সুপ্রীতি ধর
সবাই পলিটিক্যালি কারেক্ট থাকতে চায়। তাদের এই চাওয়াতে কোন অন্যায় দেখি না আমি। চাইতেই পারে। তারা বলতেই পারে যে ভিকটিমের কোন জাতপাত নেই, ধর্ম নেই। আসলেই কি তাই? কিন্তু প্রতিটি ঘটনার পেছনে যে অন্য একটা ‘পলিটিকস’ কাজ করে, সেটাও তো বুঝতে হবে। মূমুর্ষ রাষ্ট্র যখন তার সমস্ত নৈতিকতাবোধ থেকে সরে আসে, জনগণের, জানমালের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, তখন সেখানে এমন ধরনের অরাজকতাই বিরাজ করবে। এমনটাই হয়ে আসছে। সেখানে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে যাওয়া জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তার কথা বলা তো বাতুলতার সামিল। আর এসব আপনাদের উচ্চ বা মধ্যবিত্তীয় মস্তিষ্কেও কোন ছাপ ফেলবে না জানি।
‘ভ্যাজাইনা এন্ড পলিটিকস’ নিয়ে পশ্চিমে গবেষণা হচ্ছে। একটা দেশের রাজনীতিতে নারীর এই ভ্যাজাইনা বা যোনী যে কতোটা ভূমিকা রাখে, তা প্রতিটি রাষ্ট্রের নীতিমালা দেখলেই বোঝা যায়। কল্যাণমুখী রাষ্ট্রগুলো তাদের নীতিমালা নির্ধারণের সময় এই বিষয়টি মাথায় রাখে বলেই সেখানে নারীর পক্ষে অনেকটাই নিরাপদ জীবন কাটানো সম্ভব হয়। কিন্তু অকল্যাণমুখী বা পুরুষতান্ত্রিক পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্র এই ভ্যাজাইনার ওপরই তাদের কর্তৃত্ব ফলাতে চায়। নারীর জীবনে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনা পূর্বাপর পর্যালোচনা করলেই এই চিত্রটি স্পষ্ট হয়ে উঠে।
দেখুন, হিন্দু মেয়ে নির্যাতনের শিকার হলে, ধর্ষণের শিকার হলে বা খুন হলে যখন কেবল একটা নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের লোকজন প্রতিবাদে ফেটে পড়ে, আর সবাই ‘নির্বাণ’ লাভ করে, তখন একটু হলেও বোঝা যায় পার্থক্যটা মূলত কোথায়! একইভাবে কোন আদিবাসী মেয়েশিশু বা নারী যখন একের পর এক ধর্ষণ, গণধর্ষণের শিকার হয়ে ধুঁকে ধুঁকে জীবন পাড়ি দিচ্ছে, অথবা তাদের মেরেই ফেলা হচ্ছে, তখনো কিন্তু প্রতিবাদ ঠিক যেন জমে উঠে না, যতটা হয় সমতলের কোন ‘বিশেষ শ্রেণিভুক্ত’ কোন নারীর সাথে কিছু ঘটলে। কেউ একজন লিখেছেন যে, আজ যদি ঢাকার অভিজাত কুলের কোন নারীর সাথে এমনটি ঘটতো, তবে ফেসবুক সেলিব্রেটিরা কিবোর্ড কাঁপিয়ে ফেলতো, কথাটা একেবারেই মিথ্যা নয়। এই আমিই তো সব প্রতিবাদে সামিল হই না, স্বীকার করছি আমার অপরাধটুকু। কিন্তু এ আমার কোন গোত্রের প্রতি অন্ধ ভালবাসা থেকে নয়, সব ঘটনার প্রতিবাদ করা আজকাল হয়ে উঠে না। দীর্ঘ বছরের পর বছর ধরে আমরা ধর্ষণের প্রতিবাদে মাঠে আছি, এই নিয়ে কত লেখালেখি হচ্ছে, কিন্তু আদতে কোন ফল পাচ্ছি কি? যদি পেতামই ফল, তবে তো আজ ঐ আদিবাসী নারীটির এমন অবস্থা হতো না।
খবরে জানলাম, খাগড়াছড়ি জেলার সদর উপজেলার ১নং গোলাবাড়ি ইউনিয়ন সংলগ্ন বলপেয়ি আদাম নামক গ্রামে নিজ বাড়িতে ৯ জন সেটেলার বাঙালি কর্তৃক মানসিক প্রতিবন্ধী এক জুম্ম নারীকে গণধর্ষণ এবং বাড়ির মূল্যবান জিনিসপত্র লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাটি ঘটেছে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে। একদল মুসলিম সেটেলার দা-ছুরি সহ দেশীয় অস্ত্র-সস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তাদের বাড়ির দরজা ভেঙে প্রবেশ করে। প্রথমে মা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে মা ও অসুস্থ বাবাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে আলাদা একটি রুমে দরজা বন্ধ করে রাখে। পরে ঐ জুম্ম নারীটিকে গণধর্ষণ করে। ভিকটিম জানিয়েছেন, ধর্ষণকারী সেটেলারদের কারোর নাম জানা না থাকলেও তদের সবার চেহারা সে চেনে। তাদের প্রত্যেকের বাড়ি খাগড়াছড়ি সদরের গঞ্জপাড়ার বাসিন্দা।
একটা ছবি ভাইরাল হয়েছে ফেসবুকে। রক্তাক্ত একটি মেয়েকে ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে কোন আদিবাসী মা এবং বাবা। ছবিটি কালকের ঘটনার হতে পারে, নাও হতে পারে। কিন্তু এ ঘটনাটাও তো সত্যই। ছবিটি আগের হয়ে থাকলেও সেই মেয়েটি ধর্ষণের শিকারই হয়েছিল। পিছন থেকে যদি ছবিটি দেখি, তবে নিজেকেই দেখি যেন।
এই যে মেয়েটাকে তার মা ও বাবা কোন রকমে ধরে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, যার পেছনে রক্তের দাগ লেগে আছে, যার পায়জামার ফাঁক দিয়ে পা গড়িয়ে বেরিয়ে পড়ছে রক্তের ধারা, জানেন তো সেই মেয়েটা আমি?
হ্যাঁ আমিই। তুমিও সেই মেয়েটা। আপনিও সেই মেয়েটা।
কারণ আমার, তোমার এবং আপনার ভ্যাজাইনা আছে, আছে স্তনও, আমাদের নারীর শরীর, আমাদের ক্ষমতা কম, আমরা ভালনারেবল, আমাদের কাছে আমরাই নেই, তাই আমরা ভিকটিম।
সবচেয়ে বড় কথা এই মেয়েটার সাথে রক্তাক্ত একটা দেশ। যে দেশের কোন নীতিবোধ নেই, নারীর জন্য কোন আইনই কার্যকর হয় না এখানে, সব মুখ থমকে পড়ে থাকে, যেন নারী কোন মানুষই নয়। কেবলই অবয়ব মাত্র। যেন নারী কারও বোন নয়, মা নয়, স্ত্রী নয়, প্রেমিকা নয়!
সবাই বলো, কে রক্তাক্ত নও? কার যোনী অক্ষত? কার শরীর ও মন অক্ষত? এই ছবিটার সাথে একাত্তরে পাক বাহিনীর গণধর্ষণের শিকার হওয়া বোনের লাশ কোলে নিয়ে ভাইয়ের সেই ছবিটির মিল আছে কোথায় যেন! আমার কেন জানি এই ছবিটার দিকে তাকিয়ে নিজের নিচের অংশে ভারি অনুভব করছি, ব্যাথা অনুভব করছি। রক্তাক্ত লাগছে নিজেকে।
মেয়েরা আরো ভালনারেবল হয় তাদের শ্রেণি পরিচয়ে, তাদের সম্প্রদায়গত পরিচয়ে। তখন তাদের যোনী এবং স্তন আরো বেশি মোক্ষম অস্ত্র হয়ে উঠে শত্রুপক্ষের জন্য। পুরুষ সেখানেই আঘাত করতে চায়, এবং পারে। কারণ জানে, ঐ শ্রেণিগোষ্ঠীর পেছনে রাষ্ট্র থাকে না।
প্রতিবাদ আর কত জানাবো আমরা? আর কত মেয়ে এমন রক্তাক্ত হলে কারো টনক নড়বে? নড়বেও না জানি। পাহাড়ে বাঙালি সেটেলারদের কারা নিয়ে ‘ফিট’ করে রেখেছে? কোন বাহিনী সেখানে সার্বক্ষণিক নজরদারি করছে?
সমতলের বাসিন্দাদের বলি, এই যে নিয়মিতভাবে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে আপনাদের জন্য প্রমোদখানা তৈরী হচ্ছে একের পর এক, সেখানে গিয়ে তো আপনারাই গ্লাসে তরল ঢেলে মাস্তি করে আছেন। কখনো ভেবেছেন, সেই মাটিতে কতজন আদিবাসীর কান্না জমে আছে? তারা উচ্ছেদ হয়ে কোথায় যাচ্ছে? খবর রাখেন না। কারণ এসব খবরে আপনাদের মাস্তিতে ভাতা পড়বে। আপনার জানেন যে ঠিক কতোসংখ্যক আদিবাসী জমিবাড়ি হারিয়ে বিশ^জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে? কতজনের খবর রাখেন আপনারা? সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তো কথা বলবেন না, কিন্তু তারা যে রক্ষক হয়েও ভক্ষকের ভূমিকা পালন করছে, এইটুকু অন্তত স্বীকার করে যান। দেশের ভিতরে থাকা আদিবাসীরা কেউ মুখ খুলতে পারে না, তাদের পেছনে ফেউ লাগিয়ে রাখা হয়েছে। কী এক জীবন একেকজনের! নিজের দেশ বলতে কিছু নেই, নিরাপত্তা নেই, স্বাধীনতা নেই।
যে রাষ্ট্র নির্দিষ্ট ধর্মকে ধারণ করে, সেখানে অন্য ধর্মের মানুষেরা সংখ্যালঘু হয়, আর নারী হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সংখ্যালঘু জাতি, এটাকে কে না জানে! এই যে আমার আদিবাসী বোনকে, যে কিনা পর পর ভাই এবং বাবাকে হারিয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিল, গতরাতের ঘটনার পর তার অবস্থা কি হবে, তা ভাবতেও গা শিউরে উঠছে।
সূত্র: www.womenchapter.com