১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বর্তমান অবস্থা: ১৩তম পর্ব (শেষ পর্ব)

হিল ভয়েস, ২ ডিসেম্বর ২০২৪, বিশেষ প্রতিবেদক:

পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতি

পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে সম্পাদিত ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৭ বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। কিন্তু ২৭ বছরেও পার্বত্য চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে পার্বত্য চুক্তির মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান অর্জিত হয়নি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের পরিবর্তে একের পর এক সরকার ধীরে ধীরে চুক্তি-পূর্ব শাসকগোষ্ঠীর মতো ব্যাপক সামরিকায়নের মাধ্যমে জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে চলমান পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনকে দমন করার ষড়যন্ত্র জোরদার করতে থাকে, যা শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছে। চুক্তি-পূর্ব অবস্থার মতো অত্যন্ত সুক্ষ্মভাবে বহিরাগত মুসলিম বসতি প্রদান, জুম্মদেরকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরকরণ, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহায়তায় মুসলিম সেটেলার কর্তৃক জুম্মদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা ও গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া, ভূমি বেদখল ও ভূমি থেকে উচ্ছেদ, জুম্ম নারী ধর্ষণ ও অপহরণ, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনরত জনসংহতি সমিতির সদস্য ও সমর্থকদেরকে ‘সন্ত্রাসী’ তকমা দিয়ে অপরাধীকরণ ইত্যাদি জাতিগত নির্মূলীকরণের সকল কার্যক্রম জোরদার হয়ে উঠে।

শাসকগোষ্ঠী কেবল এধরনের চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রমের মধ্যেই ক্ষান্ত থাকেনি, ‘ভাগ করো শাসন করো’ উপনিবেশিক নীতির ভিত্তিতে সেনাবাহিনী জুম্ম জাতিগোষ্ঠীর কতিপয় সুবিধাবাদী ও উশৃঙ্খল ব্যক্তিদের নিয়ে একের পর সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ গঠন করে দিয়ে এবং তাদেরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন তথা জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের জন্য জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে জুম্ম জনগণের চলমান আন্দোলনের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে চলেছে। সেনাবাহিনী কর্তৃক পৃষ্টপোষকতা ও আশ্রয় প্রদানকারী ইউপিডিএফ, সংস্কারপন্থী খ্যাত জেএসএস, ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), মগপার্টি- এর পর সর্বশেষ সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ হচ্ছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ), যা বম পার্টি নামে সমধিক পরিচিত।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার নীলনকশা বাস্তবায়নের হীনউদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন না করে উন্নয়নের দোহাই দিয়ে ঠেগামুখে স্থল বন্দর স্থাপন, ঠেগামুখ-চট্টগ্রাম বন্দর সংযোগ সড়ক ও সীমান্ত সড়ক নির্মাণ, সেনাবাহিনী কর্তৃক বিলাসবহুল পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন, রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা, যত্রতত্র বিজিবির বিওপি স্থাপন, কাচলং-সীতা পাহাড় ভূ-গঠনে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন ইত্যাদি কার্যক্রমের মাধ্যমে জুম্মদেরকে তাদের চিরায়ত ভিটেমাটি থেকে চিরতরে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র চলছে। রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজসহ তথাকথিত বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম জুম্ম জনগণের বিরোধিতা সত্ত্বেও সরকার রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে জোরপূর্বক বাস্তবায়ন করে চলেছে যার মূল লক্ষ্য হলো এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামে জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী ও চুক্তি-বিরোধী এক একটি রাজনৈতিক কেন্দ্র স্থাপন করা।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে জুম্ম জনগণের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে নস্যাৎ করার হীনউদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা-বিজিবি-পুলিশ ও ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও সহযোগী সংগঠনের সদস্য ও সমর্থকসহ সাধারণ জুম্ম গ্রামবাসীর উপর নিপীড়ন-নির্যাতন সীমাহীন মাত্রায় জোরদার হয়েছে। বিশেষ করে সেনা-বিজিবি-পুলিশ কর্তৃক জনসংহতি সমিতির অফিস তল্লাশী ও ভাঙচুর, সমিতির সদস্য ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের ও গ্রেফতার, তাদের ঘরবাড়ি তল্লাসী ও তছনছ, জনসংহতি সমিতি ও সমিতির সহযোগী সংগঠনের সদস্যদের তালিকা ও তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে ত্রাস সৃষ্টি করা ইত্যাদি দমন-পীড়ন চালানো হচ্ছে।

বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রামের অমুসলিম জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই। দীর্ঘ আড়াই দশক ধরে রক্ত-পিচ্ছিল সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পার্বত্যবাসীর অধিকার সনদ এই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অর্জিত হয়েছে। এই চুক্তিকে বাস্তবায়িত না করার যে কোন ষড়যন্ত্র এবং জুম্ম জনগণের এই চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনকে ফ্যাসীবাদী কায়দায় দমন-পীড়নের যে কোন চক্রান্ত দেশের বৃহত্তর স্বার্থে কখনোই শুভ ফল বয়ে আনতে পারে না।

পার্বত্য চুক্তির যথাযথ, পূর্ণাঙ্গ ও দ্রুত বাস্তবায়নের মাধ্যমেই কেবল পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার টেকসই সমাধান হতে পারে এবং অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার বাংলাদেশের শাসকশ্রেণির বহুমুখী ষড়যন্ত্রকে বানচাল করে দেয়া যেতে পারে। জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে জুম্ম জনগণ বৃহত্তর প্রতিরোধ আন্দোলনের মাধ্যমে শাসকগোষ্ঠীর এসব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে বদ্ধপরিকর। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন তথা জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে বৃহত্তর আন্দোলন জোরদার করা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই বলে বিবেচনা করা যায়।

More From Author