্তোলন বন্ধে আইনি লড়াই চালানোর কাজে সহায়তা প্রদানেরও আশ্বাস দেন এই বিশিষ্ট পরিবেশ আইনবিদ।
আলোচনায় জাবারাং কল্যাণ সমিতি’র নির্বাহী পরিচালক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, প্রতিবছরই পাহাড়ের মানুষগুলোকে এই সংকটে পড়তে হয়। এর মূল কারণ হলো পাহাড়ে আগেকার দিনে বড় বড় গাছ ছিল। পাহাড় না কেটে আমরা ঘর-বাড়ি তৈরী করতাম। ছড়াগুলো ছন্দময় ছিল। ছড়ার পাথর তোলা, গাছ বিক্রি করা অকল্পনীয় ছিল। কিন্তু এখন বন উজার হয়ে যাচ্ছে। জঙ্গল আগের মত সবুজ নেই। চারিদিকে ন্যাড়া পাহাড়। যার কারণে পাহাড়ে এখন পানির সংকট।
আমরা তথাকথিত সভ্যতার সাথে তাল মিলাতে ইটভাটা গড়ে তুলছি দাবি করে তিনি আরো বলেন, ইটভাটাগুলোতে কচি কাঠ পোড়ানো হচ্ছে যা পরিবেশের ক্ষতি করছে। তাছাড়া একই প্রজাতির চাষাবাদ হচ্ছে বিভিন্ন অঞ্চলে। যেখানে সেগুন হয় সেখানে কেবল সেগুন, যেখানে কেবল রাবার হয় সেখানে কেবল রাবার চাষ হচ্ছে। এইসবের ফলে জলবায়ুর পরিবর্তন দ্রুত হচ্ছে। এর ফলে আমরা পানি সংকটের মুখোমুখি হচ্ছি। এই সংকট নিরসনে প্রকৃতিকে আঘাত না করে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরসহ সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে এবং জঙ্গলকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা এবং ছড়াগুলো’কে ছন্দময় করার জন্য উদ্যোগ নেওয়ারও আহ্বান জানান তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক অনুরাগ চাকমা বলেন, এই সংকটের মূলে কয়েকটি ন্যারেটিভ কাজ করছে। এসবের একটি হচ্ছে ন্যাচারাল কজ। সেটা হচ্ছে অনাবৃষ্টি। অন্য আরেকটি দিক হল পাহাড়ের মানুষ যখন ব্যবসা চিনতে শুরু করে এবং পুঁজিবাদী ধারার বিকাশ ঘটতে শুরু করে তখন আমরা বিবেক, মানবতা সবকিছু বিক্রি করতে শুরু করেছি। অতিমাত্রায় লোভ আমাদেরকে ‘ইকোসাইড’ (পরিবেশহত্যা) এ উদ্বুব্ধ করছে বলেও মনে করেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, বন ও জঙ্গল উজারের পেছনে আরেকটি মহল দায়ী। সেটা হলো বনবিভাগ। রাষ্ট্রের বন রক্ষার দায়িত্ব যাদের হাতে দেয়া হয়েছে তাদের সাথে স্থানীয় ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একটা যোগাযোগ রয়েছে। যার মাধ্যমে পাহাড় তথা বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বন দখল করা হচ্ছে এবং পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। নৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার ফলেই বনবিভাগসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এই ধরনের কার্যক্রমে জড়িত হচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি।
সাংবাদিক বুদ্ধজ্যোতি চাকমা বলেন, বাংলাদেশের ডেল্টা পরিকল্পনায় যা আছে সেটা হল, পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ ‘সারফেস ওয়াটার’ বা ভূ-উপরিস্থ পানির উপর নির্ভরশীল। এখানে ভূগর্ভস্থ পানি তেমন নেই। পাহাড়ের পানি কাঠামো টিকে আছে প্রাকৃতিক ঝর্ণা, প্রাকৃতিক বন, ঝিরি, ছড়ার উপর। এই প্রাকৃতিক বন সংরক্ষণ করে কেবলমাত্র জুমচাষীরা। আগেকার দিনে জুমচাষীরা কয়েক বছর অন্তর অন্তর এক জায়গায় জুমচাষ করে। যার ফলে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে সেখানে প্রাকৃতিক বন গজিয়ে উঠতে পারে। কিন্তু এখন সেই প্রাকৃতিক বন উজার হয়ে যাওয়ার ফলে পানি কাঠামো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের তথাকথিত উন্নয়ন এখন ‘বন-পাহাড় উজার কর, আর বিল্ডিং তৈরী কর’ এই বিধ্বংসী মন্ত্রের সাথে জড়িত। যার ফলে ঝিরি, ঝর্ণা থেকে পাথর উত্তোলন হচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ী এবং স্থানীয় কিছু লোভী ব্যক্তিদের জোগসাজসে। সমাজে টপ টু বটম নৈতিক অবক্ষয়ের ফলে বান্দরবানে লক্ষ লক্ষ টন পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি। জনসাধারণের চাপে প্রশাসন উত্তোলিত পাথর জব্দ করছে কিন্তু কিছুদিন পর দেখা যাচ্ছে সেই পাথর উধাও হয়ে যাচ্ছে দাবি করে তিনি আরো বলেন, এক্ষেত্রে স্থানীয় মানুষদেরও দায় রয়েছে।
আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী সুস্মিতা চাকমা বলেন, বিষয়টা আসলে নতুন না। সাম্প্রতিক সময়ে পানি সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। পাহাড়ে পানি তোলার কাজটি প্রথমত নারীরাই করে থাকেন। নারীরা উঁচু পাহাড় বেয়ে দৈনন্দিন পানি সংগ্রহের কাজটি করে। একজন নারীকে যখন বেশি সময় ব্যয় করে দূরপ্রান্ত থেকে পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে তখন তার নিরাপত্তার দিকটি যেমন বিঘ্নিত হচ্ছে তেমনি অন্য কাজের সুযোগও কমে যাচ্ছে। অনেকেই ধর্ষণ তথা যৌন সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। আর বেশি সময় ব্যয় করতে হওয়ার কারণে আয়বর্ধনমূলক কার্যক্রমে অংশ নিতে পারছে না এবং ফলে নারীরা নানা ধরনের ‘ডমেস্টিক ভায়োলেন্স’ এর শিকার হচ্ছে বলেও জানান তিনি। তাছাড়া বাণিজ্যিক বনের বদলে প্রাকৃতিক বন গড়ে তোলা, ইটভাটা বন্ধ ও মনোকালচার চাষপদ্ধতি বৃদ্ধি এবং পর্যটন সংশ্লিষ্ট অবৈধ স্থাপনা রোধ করার ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন এই আইনজীবী।
প্রাণ বৈচিত্র্য গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, লাগাতার অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে এই সংকট তৈরী হয়েছে। অন্যায়ভাবে এইসব অঞ্চলের প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থানকে তছনছ করে দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রীয় আইনকে লঙ্ঘন করে, স্থানীয় আদিবাসীদের সামাজিক বিশ্বাসকে তুচ্ছ করে এবং পরিবেশ বিজ্ঞানের সূত্রকে অমান্য করে নানা কর্মকান্ড পরিচালনার ফলেই এই সংকটের সৃষ্টি হচ্ছে। তাছাড়া একদল মুনাফা লোভী দুর্বৃত্ত কোনো ধরনের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক নিয়ম-নীতি না মেনে পর্যটন শিল্পের বিকাশে কেবল মুনাফার জন্য কাজ করছে। এছাড়া বৈশ্বিক কার্বন নি:সরণের প্রভাবও পাহাড়ে পড়ছে। যার ফলে অনাবৃষ্টি ও খরা দেখা দিয়েছে। যার কারণে এ সংকট তীব্র হচ্ছে বলে মনে করেন এই গবেষক।
পাহাড়ি মানুষ পাহাড় না কেটে তাদের ঐতিহ্যিক উপায়ে পাহাড়ে ঘরবাড়ি তৈরী করলেও এখন অবাধে পাহাড় কাটার ফলে পাহাড় ধ্বসে পড়ছে এবং পানির প্রবাহ বিনষ্ট হচ্ছে দাবি করে তিনি আরো বলেন, পাহাড়ের আদিবাসী এবং জীব বৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাছাড়া পানি শুকিয়ে যাওয়ার ফলে পাহাড়ের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রাণিগুলোর বিচরণস্থল সংকুচিত হয়ে আসছে এবং বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের ছড়া ও ঝিরিগুলোর সুরক্ষা দেওয়ার জন্য সেগুলোর সরকারি তালিকা তৈরী করা এবং সরকারি ব্যবস্থাপনার অধীনে নিয়ে আসার আহ্বানও জানান তিনি।
হিউমেনিটেরিয়ান ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মংমং সিং মারমা বলেন, বান্দরবানে পাথর উত্তোলন বন্ধে সরকারের সকল বিভাগ’কে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে। স্থানীয় পাড়া প্রধান ও কার্বারীরা না চাইলেও তাদেরকে অনেক সময় বাধ্য করা হয়। পাথর উত্তোলনের ফলে দুর্বিসহ অবস্থায় পড়ছে স্থানীয়রা। কিছুদিন আগেও পাথর খুঁজতে গিয়ে চিম্বুকে পাহাড়ে বাগান পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কাজেই সরকারি কর্মকর্তাদের প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা ও দায় না বাড়ালে প্রকৃতিকে রক্ষা করা যাবে না বলেও মনে করেন তিনি।
উন্নয়নকর্মী জাহেদ হাসান বলেন, আমার অভিজ্ঞতা বলে যে, পাহাড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পানির যে সংকট সেটা প্রত্যক্ষভাবে না গেলেই বুঝা যাবে না। পাহাড়ে একটা নারীর দীর্ঘ সময় চলে যায় পানি সংগ্রহের কাজে। রাত তিনটা’র সময়ও একজন পাহাড়ি নারীর বের হতে হচ্ছে পানি সংগ্রহের জন্য। এটা খুব অমানবিক একটা কাজ। বেসরকারিভাবে উন্নয়ন সংস্থাগুলো পানি সংকট নিরসনে যে কাজগুলো পাহাড়ে করেছে সেগুলো কমে যাচ্ছে। প্রকল্প প্রণয়নের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়ারও আহ্বান জানান তিনি। প্রেস বিজ্ঞপ্তি