বুমংচিং চাকমা
বর্তমানে প্রায়শই আমাদেরকে কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়-
কক্সবাজারে কি আদিবাসী চাকমা সম্প্রদায়ের বসবাস রয়েছে?
আপনি চাকমা না তংচঙ্গ্যা?
আপনাদের নামগুলো রাখাইন/মারমা নামের মতো কেন?
আপনারা তংচঙ্গ্যা ভাষায় কথা বলেন অথচ নিজেদেরকে চাকমা পরিচয় দেন-এর মানে কী?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে হলে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে অতীতের দিকে, আমাদের পূর্বপুরুষদের ইতিহাসে। যদিও এই ইতিহাস সম্পূর্ণরূপে লিপিবদ্ধ নয় এবং একে অনুধাবন করা কঠিন, তথাপি কিছু নিদর্শন ও ইতিহাসের টুকরো থেকে আমরা কিছুটা ধারণা লাভ করতে পারি।
যেহেতু আলোচনার বিষয় কক্সবাজারের চাকমা আদিবাসীদের নৃতাত্বিক পরিচয় নয়, যার জন্য দরকার গভীর তথ্যানুসন্ধান। আমি উপরের উল্লেখতি কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর কিছুটা আংশিক ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করবো।
কক্সবাজারে চাকমা জনগোষ্ঠীর উপস্থিতির বিষয়টি নতুন কিছু নয়। কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলার “চাকমারকুল ইউনিয়ন” এবং টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের “চাকমারকুল” নামই প্রমাণ করে, এখানে চাকমাদের ঐতিহাসিক উপস্থিতি ছিল। যদিও বর্তমানে এসব স্থানে চাকমা জনগোষ্ঠীর বসবাস নেই, তবে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় এখনো চাকমা পরিবারগুলোর বসবাস রয়েছে। যেমন-
★উখিয়া উপজেলায়:
মাদারবনিয়া, মনখালী, মনখালী জুমপাড়া, ছেনছড়ি, ছেনছড়ি মংহ্লা জুমপাড়া, মোছারখোলা ও তেলখোলা।
★ টেকনাফ উপজেলায়:
হরিখোলা, শীলখালী, লম্বাঘোনা, লাতুরি খোলা, আমতলী, পুটিবনিয়া ও কাটাখালী।
ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিংশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত কক্সবাজারের চাকমা জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষার হার অত্যন্ত নগণ্য ছিল। প্রায় ৯৯.৯% চাকমা পরিবার ছিল অশিক্ষিত এবং প্রধানত কৃষিকাজ ও জুমচাষে নির্ভরশীল। ফলে ইতিহাস রচনা কিংবা সংরক্ষণের সুযোগ তারা পাননি। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগের অভাব ছিল বলেই কক্সবাজারে চাকমা বসবাসের বিষয়টি বৃহত্তর চাকমা জনগোষ্ঠীর কাছে অনেকাংশে অজানা রয়ে গেছে। এছাড়াও সরকারি পাঠ্যপুস্তক বা নথিপত্রে বা কোনো লেখকের গ্রন্থাবলীতে কক্সবাজারের চাকমা জনগোষ্ঠী বসবাসের পরিচয়ের বিবরণ তেমন উল্লেখ নাই বললেই চলে। তবে বর্তমানে কিছু নব্য লেখকের গ্রন্থাবলীতে আমাদের (চাকমা)-কে তংচঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
কিছু লেখক তাদের গ্রন্থে কক্সবাজারের চাকমাদেরকে তংচঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে উল্লেখ করলেও, ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় আমরা মূলত চাকমা জনগোষ্ঠীর অংশ। চম্পকনগর থেকে চাকমা রাজপুত্রগণ আরাকানে যাত্রা করেন এবং নবম থেকে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত সেখানে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। অতঃপর আরাকানবাসীদের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে তারা চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ীভাবে বসতি গড়ে তোলেন।
তংচঙ্গ্যা বা দৈংনাকদের ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, “দেস্যাওয়াদি আরেদফুং” নামক আরাকানি গ্রন্থে তাদের উল্লেখ রয়েছে। চাকমা রাজা ও মগ রাজাদের মধ্যকার যুদ্ধ-বিগ্রহের সময় দশ সহস্র চাকমা প্রজার পূর্বতন উপাধি পরিবর্তন করে “দৈংনাক” রাখা হয়। অর্থাৎ, তংচঙ্গ্যারা মূলত চাকমাদেরই একটি শাখা।
[তথ্য সূত্র- বাংলাদেশ নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী, পৃষ্ঠা- ৫০-১৭০]
কক্সবাজারে চাকমা জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি কেবল ভৌগোলিক পথের জন্য নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মিলের কারণেও স্বাভাবিক। নাইক্ষ্যংছড়ির তংচঙ্গ্যা, আরাকানের চাকমা/তংচঙ্গ্যা/দৈংনাক ও কক্সবাজারের চাকমাদের মধ্যে ধর্মীয় রীতিনীতি, ভাষা, পোশাক, জীবনধারা, খাদ্যাভ্যাস এবং সামাজিক গঠনে বিস্তর মিল রয়েছে। তবুও নাইক্ষ্যংছড়ির জনগোষ্ঠী নিজেদেরকে তংচঙ্গ্যা বলে পরিচিতি দিলেও, তাদের অনেকের পূর্ব পুরুষ বা এনআইডিতে এখনো “চাকমা” টাইটেল বিদ্যমান। এজন্য হয়তো কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছেন:- “জাত্যভিমানের সারশূন্যতা”।
নামের ক্ষেত্রে আমাদের নামগুলো রাখাইন/মারমা কিংবা বর্মী রীতির অনুসরণে রাখা হয়। এর কারণ, ঐতিহাসিকভাবে আমাদের ধর্মীয় গুরু ও বিহারাধ্যক্ষরা ছিলেন রাখাইন সম্প্রদায়ভুক্ত। নবজাতকের নামকরণ সাধারণত তাদের হাতেই সম্পন্ন হতো ধর্মীয় বিধি অনুযায়ী। ফলে আমাদের নামগুলো রাখাইন বা বর্মী প্রভাব বহন করে। ধর্মীয় রীতিনীতি, সামাজিক উৎসব, পোশাক পরিচ্ছদ, সাংস্কৃতিক-ঐতিহ্যসহ ভাষাতেও একই রকম অনুপ্রবেশ দেখা যায়, যেমন- গ্রামকে “রোয়া”, গ্রাম্যপ্রধানকে “রোয়াজা” বলা ইত্যাদি।
পোশাকের ক্ষেত্রেও ঐতিহ্যগতভাবে আমাদের নিজস্ব পোশাক ছিল- পিনোন, পিনুই, খবং, খাদাং প্রভৃতি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা হারিয়ে গেছে। কারণ হিসেবে বলা যায়, সহজলভ্য ও সস্তা কাপড়ের প্রাপ্যতা এবং চাহিদা পরিবর্তন। যেমন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বলেছিলেন- “প্যাঁচায় জোটে না ত্যানা”।
ভাষা নিয়েও একটি বিভ্রান্তি দেখা যায়। কক্সবাজার ও নাইক্ষ্যংছড়ির (বর্তমান তংচঙ্গ্যা) চাকমাদের ভাষা বার্মার আরাকান রাজ্যের চাকমাদের ভাষার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা বা তংচঙ্গ্যাদের ভাষার সঙ্গে আমাদের ভাষায় বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্য ভূগোল, সময়, সংস্কৃতি ও সমাজ কাঠামোর কারণে সৃষ্টি হয়েছে, যা ভাষাবিজ্ঞানে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
বর্তমানে কক্সবাজারের চাকমা আদিবাসী সমাজে দৃশ্যমান পরিবর্তন হয়েছে। শিক্ষার হার বেড়েছে, নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে, সংস্কৃতি-ঐতিহ্যে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। আজ আমাদের সন্তানরা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, প্রশাসন, ব্যাংকিং, আইন, এনজিওসহ নানা পেশায় সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। ধর্মীয় গুরুদের মধ্যেও নিজের সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি দেখা যাচ্ছে। সবকিছু মিলে এক নতুন জাগরণ দেখা দিয়েছে কক্সবাজারের চাকমা সমাজে।
আমরা আশা করি, আগামী প্রজন্ম আরো সচেতন ও শিক্ষিত হয়ে আমাদের এই ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে সংরক্ষণ করবে এবং জাতিগত আত্মপরিচয়কে তুলে ধরবে নতুন প্রজন্মের কাছে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ভাষা যোগাযোগ ও সংস্কৃতি বিভাগ, গণ বিশ্ববিদ্যালয়।