আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে চবিতে পিসিপি’র উদ্যোগে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

হিল ভয়েস, ১০ মার্চ ২০২৫, চট্টগ্রাম: গতকাল ৯ মার্চ ২০২৫ খ্রিঃ (রবিবার) আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে “জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জুম্ম নারীর ভূমিকা ও প্রাসঙ্গিকতা” শীর্ষক এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভাটি আয়োজন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ২ নং গেইট শাখা। উল্লেখ্য, গত ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে এই আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত সভাটি গতকাল বিকেল ৪ ঘটিকায় শুরু হয়। এতে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি অন্বেষ চাকমা, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, চবি সংসদের সাংস্কৃতিক সম্পাদক জাল্লাং এনরিকো মারাক, পিসিপি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সুমন চাকমা, ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরাম, চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি ধন রঞ্জন ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সিং য়ই প্রু মারমা প্রমুখ।

পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, চবি ২ নং গেইট শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক প্রেনঙি ম্রো’র সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন পিসিপি, চবি ২ নং গেইট শাখার সভাপতি অপূর্ব চাকমা। উক্ত সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন পিসিপি, চবি ২ নং গেইট শাখার অর্থ সম্পাদক রিশন চাকমা।

অন্বেষ চাকমা বলেন, মানব সভ্যতায় ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখলে দেখা যায় মানুষের অগ্রগতিতে পুরুষ ও নারীদের ভূমিকা প্রায় সমান। নারীরাই সর্বপ্রথম কৃষি পদ্ধতি উদ্ভাবনের মাধ্যমে সমাজ বিকাশের গোড়াপত্তনে ভূমিকা রেখে গেছে। ইতিহাসের যুগে যুগে নারীরাই জাতীয় মুক্তির আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল। তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্মদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে জুম্ম নারীরা শুরু থেকেই ছিল। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ যে অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এখানে নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে দিনদিন সংকটময় হয়ে পড়ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেটেলার ও সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত ধর্ষণ ও নিপীড়ন থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম নারীরা অন্যতম ভুক্তভোগী। এই ঔপনিবেশিক শোষণ ও বিজাতীয় শাসন থেকে মুক্তির জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা খুবই জরুরি। যার জন্য নারী ও পুরুষ উভয়কে আন্দোলনে সমানতালে সামিল হওয়া জরুরি। দীর্ঘ দুই যুগের বেশি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মাধ্যমে জুম্মদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে।

জাল্লাং এনরিকো কুবি বলেন, আদিবাসী সমাজে নারীদের আগের বাস্তবতার সাথে এখনকার পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সকলের এগিয়ে আসা জরুরী। পাহাড় ও সমতলে আদিবাসী নারীদের সামাজিক নিরাপত্তা আগের চাইতে কম। শাসকগোষ্ঠী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকারকে কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। আমাদের অধিকার বিষয়ে সচেতন থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে অধিকারের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।

সুমন চাকমা বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে নারীদের প্রতি সহিংসতা বেড়েই চলেছে। সেই সাথে পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী নারীদের বাস্তবতা আরও কঠিন। জুম্ম সমাজে নারীরা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অন্যতম নিয়ামক ভূমিকা পালন করলেও সামাজিকভাবে জুম্ম নারীরা অনেক পিছিয়ে রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্মদের দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের ইতিহাসে জুম্ম নারীরা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। সামন্তীয় সমাজে পিছিয়ে থাকা নারীদের সচেতনতা ও সরাসরি জুম্মদের জাতীয় মুক্তির আন্দোলনে পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ছিল।

ধন রঞ্জন ত্রিপুরা বলেন, সমাজ বিকাশে নারীদের যে অবদান ছিল পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তা স্বীকার করতে চায় না। অথচ সমাজ বিকাশে পুরুষদের যেভাবে সংগ্রাম করতে হয়েছে নারীরা তার চেয়ে বহুগুণে সংগ্রাম করেছে। বর্তমান সমাজে নারীরা সাংসারিক কাজ থেকে শুরু করে কর্মজীবনে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। কিন্তু আধুনিকতার বাজারে নারীদের সৌন্দর্যকে পণ্যায়ন হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। যেটি নারীদের প্রতি বৈষম্য আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

সিং য়ই প্রু মারমা বলেন, নারীরা ঐতিহাসিকভাবে বঞ্চিত হয়ে আসছে। নারীরা স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার অধিকার হারিয়ে ফেলছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের দূর্বল ভাবা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে নারীরা পুরুষ আধিপত্য ও রাষ্ট্রের শাসকশ্রেণি দ্বারা প্রতিনিয়ত নিপীড়িত হচ্ছে। আমাদের সমাজব্যাবস্থায় নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এগিয়ে আসতে হবে।

স্বাগত বক্তব্যে রিশন চাকমা বলেন, বাংলাদেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে সরকার নারীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশে চারিদিকে নারীদের ধর্ষণ ও ধর্ষনের পরে হত্যার ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে যাচ্ছে। পাহাড়ে সেটেলার বাঙালিদের হাতে জুম্ম নারীদের প্রতি যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের মতো ঘটনা নতুন নয়। কিন্তু আমারদের সমাজে ধর্ষণ নামের কোনো শব্দই ছিলনা, ধর্ষণ ও নিপীড়নকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে জুম্ম জনগণকে জাতিগতভাবে নির্মূল করার ষড়যন্ত্র চলমান রেখেছে শাসকগোষ্ঠী।

সভাপতির বক্তব্যে অপূর্ব চাকমা বলেন, সমাজ গঠনে নারীদের ভূমিকা ইতিহাসে আমরা যেমন দেখতে পাই, ঠিক একইভাবে অধিকার আদায়ের লড়াই সংগ্রামেও নারীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। এম এন লারমারা পার্বত্য চট্টগ্রামে সামন্তীয় ঘুণেধরা সমাজে শিক্ষা বিস্তার থেকে শুরু করে জুম্ম জাতীয় জাগরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করার পাশাপাশি তারা নারীদের জাগরণে অবদান রাখেন। জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নারীদের অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়বোধ থেকেই আমাদের শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মকে নারী অধিকার নিয়ে সোচ্চার হতে হবে। তিনি জুম্মদের অধিকার আদায়ের সনদ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের বৃহত্তর আন্দোলনে পুরুষের পাশাপাশি জুম্ম নারীদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

সভাপতির বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আয়োজিত আলোচনা সভার সমাপ্তি ঘটে।

More From Author