বাংলাদেশ আগমন উপলক্ষে জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রতি LVJ-এর খোলা চিঠি

হিল ভয়েস, ১৬ মার্চ ২০২৫, আন্তর্জাতিক ডেস্ক: বাংলাদেশ আগমন উপলক্ষে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের প্রতি খোলা চিঠি দিয়েছে ফ্রান্স ভিত্তিক জুম্ম প্রবাসীদের সংগঠন La Voix des Jummas। গত ১৩ মার্চ ২০২৫ La Voix des Jummas (LVJ)-এর ফেসবুক পেইজে এই চিঠিটি প্রকাশ করা হয়।

চিঠিতে বলা হয় যে, “রোহিঙ্গা সংকট পরিদর্শনের লক্ষ্যে আপনার চলমান বাংলাদেশ সফরকে আমরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী হিসেবে বিবেচনা করছি। মায়ানমারে নির্যাতিত ও বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রতি আপনার সংহতি এবং তাদের মানবাধিকার রক্ষায় আপনার ভূমিকা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।”

“তবে এই সুযোগে আমরা বাংলাদেশের আরেকটি প্রান্তে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জুম্ম আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পক্ষে আমাদের উদ্বেগ ও দাবিগুলো আপনার কাছে উপস্থাপন করতে চাই। যুগের পর যুগ ধরে আমরা আমাদের ভূমি, সংস্কৃতি, পরিচয় ও অধিকার রক্ষার লড়াই করে যাচ্ছি। দুঃখের বিষয়, এই জনগোষ্ঠীও নির্যাতন, বৈষম্য ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়ে আসছে।”

আমরা বিশ্বাস করি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ন্যায়ের কণ্ঠস্বর হিসেবে জাতিসংঘ এবং আপনার সুদৃঢ় নেতৃত্ব এই সংকট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের দাবিগুলো নিম্নরূপ:

১. পার্বত্য শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন:
১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি ছিল শান্তি ও ন্যায়ের পথে একটি বড় পদক্ষেপ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আজও এই চুক্তির অধিকাংশ মৌলিক ধারাগুলো বাস্তবায়ন হয়নি। আমরা শান্তিচুক্তির প্রতিটি ধারা দ্রুত ও পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন এবং ভূমি কমিশনের কার্যকর, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ ভূমিকা নিশ্চিত করা জোরালোভাবে দাবি করছি।

২. ভূমি অধিকার ও বাস্তুচ্যুত জনগণের পুনর্বাসন:
জুম্ম জনগণের ঐতিহ্যগত ভূমির অধিকারকে সম্মান ও সুরক্ষা দিতে হবে। এর পাশাপাশি ভূমি দখল, উচ্ছেদ ও বসতি স্থাপনের নামে বহিরাগতদের স্থানান্তর বন্ধ করতে হবে। জুম্মদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও নিরাপদ পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে।

৩. মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ ও বিচার নিশ্চিতকরণ:
পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন ধরে নিরাপত্তা বাহিনীর নামে যেসব নিপীড়ন, নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে চলেছে, তার অবসান প্রয়োজন: হত্যা, ধর্ষণ, গুম ও মিথ্যা মামলাসহ দমনমূলক সকল কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। সকল মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিরপেক্ষ তদন্ত এবং দোষীদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। অপ্রয়োজনীয় সামরিক উপস্থিতি কমিয়ে বেসামরিক প্রশাসনকে শক্তিশালী করতে হবে।

৪. সংস্কৃতি, ভাষা ও পরিচয়ের সাংবিধানিক স্বীকৃতি:
জুম্ম জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সুরক্ষা অপরিহার্য: -সাংবিধানিকভাবে জুম্মদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে স্বীকৃতি দিতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় আদিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

৫. স্বায়ত্তশাসন ও প্রশাসনিক ক্ষমতা বৃদ্ধি:
পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কার্যকর ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে: আঞ্চলিক পরিষদের সাথে সমন্বয়হীন প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। স্থানীয় জনগণের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

৬. উন্নয়ন কার্যক্রমে জুম্ম জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ:
পাহাড়ে উন্নয়ন হতে হবে জুম্ম জনগণের কল্যাণে, জনগণের মতামত ও অংশগ্রহণের ভিত্তিতে: পরিবেশ ও জনগণের স্বার্থ রক্ষা করে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। উন্নয়ন প্রকল্পে স্থানীয় জুম্ম জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

৭. জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণ ও মধ্যস্থতা:
পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকট নিরসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পর্যবেক্ষণ ও সহায়তা প্রয়োজন: জাতিসংঘের বিশেষ দূত বা মানবাধিকার পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা হোক। জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের মাধ্যমে নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনা করা হোক।

উক্ত খোলা চিঠিতে আরো বলা হয় যে, “পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম আদিবাসী জনগোষ্ঠী বহুদিন ধরে তাদের ন্যায্য অধিকার ও ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করে আসছে। আমরা বিশ্বাস করি, আপনার নেতৃত্বে জাতিসংঘ এই সংকট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।”

“আমরা আন্তরিকভাবে অনুরোধ করছি, আপনি পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতির প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেবেন এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই সংকটের শান্তিপূর্ণ ও টেকসই সমাধানের উদ্যোগ নেবেন।”

More From Author