হিল ভয়েস, ৭ মে ২০২৫, রাঙ্গামাটি: গত ৫ মে, বান্দরবানের থানচি উপজেলার এক খেয়াং আদিবাসী নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের পর হত্যার প্রতিবাদ এবং অবিলম্বে হত্যাকারীদের গ্রেফতারপূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন (এইচডাব্লিউএফ), রাঙ্গামাটি জেলা শাখার উদ্যোগে রাঙামাটিতে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সমাবেশে বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতি, রাঙামাটি জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুমিত্র চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক রুমেন চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ম্রানুচিং মারমা, বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার ফোরাম, রাঙ্গামাটি অঞ্চলের সভাপতি অলনা তঞ্চঙ্গ্যা ও রাঙামাটি সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী লিলা চাকমা। শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, রাঙামাটি জেলা শাখার সহ-সাধারণ সম্পাদক মিলন চাকমা।
সমাবেশে রুমেন চাকমা বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে আমার মা-বোনেরা সবেচেয়ে বেশি নিরাপদ বোধ করে তাদের জুমে। সেই জুমে কাজ করতে গিয়েই চিংমা খেয়াংকে ধর্ষণের পর নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। নৃশংস এই ঘটনার তিনদিন অতিবাহিত হতে চললেও চিংমা খেয়াংয়ের ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে জড়িত কেউই গ্রেফতার হয়নি। চিংমার স্বামী সুমন খিয়াং তার বক্তব্যে স্পষ্টভাবে এই ঘটনার জন্য তিনজন পর্যটককে দায়ী করেছেন। থানচি থানায় ধর্ষণ ও হত্যা মামলা করলেও বান্দরবান জেলা পুলিশ ও বান্দরবান জেলা প্রশাসনের প্রদত্ত বিবৃতিতে ধর্ষণ নিয়ে কোন কথা নেই। ধর্ষণ ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়া এবং প্রকৃত অপরাধীদের বাঁচানোর লক্ষ্যে বান্দরবান পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের উদ্দেশ্যমূলক বিবৃতির আমরা তীব্র নিন্দা জানাই এবং এই প্রতিবেদন আমরা প্রত্যাখান করছি। ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড নিয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের যেকোন ধরণের তালবাহানা এবং ধামাচাপা দেওয়ার অপচেষ্টা জুম্ম ছাত্র সমাজ মেনে নিবে না। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের যদি যথাযথ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা না হলে ছাত্র ও যুব সমাজ তীব্র থেকে তীব্রতর আন্দোলনের মাধ্যমে আইন নিজের হাতে তুলে বাধ্য হবে। এর দায় সরকারকেই নিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘থানচিতে পর্যটকের প্রবেশ বন্ধ থাকা সত্ত্বেও সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট অতিক্রম করে সেখানে ‘জুম ওয়াইল্ড’ নামে একদল পর্যটক কীভাবে যায়? ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যেহেতু পর্যটকের দিকে অভিযোগ উঠেছে সেখানে থানচিতে ঘুরতে যাওয়া প্রত্যেক পর্যটককে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই তো ঘটনার রহস্য উম্মোচন করা যায় এবং অপরাধীদের শনাক্ত করা যায়। তাহলে সেটি কেন করা হচ্ছে না? পার্বত্য চট্টগ্রামে ঘটে যাওয়া নারী ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনাগুলোর দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হওয়ায় অপরাধীরা পার পেয়ে যাওয়ায় এই ঘটনাগুলো বারবার ঘটছে।’
ছাত্রনেতা রুমেন চাকমা বলেন, ‘১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে ৬টি স্থায়ী সেনানিবাস ব্যতিত সকল অস্থায়ী সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করার কথা থাকলেও সেটি এখনও করা হয়নি। বরঞ্চ পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাস ও নিরাপত্তাহীনতার জুজু তুলে পার্বত্য চুক্তিকে লঙ্ঘন করে সেনাক্যাম্প বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু এই সেনাক্যাম্পগুলোর কাজ কি? এই সেনাক্যাম্পগুলো যদি পাহাড়ীদের নিরাপত্তা দিতে না পারে তাহলে এই সেনাক্যাম্পগুলো থেকে কি লাভ? পাহাড়ের সেনাবাহিনীর দায়িত্ব কি শুধু বাঙালিদের নিরাপত্তা দেওয়া? এই যদি হয়ে থাকে তাহলে অপারেশন উত্তরণ নামক সেনাশাসনসহ পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী সকল অস্থায়ী সেনাক্যাম্প অতিদ্রুত প্রত্যাহারের উদ্যোগ গ্রহণ করুন। পার্বত্য চট্টগ্রামে খুন, ধর্ষণ, গুম ইত্যাদি মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনার বিচার না হওয়ার প্রধান কারণ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়া। এই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি শুধুমাত্র কাগুজে দলিল নয়, এই চুক্তিটি দীর্ঘ ২৪ বছরের সশস্ত্র লড়াই-সংগ্রামের ফসল। হাজারো মা-বোনের রক্তের বিনিময়ে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র দীর্ঘ ২৭টি বছরেও চুক্তির পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ বাস্তবায়ন করেনি। উপরন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র চুক্তিবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণকে জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের ষড়যন্ত্র সেটি চলমান রেখেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ সংখ্যায় কম হলেও তারা অধিকারের জন্য অতীতে জীবন দিয়েছে, ভবিষ্যতেও জীবন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। চিংমা খেয়াংয়ের ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় যদি যথাযথ বিচার না হয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে রাজনৈতিকভাবে যথাযথ ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধান করা না হয়, তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে যেকোন অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য সরকারই দায়ী থাকবে।’
সুমিত্র চাকমা বলেন, ‘আজকে রাজস্থলীতে ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ আয়োজনে প্রশাসন কেন বাধা প্রদান করছে তা আমাদের বোধগম্য নয়। গত মাসেও সেটেলার বাঙালি দ্বারা কাউখালী এক আদিবাসী মারমা নারীর ধর্ষণের ছাত্ররা যখন প্রতিবাদ করতে যায় তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাধা প্রদান করেছে। পাহাড়ে পূর্বে সংঘটিত ধর্ষণের ঘটনার বিচার ও অপরাধীদর শাস্তি না হওয়ার এধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে।’
তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে কালো চশমা দিয়ে না দেখে বা বাস্তবতার নিরিখে দেখতে হবে। তিনি জুম্ম নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূণাঙ্গ বাস্তবায়নের জোর দাবি জানান। তিনি আরও বলেন,পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে কালো চশমা দিয়ে না দেখে বা বাস্তবতার নিরিখে দেখে এই অন্তবর্তীকালীন সরকারকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে এগিয়ে আসতে হবে।
ম্রানুচিং মারমা বলেন, ‘বাংলাদেশ একটা স্বাধীন রাষ্ট্র। অথচ স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরেও বাংলাদেশে নারীরা তথা আদিবাসী নারীদের কোথাও নিরাপত্তা নেই। মুক্তিযুদ্ধে নারীরা ঝাপিয়ে পড়েছিল এরকম দিন দেখার জন্য নয়। তাদের প্রত্যাশা ছিল নারীরা অধিকার, নিরাপত্তা, আত্মমর্যাদা ও আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকবে। অথচ তার কিছুই হচ্ছে না। বরং নারীদের প্রতিনিয়ত ধর্ষণ, হত্যা, যৌন নিপীড়নসহ বিভিন্ন নারী সহিংসতার শিকার হতে হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, প্রশাসন এসব ঘটনার যথাযথ বিচার না করে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের মনে যেভাবে ক্ষোভের সঞ্চার সৃষ্টি করা হচ্ছে তা একদিন অগ্নিকু-ে পরিনত হবে। তখন কিভাবে সেই আগুন নেভাবেন? সেই দায়ভার অবশ্যই প্রশাসনকেই নিতে হবে।
অলনা তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, পাহাড়ে যখন ধর্ষণের ঘটনা ঘটে তখন এই রাষ্ট্র নিরব ভূমিকা পালন করে। এই রাষ্ট্র নারীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ যার জন্য আমাদের রাস্তায় প্রতিনিয়ত বিক্ষোভ মিছিল করতে হচ্ছে। তিনি অপরাধীকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা এবং ধর্ষকের সুষ্ঠু তদন্ত করে সর্বোচ্চ শাস্তির দেওয়ার আহ্বান জানান।
লীলা চাকমা বলেন, জুম্ম নারীরা দীর্ঘকাল ধরে সমাজে নিরাপদভাবে জীবন যাপন করত। কিন্তু ৮০ দশকে বহিরাগতদের অনুপ্রবেশের পর থেকে তারা নিরাপত্তাহীনতায় দিনযাপন করছে। তাদেরকে প্রতিনিয়ত ধর্ষণ, হত্যা, যৌন নিপীড়নসহ বিভিন্ন নারী সহিংসতার শিকার হচ্ছে। রাষ্ট্র ও প্রশাসন এর বিরুদ্ধে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নিচ্ছে না। আদিবাসী যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে প্রস্তুত রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, রাঙামাটি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ম্যাগলিন চাকমার সঞ্চালনায় সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন হিল উইমেন্স ফেডারেশন, রাঙামাটি জেলা কমিটির সদস্য সূচনা চাকমা।