হিল ভয়েস, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, বান্দরবান: রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের পর তিন বছর অতিক্রান্ত হলো। কিন্তু চতুর্থ বছরে এসে দেখা যাচ্ছে, প্রত্যাবাসন না ঘটলেও ক্যাম্প থেকে কমে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা। গত তিন বছরে এরকম কমে গেছে রোহিঙ্গার জনসংখ্যা দুই লাখেরও বেশি। প্রতিদিনই বাড়ছে এ সংখ্যা। মিয়ানমারের রাখাইনে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট সহিংস ঘটনার পর ব্যাপক হারে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে। বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৬ জন। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে এই রোহিঙ্গাদের।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সমন্বিত ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি)। এদের সর্বশেষ হিসাব মতে, ৩৪টি ক্যাম্পে এখন রোহিঙ্গার সংখ্যা ৯ লাখ ৫ হাজার ৮২২ জন। এই হিসাবের মধ্যে রয়েছে ১৯৯১ সালে অনুপ্রবেশকারী ৩৪ হাজার রোহিঙ্গাও। বাকি দুই লাখের বেশি রোহিঙ্গা কোথায় গেছে, তা কারও জানা নেই। তবে সরকারি-বেসরকারি সব মহলই মনে করছে, এসব রোহিঙ্গা লোকালয়ে মিশে যাচ্ছে। তিন পার্বত্য জেলা, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে তারা।
মিয়ানমার সীমান্ত লাগোয়া দুর্গম এলাকা বান্দরবান জেলার নাইক্ষংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়ন। এই অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের আনাগোনা ৩ দশকে নানা কৌশলে গড়েছে বসতিও। তাদের এখন লক্ষ্য বাংলাদেশের নাগরিক হওয়া। ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজের কাছে গেলে মেলে ধরেন অসংখ্য রোহিঙ্গার নেয়া বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র। জানালেন তিনি নিজেই জব্দ করেছেন।
রেজু আমতলী এলাকার বাসিন্দা শামসুল আলমকে পিতা বানিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র বানিয়েছেন রোহিঙ্গা হামিদ হোসেন ও জাহিদ হোসেন। এ ঘটনায় হতবাক শামসুল জানান, এই নামে তার কোন ছেলে নেই। কিভাবে ভোটার হয়েছে প্রশ্নে শামসুল বলেন ‘কিভাবে ভোটার হয়েছে সেই সম্বন্ধে তার জানা নাই’।
একই এলাকার নুরুল ইসলাম দীর্ঘদিন ছিলেন দেশের বাইরে। এলাকায় এসে জানতে পারেন হামিদ হোসেন নামে এক রোহিঙ্গা তাকে পিতা সাজিয়ে সংগ্রহ করেছে জাতীয় পরিচয়পত্র। তিনিও জানান হামিদ নামে তার কোন ছেলে নেই।
আব্দুস সালাম মেয়েকে বিয়ে দেন রোহিঙ্গা যুবকের কাছে। তাই পিতা সাজিয়ে জামাইকে বানান বাংলাদেশের নাগরিক। অথচ তিনি পার্বত্য জেলায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হয়েও এই কাজটি করেন।
গোয়েন্দা সংস্থাসহ ১৪টি সংস্থার বৈঠকে অনুমোদন হলেই কেউ জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার কথা। প্রশ্ন উঠেছে, এত সংস্থার চোখে ধূলো দিয়ে কিভাবে পরিচয়পত্র তৈরি করলো তারা? নাক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাচনী কর্মকর্তা আবু জাফর সালেহ বলেন, বিশেষ কমিটির সভায় তারা সংযুক্ত দলিলাদি যাচাই-বাছাই করেন। যিনি ভোটার হবেন তার সাক্ষাৎকার নেন এবং জনপ্রতিনিধিদের মতামত নেন।
জাতীয় পরিচয়পত্র নেয়া ১৩ রোহিঙ্গাকে চিহ্নিত করে গত জুলাইয়ে পরিচয়পত্র বাতিলের নির্দেশ দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। কিন্তু অবাক করার বিষয় যে, দুইমাস পরও আইয়ুবুল হক নামে রোহিঙ্গার জাতীয় পরিচয়পত্র এখনো সার্ভারে রয়েছে।
উপজেলা নির্বাচনী কর্মকর্তা আবু জাফর সালেহকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, যেহেতু এই পরিচয়পত্র বাতিল না হওয়ার বিষয়টা এখন জানতে পেরেছেন, তাই তিনি তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানাবেন।
ঠিক কত রোহিঙ্গার কাছে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র রয়েছে, তার সঠিক হিসাব জানা যায়নি। অথচ রোহিঙ্গাদের ঠেকাতে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরিতে রয়েছে সরকারের কড়া নিয়মকানুুন। এখানকার বাসিন্দাদের জমা দিতে হয় জন্ম সনদ, বাবা-মার জাতীয় পরিচয়পত্র, চাচা বা ফুফুর জাতীয় পরিচয়পত্র, জমির দলিল, বিদ্যুৎ বা যে কোন বিলের কপি, হেডম্যান ও জনপ্রতিনিধির সনদ। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, এতকিছুর পরও রোহিঙ্গাদের হাতে উঠে যাচ্ছে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র।
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, ঘুমধুম ইউনিয়নে এখনো ৪০০ থেকে ৫০০ রোহিঙ্গা ভোটার রয়েছে। টাকার জোরেই স্থানীয় সিন্ডিকেট সবার চোখে ধূলো দিয়ে রোহিঙ্গাদের বানাচ্ছে বাংলাদেশের নাগরিক। এই চক্রে আছেন তথ্য সংগ্রহকারী, যাচাইকারী, সনাক্তকারী, এমনকি জনপ্রতিনিধিও।
এই সিন্ডিকেটের একজন স্থানীয় মেম্বার বাবুল কান্তি চাকমা। যিনি যাচাইকারী হিসেবে স্বাক্ষর করেছেন রোহিঙ্গাদের ভোটার ফর্মে। এখন তার দাবি স্কুল শিক্ষক সিরাজুল হকের চাপাচাপিতে স্বাক্ষর করেছেন তিনি।
আরেক যাচাইকারী ১নং ওয়ার্ডের মেম্বার আব্দুল গফুর। তারও দাবি আবেদনকারীকে না চিনেই স্কুল শিক্ষক সিরাজুলের অনুরোধে স্বাক্ষর করেছেন। স্থানীয় গ্রাম পুলিশ বদিউর রহমান, ভূয়া জন্মসনদের আবেদনে রয়েছে তার স্বাক্ষর। এখন তিনি কিছুই জানেন না।
স্কুল শিক্ষক সিরাজুলের দিকেই অভিযোগের আঙুল সবার। যিনি একজন যাচাইকারীও। উখিয়ার বাড়িতে গিয়ে পাওয়া যায়নি তাকে। পরে কক্সবাজার হোটেলে দেখা করতে আসেন, সাথে নিয়ে আনেন আত্মীয় পরিচয়ে এক স্থানীয় সাংবাদিক। সিরাজুল উল্টো সরকারি নথিপত্রকেই অস্বীকার করেন। হোটেল রুমের বাইরে আসলে অনৈতিক উপায়ে ধামাচাপা করার চেষ্টা করেন সিরাজুলের সাথে আসা ঐ সাংবাদিক।
রোহিঙ্গাদের ১৩টি জাতীয় পরিচয়পত্রের সন্ধান পাওয়ার পর ঐ সিন্ডিকেটকে খুঁজে বের করার নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। পাহাড়ে এমন কয়টি চক্র সক্রিয় রয়েছে, সেটি বলা খুবই মুশকিল। স্থানীয়রা বলছেন, এসব চক্রের হোতাদের আইনের আওতায় আনা না গেলে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার বিষয়টি ঠেকানো সম্ভব হবে না।
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নের বড়ছড়া পাড়া। সম্প্রতি এখানকার ঠিকানা ব্যবহার করে জন্ম সনদ নিয়েছেন জামাল উদ্দিন। অনুসন্ধানে জানা গেল, জামাল উদ্দিন সপরিবারে ভারতের উত্তর প্রদেশে বসবাস করছেন। সেখানে রাজনৈতিক সভা সমাবেশেও দেখা গেছে তাকে। পরিবারের সবার নামে আছে দেশটির রেশন কার্ডও। বান্দরবানের ঠিকানায় গিয়ে পাওয়া যায়নি তাকে। তবে স্থানীয়দের কথায় তার ভারতে বসবাসের প্রমাণ মিলেছে। বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র নেওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে আছেন জামাল উদ্দিন। সীমান্তে এভাবেই সবাই সংগ্রহ করছেন জাতীয় পরিচয়পত্র।
নাইক্ষ্যংছড়ির আদর্শ পাড়া গ্রামে বসবাস করছেন রোহিঙ্গা নারী জরিনা বেগম। জীবিত হলেও তার রয়েছে মৃত্যু সনদ। কারণ নিজের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই তাই মেয়েকে বাংলাদেশের নাগরিক বানাতে মৃত্যু সনদ দেখানোর বিকল্প নেই। একইভাবে ছেলেকে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে নিতে অর্থের বিনিময়ে মৃত্যু সনদ নিয়েছেন এই নারী।
নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নের ইসলামপুর ১নং ওয়ার্ডের ঠিকানায় জন্ম সনদ নিয়েছেন রোহিঙ্গা শাহ আলম এবং রেজওয়ানা আক্তার। কিন্তু একজনকেও পাওয়া যায়নি এলাকায় গিয়ে। কেউ তাদের চেনেও না। এসব জন্ম এবং মৃত্যু সনদে স্বাক্ষর আছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের। কিন্তু সদুত্তর নেই করো কাছে।
মা-বাবার জাতীয়তা মিয়ানমার লেখা এমন ব্যক্তিও পেয়ে গেছে জন্মসনদ, এমন মানুষের সংখ্যাও অনেক। এসব জন্মসনদে স্বাক্ষর করা সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান তোফায়েল আহমেদ দাবি করেন, সরকারের নির্দেশে এসব জন্ম ও মৃত্যু সনদে তিনি স্বাক্ষর করেছেন। অর্থাৎ নানা কারণে নানা কায়দা কৌশল করে এখানে নাগরিকত্ব পেয়ে যাচ্ছেন রোহিঙ্গারা।
অপরদিকে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী দক্ষিণপূর্ব জেলা বান্দরবান আর কক্সবাজার। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এই এলাকাতে নানা কৌশল আর জালিয়াতি করে বাংলাদেশের নাগরিক বনে গেছেন অসংখ্য রোহিঙ্গা। যাদের জন্মসনদ, মৃত্যুসনদ, জায়গার দলিল, ঠিকানা সবই ভূয়া। কিন্তু সব জেনেশুনেই এখানকার জনপ্রতিনিধিরাই তাদের নাগরিকত্ব পাওয়ার পথ দেখাচ্ছেন।
রোহিঙ্গাদের ভোটার করার পেছনে লুকিয়ে আছে নানা কারণ। জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, প্রতিনিয়ত আছে মোটা অংকের অর্থের প্রস্তাব। তাই কেউ কেউ দেশ বিরোধী কাজে জড়িয়ে পড়ছেন। ঘুমধুম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, শুধুমাত্র একটা জন্মনিবন্ধন আর একটা সার্টিফিকেটের জন্য তাকে এক লক্ষ টাকার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
অপরদিকে নাইক্ষ্যংছড়ি সদর মহিলা মেম্বার রাশেদা বেগমকেও একইভাবে ৬ জনে ৫ হাজার করে মোট ৩০ হাজার টাকার প্রস্তাব দেওয়া হয় বলে তিনি জানান।
গেল তিন দশকে এ অঞ্চলে জনপ্রতিনিধি বনে গেছেন অনেক রোহিঙ্গাও এমন তথ্য দিলেন সাবেক নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান তোফাইল আহমদ। তিনি আরো জানান, রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর লক্ষ্যে নির্বাচনী মাঠে অনুসারী বাড়াতে রোহিঙ্গাদের ভোটার বানাচ্ছেন কেউ কেউ। কেউ রাজী না হলে প্রাণনাশেরও হুমকি আছে বলে জানালেন নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল আবছার। অবস্থা এততাই ভয়াবহ যে, স্থানীয়রা পান না ভোটার ফর্ম, তা চলে যায় রোহিঙ্গাদের হাতে, জানালেন সদর নাইক্ষ্যংছড়ি মেম্বার ফয়েজ আহমদ।
সাবেক নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইকবাল দাবি করেন ভোটার বানাতে পাহাড়ি বাঙালি দ্বন্দ্বও কাজ করে এ অঞ্চলে। স্থানীয়রা বলছেন, এমন সময় আসতে পারে যখন পাহাড়িরা এই এলাকায় রোহিঙ্গাদেরই আধিপত্যে থাকতে বাধ্য হবে।
যমুনা টিভি ও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন এবং হিল ভয়েসের সরেজমিন তদন্তের ভিত্তিতে প্রস্তুতকৃত।