আদিবাসী নারীরা জাতিগত আগ্রাসন, সহিংসতা ও বৈষম্যের শিকার- কাপেং ও নারী নেটওয়ার্ক

হিল ভয়েস, ৮ মার্চ ২০২১, ঢাকা: আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে মানবাধিকার সংগঠন কাপেং ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক এক বিবৃতিতে বলেছে, সংখ্যালঘু ও আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর নারীরা প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লংঘন এবং জাতিগত আগ্রাসন, সহিংসতা ও বৈষম্যের শিকার হতে বাধ্য হচ্ছে। আদিবাসী নারীরা জাতিগত, লিঙ্গগত, ভাষাগত, ধর্মীয়গত এবং শ্রেণীগত কারণে বৈষম্যের শিকার হয়। ফলে তারা বিভিন্ন ভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আদিবাসীরা পাহাড় বা সমতলে কঠিন সংগ্রাম ও লড়াই করে বেঁচে আছে। বলা যায়, পাহাড় বা সমতলের আদিবাসীদের বঞ্চনা ও সংগ্রামের কাহিনী প্রায় একই সূত্রে গাঁথা। দেশব্যাপী আদিবাসীদের উন্নয়নের নামে ভূমি দখল, ভূমির কারণে নারীর উপর শ্লীলতাহানির মত মানবাধিকার লঙ্ঘন, মিথ্যা মামলা, আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় সেটেলার পূর্ণবাসন, সামরিকীকরণ, আদিবাসী এলাকায় অপরিকল্পিত জনবিরোধী উন্নয়নের ফলে আদিবাসীরা নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ হতে বাধ্য হচ্ছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় পড়ে আদিবাসী নারী ও শিশুরা।

করোনাকালে আদিবাসীদের পরিস্থিতির কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, গত বছর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত করোনা মহামারির সময় আমরা লক্ষ করেছি যে, এই ধরনের দুর্যোগ আদিবাসীদের কী করে আরও বেশি প্রান্তিকতায় ঠেলে দেয়। কিন্তু বিশ্বব্যাপী এই আদিবাসীরাই তাদের প্রথাগত লকডাউন ব্যবস্থার কারণে বড় ধরনের সংক্রমণ থেকে বেঁচে গেলেও আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় খাদ্যঘাটতি ছিল ভয়াবহ। সরকারী ত্রাণ ব্যবস্থা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল হলেও বেসরকারী সংগঠনগুলো সেই জায়গা পুষিয়ে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। আদিবাসীদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বরাবরই নাজুক। বিশ্ব মহামারিতে প্রান্তিকতা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার অবকাঠামোগত অনুন্নয়নের কারণে আদিবাসী এলাকায় বিশেষত নারীরা আরো বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। মহামারি করোনার সময় ও আদিবাসীদের ভূমি বেদখল ও সহিংসতার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এরমধ্যে আগষ্ট মাসে ভূমি দস্যুরা মৌলভীবাজার ও সিলেটে দুটি পান জুমে পান গাছসহ প্রায় ১০০০টি গাছ কেটে দিয়েছিল। এছাড়াও রাজশাহীতে খ্রিস্টান ধর্মপল্লীতে আবাসনের নামে ১৩০ টি আদিবাসী পরিবার উচ্ছেদ, কক্সবাজারে আদালতের আদেশ অমান্য করে রাখাইন সম্প্রদায়ের জমিতে দোকান নির্মাণের চেষ্টা ও বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ে ম্রোদের জায়গায় বিলাসবহুল পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণের প্রতিবাদে আদিবাসীরা বছর ব্যাপী আন্দোলনমূখর ছিল। কাপেং ফাউন্ডেশন ও নারী নেটওয়ার্কের যৌথ বিশ্লেষণে দেখা গেছে ২০২০ সালে কমপক্ষে ৫৯ জন নারী ও কন্যাশিশু বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছে। তন্মধ্যে বছরের শুরুতে কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে লাকিংমে চাকমাকে জোরপূর্বক অপহরণ করে বয়স লুকিয়ে ধর্মান্তকরন করে বিয়ে এবং বছরের শেষে লাকিংমে চাকমার মৃত্যু ছিল উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এছাড়া করোনার সময় মধুপুরের সংগ্রামী নারী বাসন্তি রেমার লোন নিয়ে গড়া কলা বাগান দিনে-দুপুরে বনবিভাগ কর্তৃক কেটে ফেলা ছিল একটি উল্লেখযোগ্য মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা, যা দেশব্যাপী নিন্দার ঝড় উঠেছিল। এছাড়া খাগড়াছড়ি শহরের অনতিদূরে বলপিয়ে আদামের এক চাকমা প্রতিবন্ধী তরুণীকে ৯ জন দুর্বৃত্ত কর্তৃক দলবদ্ধ ধর্ষণ মানবতাকে পরাজিত করেছিল।

সংগঠন দুটি জানায় যে, ২০২১ সালের শুরুতেই গত দুই মাসে প্রায় ৮ জন আদিবাসী নারী ও শিশু বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছে। এমনিতর বাস্তবতায় আদিবাসী নারীদেরকে পথ চলতে হচ্ছে। একদিকে যেমন নারী নেতৃত্ব করোনা মহামারি কাটিয়ে উঠতে সহযোগীতা করেছে, অন্যদিকে করোনাকালে নারীর উপর নানা মাত্রায় সহিংসতা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। নারী ধর্ষণ, হত্যা, অপহরণ, নিপীড়ন, বেতন বৈষম্য, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য বেড়েছে।

সংগঠন দুটি, ‘নারীদের বিশেষ করে প্রান্তিক আদিবাসী নারীদের সুন্দর ভবিষ্যত বিনির্মাণের জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের কোন বিকল্প নেই। এজন্য নারী উন্নয়ন নীতিমালাসহ জাতীয় বিভিন্ন নীতিমালায় আদিবাসী নারীদের স্বার্থসমূহ সন্নিবেশ ঘটাতে হবে।’ বলে উল্লেখ করে।

এছাড়া সংগঠন দুটি নারীর উপর রাষ্ট্রীয় বৈষম্য, জাতিগত-সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, নিপীড়ন ও বঞ্চনা দূর করার উদ্দেশ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তথা রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতির প্রতিফলন ঘটিয়ে রাষ্ট্রকে সর্বাগ্রে এগিয়ে আসার জোর দাবি জানায়।

More From Author