হিল ভয়েস, ১০ জানুয়ারি ২০২১, রাঙ্গামাটি: রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার বাঘাইছড়ির সাজেক এলাকায় সেনাবাহিনী কর্তৃক ৩২ কিলোমিটার পরিমাণ সড়ক নির্মাণ করতে চারটি গ্রামের আদিবাসী জুম্ম গ্রামবাসীর ভূসম্পত্তি ও মূল্যবান বাগান-বাগিচা ধ্বংসের মুখে পড়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। নির্মাণাধীন সাজেক-কমলাক সড়ক সংলগ্ন ক্ষতির সম্মুখীন এই চারটি গ্রাম হল- দাঁড়িপাড়া, ছয়নালপাড়া, বড় কমলাকপাড়া ও উদয়পুর।
এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সাজেক ইউনিয়নের এই চারটি গ্রামের অন্তত ৬০টি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে দাঁড়িপাড়ার ১০ পরিবার, ছয়নালপাড়ার ১৮ পরিবার, বড় কমলাকপাড়ার ২২ পরিবার এবং উদয়পুর গ্রামের ১০ পরিবার রয়েছে। এছাড়াও আরও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার রয়েছে রয়েছে বলে জানা গেছে।
ভুক্তভোগীদের সূত্রে জানা গেছে, এই চারটি গ্রামের ৬০ পরিবারের অন্তত ৪৩ একর ভূমি বেদখল করা হয়েছে এবং সেখানে গড়ে তোলা দীর্ঘ দিনের সেগুন, কলা, আম, লিচু, সুপারি, ফুল ঝাড়ু– ইত্যাদি বাগান ও হলুদ, তিল ইত্যাদি ক্ষেত ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।
এমনকি সড়কের পাশে থাকা বেশকিছু জুম্ম গ্রামবাসীর বাড়িঘরও ভেঙে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বলাবাহুল্য, সেনাবাহিনী এতে শুধু জুম্মদের মূল্যবান ফলজ ও বনজ বাগান ধ্বংস করে দেয়নি, বড় বড় বুলডোজার ও ট্রাক্টর দিয়ে একরের পর এক প্রাকৃতিক বন ও পাহাড় ধ্বংস করেছে।
জানা গেছে, সেনাবাহিনীর ২০ ইসিবি ভারতের মিজোরামের সীমান্তবর্তী এই সাজেক-কমলাক সড়কটি নির্মাণ করছে। উক্ত রাস্তাটির প্রস্থ ৪০ ফুট করা হবে বলে জানা গেছে। মুলত জুম্মদের ভোগদখলীয় জায়গার উপর দিয়েই এই সড়কটি নির্মাণ করা হচ্ছে।
স্থানীয় জুম্মরা সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের নিকট এবিষয়ে অভিযোগ ও প্রতিবাদ করলেও সেনা কর্তৃপক্ষ তা আমলে নেয়নি। ক্ষতিপূরণের দাবি করলেও তা এড়িয়ে যায়।
উপরন্তু সেনাবাহিনীর তরফ থেকে ভুক্তভোগী জুম্মদের ধমকের সুরে বলা হয়েছে, ‘এগুলো সরকারি জায়গা। এই জায়গাগুলোতে তোমাদের কোন অধিকার নেই। এসব জায়গা তোমরা দাবি করতে পার না। প্রশাসন চাইলে যে কোনো সময় তোমাদের তাড়িয়ে দিতে পারে। সরকার তোমাদের ভালোবাসে বলেই এখনো তেমন কিছু করছে না।’
এলাকাবাসীর তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত সড়কটি সাজেকের রুইলুই দাঁড়িপাড়া থেকে শিজকছড়া বাঁধ পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার এবং শিজকছড়া হতে উত্তর দিকে উদয়পুর সড়ক পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার আর দক্ষিণ দিকে কমলাক পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত এসেছে।
উল্লেখ্য, স্থানীয় জুম্ম জনগণের অধিকারকে সম্পূর্ণভাবে পদদলিত করে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদসহ জনমতকে উপেক্ষা করে, সর্বোপরি পার্বত্য চুক্তি ও আঞ্চলিক পরিষদ আইনকে লংঘন করে সরকার ও প্রশাসন একতরফাভাবে সাজেক-কমলাক সীমান্ত সড়ক ও থেগামুখ স্থলবন্দর নির্মাণ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তারই অংশ হিসেবে গত ১০ মার্চ ২০২০ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোঃ আসাদুজ্জামান খান কামাল সাজেকে গিয়ে এই সড়ক নির্মাণ প্রকল্প পরিদর্শন করেন।
আরও উল্লেখ্য যে, শুরু থেকে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরকারী পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ স্থানীয় অধিবাসীদের অধিকারের কথা বিবেচনা করে এই সড়ক নির্মাণ প্রকল্পটি বন্ধ রাখার পক্ষে মতামত প্রদান করে। তারা পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এবং আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন যথাযথভাবে কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত ঠেগামুখ-কোয়ার্পুচ্ছয়া স্থলবন্দর উন্নয়ন এবং ঠেগামুখ থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণ কার্যক্রম বন্ধ রাখার লিখিত সুপারিশ পেশ করে। কিন্তু এরপরও সরকার ও সেনাবাহিনী এই সড়ক নির্মাণকাজ অব্যাহত রাখে।