হিল ভয়েস, ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, রাঙ্গামাটি: আজ ১৬ জানুয়ারী ২০২৫ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার মতিঝিলে আদিবাসী ছাত্র জনতার এনসিটিবি ভবন ঘেরাও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি নামক উগ্র সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠী কর্তৃক সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদে এবং অবিলম্বে দোষীদের গ্রেফতার পূর্বক যথাযথ বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ এবং ন্যায় বিচারের দাবিতে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি পেশ করেছে রাঙ্গামাটির সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র জনতা।
বিক্ষোভ মিছিলটি রাঙ্গামাটির কুমার সমিত রায় জিমনেসিয়াম প্রাঙ্গণ থেকে শুরু হয়ে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ ঘুরে এসে আবার কুমার সমিত রায় জিমনেসিয়াম প্রাঙ্গণে এসে শেষ হয় এবং সেখানে বিক্ষোভ মিছিল পরবর্তী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে সংহতি বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল, রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সদস্য উজাই মারমা, বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার ফোরামের রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সদস্য সবুজ তঞ্চঙ্গ্যা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি শান্তিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক রুমেন চাকমা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতি, রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সভাপতি সুমিত্র চাকমা। সমাবেশটি সঞ্চালনা করেন বিএমএসসি, রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সদস্য ক্যচিংনু মারমা এবং সভাপতিত্ব করেন রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থী সুজন চাকমা।
সংহতি বক্তব্যে উজাই মারমা বলেন, আমরা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন দেখিনি, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান দেখিনি, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি কিন্তু চব্বিশের স্বৈরাচার বিরোধী গণঅভ্যুত্থান দেখেছি। স্বৈরাচারের পতন ঘটেছে। আমরা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু আদিবাসীদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। ঢাকায় আদিবাসী ছাত্র জনতার শান্তিপূর্ণ কর্মসূচীতে উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী হামলা করেছে। যা আমাদের ব্যথিত করেছে। ঢাকার বুকে প্রশাসনের ছত্রছায়ায় এরকম ন্যাক্কারজনক হামলার ঘটনা পূর্ববর্তী সময়ের সাথে কোনো পার্থক্য নেই। বিগত সময়ের সরকারের ন্যায় আমাদের আদিবাসীদের উপর নিপীড়ন-নির্যাতন চলছে।
সবুজ তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, গতকাল আমাদের আদিবাসী ভাই-বোনেরা তাদের দাবি জানাতে গিয়েছিল, অধিকার আদায়ের জন্য শান্তিপূর্ণভাবে এনসিটিবি ভবন ঘেরাও কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে প্রশাসনের নাকের ডগায় উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী তাদের উপর নির্মমভাবে হামলা করেছে। ঘটনার সুষ্ঠু বিচারের নিশ্চয়তা আমরা এখনো দেখতে পাচ্ছি না। আপনারা মায়ানমারের কথা বলেন, ফিলিস্তিনের কথা বলেন, কিন্তু আপনার নিজের দেশে যে আদিবাসী, সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীরা প্রতিনিয়ত নিপীড়িত-নির্যাতিত সে কথা বেমালুম ভুলে যান। আমরা আদিবাসী ছাত্র সমাজ বলতে চাই, যতদিন এই অন্যায়-অবিচার চলমান থাকবে ততদিন আমরা অধিক থেকে অধিকতর আন্দোলন চালিয়ে যাবো।
শান্তি দেবী তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের উগ্র সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী সেটেলার গোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত সন্ত্রাসী সংগঠন স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টির কথায় একতরফাভাবে এনসিটিবি আদিবাসী শব্দযুক্ত গ্রাফিতি বাতিল করেছে। এর মাধ্যমে আমাদের কাছে স্পষ্টভাবে প্রতিয়মান হয় এনসিটিবি কিংবা ইউনুস সরকারের সক্ষমতা কতদূর। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা ইউনুস তার ভাষণে আদিবাসী শব্দটি উচ্চারণ করেছিলেন। আমরা কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হয়েছিলাম। কিন্তু তার সরকারের দুই-তিন মাস যেতে না যেতেই পূর্বের ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলের চাইতেও আদিবাসীদের উপর নির্মম অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমরা প্রতিরোধ গড়তে জানিনা। আমরা জুম্ম আদিবাসী ছাত্র জনতা তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সদা প্রস্তুত।
পিসিপির সাধারণ সম্পাদক রুমেন চাকমা বলেন, আজকে এমন একটা সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা প্রতিবাদ করছি যে সময়ে আমরা নিজেদের পরিচয় দিতে পারছি না। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের যে স্পিরিট ছিল তারই প্রেক্ষিতে আমরা পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীরা নিরাপদে থাকবো, শান্তিতে থাকবো, আমাদের আত্মপরিচয় ও আত্মমর্যাদা সুনিশ্চিত হবে এই আশা করেছিলাম। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের পর পরই খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে সেটেলার বাঙালি কর্তৃক সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে। প্রকাশ্যে চারজনকে হত্যা করা হয়েছে। যার বিচার এখনো হয়নি। এরই মধ্যে গতকাল ঢাকায় আদিবাসী ছাত্র জনতার শান্তিপূর্ণ মিছিলে উগ্রবাদী গোষ্ঠীর হামলা হয়েছে। আমাদের উপর এই দমন-পীড়ন, শোষণ-বঞ্চনা, নির্যাতন আর কতকাল চলবে? দেশে সরকার পরিবর্তন হয় কিন্তু আমাদের ভাগ্য পরিবর্তন হয়না। কোনো সরকার উদারতা দেখাতে পারে না।
তিনি আরো বলেন, আদিবাসী জনগণের উপড় যতদিন নিপীড়ন চলমান থাকবে ততদিন বাংলাদেশ বহুজাতির দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। আমরা নিজেদের আত্মপরিচয় ও অধিকারের জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলবো। অধিকারের প্রশ্নে কোনো আপোষ চলবে না। আদিবাসী ছাত্র সমাজ লড়াই জারি রাখবে। আদিবাসী ছাত্র সমাজ অস্তিত্বের তরে ভবিষ্যতে বনে-জঙ্গলে, রাজপথে যখন যেখানে দরকার সেখানে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলবে।
সমাবেশ শেষে ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি পেশ করেন।স্মারকলিপিতে সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্রজনতার পক্ষ থেকে সরকারের কাছে ৫ টি দাবি উত্থাপন করা হয়। নিম্নে তা তুলে ধরা হল।
১. সংক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্রজনতার শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে নৃশংস হামলার সাথে জড়িতদের অবিলম্বে আইনের আওতায় আনা।
২. হামলায় আহতদের চিকিৎসার যাবতীয় ব্যয়ভার সরকার কর্তৃক বহন করা।
৩. পাঠ্যপুস্তক থেকে বাতিলকৃত জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের গ্রাফিতি পুনর্বহাল করা।
৪. আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাথে আলোচনা সাপেক্ষে পাঠ্যপুস্তকে আদিবাসী জাতিসমূহের সঠিক ইতিহাস ও পরিচিতি তুলে ধরা।
৫. সংবিধানে সকল আদিবাসী জাতিসমূহের স্বীকৃতি দিতে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা।