হিল ভয়েস, ৬ জানুয়ারি ২০২১, বিশেষ প্রতিবেদক: কক্সবাজারের কিশোরী লাকিংমে চাকমাকে অপহরণের এগার মাস পর অপহরণকারী আতাউল্লাহর বাড়িতে তার মৃত্যুর ঘটনাটি যেমন ‘পরিকল্পিত হত্যাকান্ড’ বলে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তেমনি লাকিংমে চাকমার ধর্মান্তর ও বিয়ের ব্যাপারটিও জাল বলে জানা গেছে।
আজ এ বিষয়ে দৈনিক সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে যে, ‘অপহরণের পর লাকিংমে চাকমাকে কুমিল্লায় নিয়ে যান আতাউল্লাহ এবং সেখানে তাকে ধর্মান্তরিত ও বিয়ে করেন। যে জন্মসনদ ব্যবহার করে লাকিংমেকে ধর্মান্তরিত ও বিয়ে করা হয়েছে, সেটি জাল বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।’ এতে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘গত বছরের ২১ জানুয়ারি কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাজি (বিবাহ রেজিস্ট্রার) নূরুল ইসলাম বিয়েটি পড়ান এবং নিকাহনামা রেজিস্ট্রেশন করেন। একই দিন কুমিল্লা আদালতের আইনজীবী সিদ্দিকুর রহমান একটি হলফনামা নোটারির মাধ্যমে লাকিংমে চাকমাকে ধর্মান্তরিত করেন। এসবই আতাউল্লাহর সরবরাহ করা ওই জাল জন্মনিবন্ধন সনদ দিয়ে করা হয়েছে বলে জানান তারা।’
অপরদিকে লাকিংমে চাকমার হত্যাসহ ঘটে যাওয়া সকল ঘটনার তথ্যানুসন্ধানে গত ২৮ ও ২৯ ডিসেম্বর কক্সবাজার ও টেকনাফ ঘুরে আসা শিক্ষক, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও আদিবাসী নেতাদের একটি প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বলছেন, ‘মেয়েটি নিজে বাড়ি ছেড়ে এসেছে- আতাউল্লাহর এমন দাবি মেনে নিলেও অপ্রাপ্তবয়স্ক কাউকে ফুসলিয়ে নিয়ে যাওয়া অপহরণ বলেই গণ্য হবে।’ উল্লেখ্য, তথ্যানুসন্ধান দলের সংগৃহীত জন্মনিবন্ধন এবং প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) সনদ অনুযায়ী অপহরণের দিন লাকিংমের বয়স ছিল ১৪ বছর ১০ মাস।
ফলে তথ্যানুসন্ধানীরা আতাউল্লাহ ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে অপহরণ, অপ্রাপ্তবয়স্ককে ধর্মান্তর, বিয়েতে বাধ্য করার অভিযোগ এনেছেন। তাদের মতে, বিয়েটি আইনের চোখে অবৈধ, ফলে ধর্ষণের অভিযোগও আসবে আতাউল্লাহর বিরুদ্ধে।
তথ্যানুসন্ধানকারী দলটি তাদের সুপারিশমালায় উল্লেখ করে যে, ‘বয়স প্রমাণের পর এটা নিশ্চিত হয়েছে যে, লাকিংমেকে অপহরণ করা হয়েছিল। এরপর কিশোরী মেয়েটিকে জোরপূর্বক ধর্মান্তর, বিয়ে, যা ধর্ষণের নামান্তর। তাই নিয়মিত মামলা দায়ের করে এক্ষুণি অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার এবং জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার। অবশ্যই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।’
লাকিংমেকে বিয়ে নিয়ে অপহরণকারী আতাউল্লাহ ও তার মা রহিমা খাতুনের দেয়া বক্তব্যও পরস্পরবিরোধী। অনুসন্ধানকারী দলকে আতাউল্লাহ জানান, লাকিংমেকে বিয়ের আগে মা ও পরিবারের অন্যদের জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তার মা রহিমা খাতুন বলেন, গত রমজানের তিন দিন আগে বউ নিয়ে বাড়ি এলে তিনি জানতে পারেন, ছেলে বিয়ে করেছে।
তথ্যানুসন্ধানী দলের অনুসন্ধানে জানা যায় যে, টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের পরিচালক এহসান উল্লা জানিয়েছেন, কুমিল্লার আদালতে জমা দেওয়া সনদটির (লাকিংমে চাকমার জন্মসনদ) কোনো নিবন্ধন তাদের কাছে নেই। এটি ভুয়া সনদ। শুধু তাই নয়, সনদে যার স্বাক্ষর রয়েছে, সেই সফুরা বেগম দাবি করেছেন- এটি তার স্বাক্ষর নয়।
এ বিষয়ে আতাউল্লাহ বলেন, ‘লাকি বাড়ি থেকে কোনো কিছু নিয়ে আসতে না পারায় এটা করেছি। তবে আমি নিজে কিছুই করিনি। আমার কাছ থেকে ৬০ হাজার টাকা নিয়ে সবকিছু করে দিয়েছেন কুমিল্লার দিদার উকিল।’
এ বিষয়ে সমকালে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সমকালের অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়া গেছে, শিক্ষানবিশ আইনজীবী দিদারুল ইসলাম দিদার এই জোরপূর্বক ধর্মান্তর ও অপ্রাপ্তবয়স্ক বিয়েটি সম্পন্ন করে দেওয়ার জন্য দায়ী। তবে দিদার দাবি করেছেন, লাকিংমে চাকমা অপহরণের বিষয়ে তিনি কিছুই জানতেন না। আতাউল্লাহ নিজেই ওই জন্মসনদ নিয়ে এসে লাকিংমেকে প্রাপ্তবয়স্ক দাবি করেন। এরপর কাগজপত্র পেয়ে যাবতীয় কাজ করেছেন তারা। আতাউল্লাহ নিজেকে বাঁচানোর জন্য মিথ্যাচার করছেন।’
জানা গেছে, লাকিংমে চাকমাকে কুমিল্লায় নিয়ে এসে গত বছরের ২১ জানুয়ারি ধর্মান্তর ও কথিত বিয়ে করেন আতাউল্লাহ। কুমিল্লা আদালতের আইনজীবী সিদ্দিকুর রহমান যে হলফনামা নোটারি করার মাধ্যমে লাকিংমে চাকমাকে ধর্মান্তরিত করেন, সেটিতে শনাক্তকারী ছিলেন অ্যাডভোকেট কাজী এনায়েত উল্লা।
উল্লেখ্য, গত বছরের ৫ জানুয়ারি অপহৃত হয় লাকিংমে চাকমা। অপহরণের পর ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত লাকিংমেকে আশপাশের গ্রামে রাখা হয়। ৯ জানুয়ারি ওকে নিয়ে যাওয়া টেকনাফেরই শাহপরীর দ্বীপে। সেখানে জনৈক কালামনুর বাড়িতে আটকে রাখা হয়েছিল অন্তত দুদিন। ১১ জানুয়ারি আতাউল্লাহ ওকে নিয়ে যায় কুমিল্লায়। এরপর কুমিল্লার আদালতে লাকিংমেকে ধর্মান্তর এবং একটি কাজী অফিসে বিয়েতে বাধ্য করা হয়। টেকনাফেরই বাহারছড়া মাথাভাঙ্গা এলাকার ইয়াসিন, ইসা, আবুইয়াসহ আরও পাঁচজন লাকিংমেকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। লালাঅং তাঁর মেয়ে অপহরণের পর মামলা করতে গিয়েছিলেন টেকনাফ থানায়। তখন কক্সবাজারের টেকনাফ থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যা মামলায় বরখাস্ত এবং বর্তমানে জেলবন্দি প্রদীপ কুমার দাশ। থানায় মামলা করতে না পেরে ২৭ জানুয়ারি লালা অং কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন।
অপহরণের ১১ মাস পর গত ৯ ডিসেম্বর ২০২০ লালাঅং চাকমা তাঁর মেয়ে লাকিংমের খোঁজ পান। তবে জীবিত নয়, তখন কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে পড়ে আছে তাঁর প্রিয় কন্যার মরদেহ।