পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফিরে আসেনি: আগরতলা আলোচনা সভার বক্তারা

হিল ভয়েস, ২ ডিসেম্বর ২০২৪, আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিব পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো শান্তি ফিরে আসেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা ভূমি হারাচ্ছে। তারা প্রতিনিয়ত নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

আজ সোমবার (২ ডিসেম্বর) ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলার প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আলোকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ (হিউম্যান রাইটস সিচুয়েশন অব দ্য মাইনরিটিস ইন বাংলাদেশ: ইন দ্য লাইট অব দ্য চিটাগং হিলট্র্যাক্টস অ্যাকর্ড) শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা উপরোক্ত মতামত তুলে ধরেছেন।

মানবাধিকার সংগঠন ‘ক্যাম্পেইন ফর হিউম্যানিটি প্রটেকশন’ এর উদ্যোগে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’র ২৭তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত উক্ত আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি এবং বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিক নিরঞ্জন চাকমা। এতে অতিথি হিসেবে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন বিশিষ্ট আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী পুরুষোত্তম রায় বর্মণ, প্রবীণ সাংবাদিক স্রোতরঞ্জন খীসা, বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সমাজসেবক অজিত দেববর্মা, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও নর্থ ইস্ট কালারের সম্পাদক সঞ্জীব দেব, ইন্টারন্যাশনাল চাকমা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা প্রগতি চাকমা, বিশিষ্ট সাহিত্যক ও সমাজসেবক গৌতম মগ। আলোচনা সভায় সঞ্চালনা করেন ক্যাম্পেইন ফর হিউম্যানিটি প্রটেকশনের সদস্য প্রিয়লাল চাকমা।

আলোচনা সভায় বিশিষ্ট আইনজীবী পুরুষোত্তম রায় বর্মণ বলেন, পার্বত্য শান্তিচুক্তির সঠিক রূপায়নের প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পার্বত্য চট্টগ্রামের যারা মূল অধিবাসী, যারা বাংলাদেশের মধ্যে সংখ্যালঘু মানুষ, তাদের অধিকার সুরক্ষার লক্ষে পার্বত্য শান্তিচুক্তির সঠিক রূপায়ন করা অত্যন্ত জরুরি। সংখ্যালঘুদের অধিকার, যেখানে সংখ্যালঘুরা থাকুক না কেন, সেটা বাংলাদেশে হতে পারে, সেটা চীন হতে পারে, সেটা ভারতবর্ষ হতে পারে, যেমন ভাষিক সংখ্যালঘু, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, তাদের যে অধিকার সেই অধিকারকে সুরক্ষিত করা, সেই অধিকার যাতে বিপন্ন না হয়, সেটা দেখা সবার দায়িত্ব।

তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা বা অন্যান্য সংখ্যালঘুরা, তারাই শুধুমাত্র তাদের অধিকারের প্রশ্নে, তাদের ভূমি রক্ষার প্রশ্নে, তাদের সংস্কৃতি রক্ষার প্রশ্নে আন্দোলন করবেন তা নয়, তাদের লড়াইয়ের পাশে আমাদেরও থাকতে হবে- এটিই হচ্ছে সহমর্মিতা। সহমর্মিতাই আমাদের মূলকথা। যে কোনো সমাজে, যে কোনো রাষ্ট্রে, যে কোনো দেশে সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষা রাষ্ট্রের ও সমাজের সকলের দায়িত্ব আছে। মানবাধিকার সুরক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা করা। সংখ্যালঘুদের নিজেদের পরিচয় ও অধিকার নিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচার অধিকার মানবাধিকার সনদে স্বীকৃত রয়েছে। পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের দায়িত্ব, সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষার দায়িত্ব বাংলাদেশ রাষ্ট্রকেই নিতে হবে, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ট জনগোষ্ঠীকেই নিতে হবে।

বিশিষ্ট সাহিত্যিক অজিত দেববর্মা বলেন, বাংলাদেশে ৬৪ টি জেলার মধ্যে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান এই তিনটি জেলা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম। ১৯৭৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি জনগোষ্ঠী ছিল ১১.৪%, ১৯৮১ সালে ৪১% আর ১৯৯১ সালে তা ৫৪.৫%। তাহলে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে অস্বাভাবিক কিছু হচ্ছে তা আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি। পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা জনগোষ্ঠীসহ ১২টি জনগোষ্ঠীসমূহ মোগল যুগ, ব্রিটিশ যুগ, পাকিস্তানের যুগ এবং স্বাধীন বাংলাদেশে বর্তমানে যে অবস্থায় আছে সেটি খুবই দু:খজনক।

তিনি বলেন, পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের সাথে জনসংহতি সমিতির ঐতিহাসিক চুক্তি হল কিন্তু বাস্তবায়ন হলো না। তাহলে চুক্তির স্বার্থকতা সেখানে কোথায়? ঐতিহ্যগতভাবে যে ভূমি, যে বনাঞ্চল অত্র এলাকার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ছিল দিনে দিনে সে ভূমি তারা হারাচ্ছে এবং সেটা পরিকল্পিতভাবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় করা হচ্ছে।

নর্থ ইস্ট কালারের সম্পাদক সঞ্জীব দেব বলেন, ধর্মের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রামে ৯৭ ভাগ অমুসলিম থাকা সত্ত্বেও পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়। এটা ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীর সাথে চরম অন্যায় কাজ। ভারতীয় নেতৃত্বে যারা ছিলেন তারা এটিকে গুরুত্ব না দেওয়ার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীর ভাগ্যে আজ চরম কালো দিন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৮০ দশকে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান প্রায় ৫ লক্ষ বাঙালিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসন করেন। এর ফলে সেখানকার স্থানীয় অধিবাসী যারা যুগ যুগ ধরে সেখানে বসবাস করে আসছেন তাদের জমি, অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার একটা প্রক্রিয়া শুরু হলো। ফলে সেখানে স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে সেটেলার বাঙালিদের একটা দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হলো।

তিনি আরো বলেন, পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যে চুক্তিটি শান্তিচুক্তি নামে পরিচিত। এই চুক্তির ফলে সবাই ধরে নিয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, বিগত ২৭ বছরেও সরকার সেই চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন না করার ফলে ঐ এলাকায় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা পায়নি।

বিশিষ্ট সাহিত্যিক গৌতম মগ বলেন, ২৬টি বৈঠকের পর বাংলাদেশ সরকারের সাথে ১৯৯৭ সালে ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিটি স্বাক্ষর করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার সিংহ ভাগ বাস্তবায়ন হয়েছে বলে দাবি করলেও বাস্তবে বিগত ২৭ বছরেও এই চুক্তিটির মূল ধারাগুলো এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিবেশী হিসেবে আমরা ত্রিপুরা রাজ্যবাসী এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই। একই সাথে পার্বত্য চুক্তিটি পূর্ণ বাস্তবায়নের জোর দাবি জানাই।

তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম সবসময় নিপীড়ন ও নির্যাতনের একটা জায়গা আমরা জানি। পার্বত্য চট্টগ্রাম সহ সারা বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর যে অত্যাচার, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ধর্ষণ, ধর্মান্তর ইত্যাদি করা হচ্ছে আমরা এর বিরুদ্ধেও তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।

সভাপতির বক্তব্যে বিশিষ্ট কবি ও লেখক নিরঞ্জন চাকমা বলেন, ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের সাথে জনসংহতি সমিতির যে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল, আজকে সেই চুক্তির ২৭তম বর্ষপূর্তি। ২৭ বছরেও সেই শান্তিচুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে মূল মূল ধারাগুলি, সেখানে শান্তি স্থাপনের ক্ষেত্রে যেগুলি অত্যন্ত জরুরি সেগুলি বাস্তবায়নে এখনো হাত দেওয়াই হয়নি। যেমন ভূমি কমিশন গঠন হয়েছে বটে, কিন্তু ভূমি কমিশন ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির কাজ শুরুই করতে পারেনি। তাহলে এর কোনো মানে আছে?

তিনি আরো বলেন, এই চুক্তির ফলে জাতিসংঘ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ভারত সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা অত্যন্ত খুশি হয়েছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ইউনেস্কো শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু হাসিনা সরকার চুক্তির মূল বিষয়গুলোও কিছুই বাস্তবায়ন করেনি। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অস্থায়ী ক্যাম্পগুলো প্রত্যাহার করার কথা, জিয়াউর রহমানের আমলে পুনর্বাসিত ৪ লাখ সেটেলারকে সরিয়ে নেওয়ার কথা, কিন্তু শেখ হাসিনা সরকার এসব কিছুই করেননি। ২৭ বছরেও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। চুক্তি অনুযায়ী বিভিন্ন আইন সংশোধন করার কথা, কিন্তু কিছুই করা হয়নি।

আলোচনা সভায় রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে আদিবাসী জনজাতির নারী-পুরুষ অংশগ্রহণ করেন।

More From Author