হিল ভয়েস, ১ মার্চ ২০২১, বিশেষ প্রতিবেদক: অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে কিভাবে শান্তি স্থাপন ও টেকসই করা যায় এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি কিভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, এ নিয়ে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং পার্বত্য চুক্তির অন্যতম স্বাক্ষরকারী, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) এর মধ্যে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
গতকাল ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ বেলা ১১:৩০ টার দিকে ঢাকাস্থ বাংলাদেশ সচিবালয়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দপ্তরে এই বৈঠক শুরু হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে খবর পাওয়া গেছে। প্রথমে সন্তু লারমার সাথে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রায় ২০ মিনিট একান্তে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এরপর আরও এক ঘন্টাব্যাপী দ্বিতীয় দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠকে সন্তু লারমা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক ও মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে।
বৈঠকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান অশান্তি ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ে এবং শান্তিপ্রক্রিয়া কিভাবে আরও টেকসই করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফিরিয়ে আনা এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে চুক্তির পর ছেড়ে আসা বিভিন্ন সেনাক্যাম্পে সেনাবাহিনীর পরিবর্তে পুলিশ মোতায়েনের পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
এ সময় সন্তু লারমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্যই পার্বত্য চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। কিন্তু চুক্তি তো যথাযথভাবেই বাস্তবায়িত হয়নি। চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্যাঞ্চলে শান্তি ফিরে আসেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই বলে শ্রী লারমা জানান।
সন্তু লারমা আরো বলেন যে, ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামক এক প্রকার সেনাশাসনসহ নিরাপত্তা বাহিনীর সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার না করে কেবল পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করে পার্বত্য চট্টগ্রামে কাক্সিক্ষত শান্তি ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে। চুক্তি বাস্তবায়ন না করে কেবল পুলিশ মোতায়েন করে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয় বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।
পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ১৯৯৮ এবং তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ১৯৮৯ যথাযথভাবে কার্যকরকরণ, পার্বত্য চট্টগ্রাম আইন-শৃঙ্খলা উন্নয়নে ‘পুলিশ’ ও ‘আইন-শৃঙ্খলা’ বিষয়টি তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তর, পার্বত্য চুক্তির সঙ্গতি বিধানকল্পে ১৮৬১ সালে পুলিশ আইন, পুলিশ রেগুলেশন এবং ১৯০০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি সংশোধন, ‘ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা’ বিষয়টি হস্তান্তরসহ ভূমি কমিশনের বিধিমালা প্রণয়ন, নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে অহস্তান্তরিত বিষয়সমূহ তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তর ইত্যাদি বিষয়সমূহ তুলে ধরেন। পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসীদেরকে তিন পার্বত্য জেলায় পোস্টিং দেওয়ার কথাও তিনি তুলে ধরেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে সন্তু লারমা আরো বলেন যে, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে আবুল হাসনাত আবদুল্লাহের নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ কমিটি। তাই চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এই কমিটির সম্পৃক্ততা অত্যাবশ্যক বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
বৈঠকে পার্বত্য চুক্তির কোন কোন ধারাবাস্তবায়িত হয়েছে, কোন কোন ধারা বাস্তবায়িত হয়নি সে বিষয়েও আলোচনা করা হয়। এ সময় সন্তু লারমা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের উপর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রকাশিত ২০১৯ সালের প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিকট হস্তান্তর করেন।
বৈঠকে উভয়পক্ষে সিদ্ধান্ত হয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের নিয়ে আবারও অতিশীঘ্রই বৈঠক হবে এবং উক্ত বৈঠকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটিকে সম্পৃক্ত করা হবে।
উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনতে সন্তু লারমার সাথে বৈঠকের তাগিদ দিলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে এই বৈঠকের উদ্যোগ নেন বলে জানা গেছে। বৈঠকে আন্তরিক পরিবেশে গুরুত্ব সহকারে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয় বলে বৈঠক সূত্রে জানা যায়। পূর্বের মতো চুক্তি বাস্তবায়নে পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা দিয়ে যাবেন বলে সন্তু লারমা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আশ্বাস প্রদান করেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার শান্তিপূর্ণ ও রাজনৈতিক উপায়ে সমাধান এবং জুম্মসহ স্থায়ী অধিবাসীদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষে বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু বিগত ২৩ বছর অতিক্রান্ত হলেও সরকার চুক্তিটি পূর্ণাঙ্গরূপে ও যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করেনি। উপরন্তু সাম্প্রতিককালে সরকার ও প্রশাসন চুক্তি বাস্তবায়ন না কওে এবং চুক্তি বাস্তবায়ন বন্ধ রেখে চুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতির নেতাকর্মী ও জুম্ম জনগণের উপর দমন-পীড়নের পথ অবলম্বন করে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম ক্রমাগত পূর্বের মত অস্থিতিশীল, অশান্ত ও জটিল পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হতে থাকে।
আরো উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ সভায় কমিটির অন্যতম সদস্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছেন যে, পার্বত্য চুক্তির অন্যতম স্বাক্ষরকারী সন্তু লারমাকে মাইনাস করে যে প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে তা কখনোই সঠিক নয়। সন্তু লারমাকে বাদ দিয়ে কখনোই পার্বত্যাঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয় বলে তিনি জানান।