হিল ভয়েস, ১ ডিসেম্বর ২০২৪, ঢাকা: সকল প্রকার ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে বৃহত্তর আন্দোলন জোরদার করার আহ্বান জানিয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৭তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ঢাকায় আয়োজিত এক আলোচনা সভায় উপস্থিত বক্তাগণ।
আজ (১ ডিসেম্বর) পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এবং বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের যৌথ উদ্যোগে রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে অবস্থিত উইমেন্স ভলান্টিয়ারি এসোসিয়েশন মিলনায়তনে উক্ত আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহসভাপতি অজয় এ মৃ’র সভাপতিত্বে ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সদস্য ত্রিজিনাদ চাকমার সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন কবি ও সাংবাদিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সোহরাব হোসেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী অধ্যাপক ড. খাইরুল ইসলাম চৌধুরী, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সম্পাদক ডা. সাজেদুল হক রুবেল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ড. স্নিগ্ধা রেজওয়ানা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ-সাধারণ সম্পাদক ডা. গজেন্দ্রনাথ মাহাতো, জনউদ্যোগ জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব তারেক হোসেন মিঠুন, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির স্টাফ সদস্য মনিরা ত্রিপুরা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি নিপন ত্রিপুরা ও বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সভাপতি আন্টনী রেমা।
স্বাগত বক্তব্যে মনিরা ত্রিপুরা বলেন, যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এবং বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে চুক্তি হয়েছিল, সে চুক্তি দীর্ঘ ২৭ বছর পূরণ হলেও এখনো বাস্তবায়ন না হওয়ায় পার্বত্যবাসীর মনে হতাশার জন্ম দিয়েছে। তিনি অবিলম্বে সময়সূচি ভিত্তিক পার্বত্য চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের আহ্বান জানান।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. খাইরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ২৭ বছর পূর্ণ হলেও পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন করা হয়নি। রাষ্ট্রের সাথে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর যে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল তার একটি ইতিহাস রয়েছে। অনেক আশা নিয়ে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, কিন্তু এই আশা আজ হতাশায় পর্যবসিত হয়েছে। তিনি তার বক্তব্য আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে কেন সামরিক শাসন জারি রাখতে হবে? সেই সেনা শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে আমরা ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন’ নামে একটি প্লাটফর্ম গড়ে তুলেছি। বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের সংবিধান সংস্কার কমিশনে আদিবাসীদের মধ্যে কাউকে রাখা হয়নি, তাহলে আদিবাসীদের ভবিষ্যৎ কী হবে তা সকলের অজানা।
আদিবাসী ফোরামের সহ সাধারণ সম্পাদক ডা. গজেন্দ্রনাথ মাহাতো বলেন, ১৯৬২ সাল থেকে আদিবাসীদের উপর চরম, নির্যাতন ও শোষণ শুরু হয়েছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১০টি সংস্কার কমিশন গঠন করলেও আদিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। সংবিধান সংস্কার কমিশনে আমাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব রাখা হয়নি। বাংলাদেশের আদিবাসীদের সব সময় পিছিয়ে রাখা হয়। বর্তমানে বিনোদনের নামে, পর্যটনের নামে পাহাড়ে এবং সমতলে আদিবাসীদের ভূমি বেদখল করা হচ্ছে। ফলে আদিবাসীরা দিনকে দিন অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি নিপন ত্রিপুরা বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আগামী ৮ তারিখ ৪ মাস পূর্ণ হতে চলছে এবং ১০টি সংস্কার কমিশন হয়েছে। কিন্তু এ সংস্কার কমিশনে আদিবাসী এবং অমুসলিম কোনো প্রতিনিধি রাখা হয়নি।’ তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের ডমিনেন্ট কালচার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। সমস্যা নিরসনের জন্য তিনি পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আহ্বান জানান।
তিনি তার বক্তব্যে আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যুতে রাষ্ট্রের কোনো পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায় না। বরং আজকে পাহাড় এবং সমতলের আদিবাসীরা বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী ট্যাগ দেওয়া হয়, যা খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহের বিধিমালায় পাহাড়ী কতজন ও বাঙালী কতজন সদস্য হবেন তা লেখা আছে। তাহলে সেটেলাররা কেন সেখানে সমঅধিকার পাওয়ার জন্য অন্যায্য দাবি জানায়? এর মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি, পাহাড়ে ষড়যন্ত্রের কোনো শেষ নেই। ন্যায্যতার ভিত্তিতে আমরা অধিকার চাই। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার কথা বলা হলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে রাজনৈতিকভাবে সমাধান না করলে বাংলাদেশ বৈষম্যমুক্ত হবে না।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আদিবাসী যুব ফোরামের সভাপতি আন্টনি রেমা বলেন, ব্রিটিশ আমলে বাঙালীদের আগে আদিবাসীরাই শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। আমরা সবাই সাঁওতাল বিদ্রোহের কথা জানি। পাকিস্তান শাসনামলে পাহাড়ে কাপ্তাই বাঁধ দেওয়ার মাধ্যমে সেখানকার আদিবাসীদের অস্তিত্বকে চরম সংকটময় পরিস্থিতিতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। ঠিক তেমনি ওই সময় থেকে সমতলের আদিবাসীদের উপর চরম অত্যাচারের গল্প শুরু হয়েছে।
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আদিবাসীরা মুক্তির স্বপ্ন দেখলেও বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের পর আদিবাসীরা স্বাধীনতার বদলে পেয়েছে অত্যাচার, নির্যাতন। অথচ মুক্তিযুদ্ধে বাঙালীদের পাশাপাশি আদিবাসীরাও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিল মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে বাংলাদেশের মানুষ শান্তিচুক্তি নামে জানলেও সেই শান্তি পাহাড়ে আজও ফেরেনি চুক্তির শতভাগ বাস্তবায়ন না হওয়ার ফলে।
জনউদ্যোগ জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব তারেক হোসেন মিঠুন বলেন, পাহাড়ে ৩-৪ মাইল হেঁটে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেতে হয়। যেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভালো শিক্ষা ব্যবস্থা নেই, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় করে পাহাড়ের মানুষজন কিভাবে উপকৃত হবে? ২রা ডিসেম্বর এখন শান্তির বদলে ক্ষোভের উৎসবে পরিণত হচ্ছে। কেননা, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে পাহাড়ের মানুষ যে আশা নিয়ে পার্বত্য চুক্তি করেছে তা বর্তমানে ভুলুন্ঠিত হচ্ছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার না করার জন্য আমাদের চিঠি দেওয়া হয়! আদিবাসীদের নিজ ভাষায় শিক্ষা গ্রহণের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। আদিবাসীদের যে ৫টি ভাষায় মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থাটা সীমিত আকারে চালু করা হয়েছিল তাও যোগ্য শিক্ষকের অভাবে এখন নড়বড়ে অবস্থা। পাশাপাশি তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বদিচ্ছার কথা ব্যক্ত করেন।
সিপিবির কেন্দ্রীয় সম্পাদক ডা. সাজেদুল হক রুবেল বলেন, পাহাড়ের মানুষ আশা করেছিল পার্বত্য চুক্তির ফলে শান্তি আসবে। কিন্তু সেই আশা এখন নিরাশায় পরিণত হচ্ছে। জুলাই অভ্ত্থুানের পর গণতন্ত্র ফিরে পাওয়ার আকাক্সক্ষার জন্ম হলেও সেটি ফিকে হয়ে যাচ্ছে। ফলে পার্বত্যবাসীর অধিকার পাওয়ার অধিকার পাওয়ার বিষয়টি জটিল হয়ে যাচ্ছে। বস্তুত ডিভাইড এন্ড রুলস পলিসির মাধ্যমে পাহাড়ে সেনাশাসন জারি রাখা হয়েছে। আঞ্চলিক পরিষদকে টুটো জগন্নাথ করে রাখা হয়েছে এবং ভূমি কমিশনকেও অথর্ব করে রাখা হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী পাহাড়ের আদিবাসী শরণার্থীদের এখনও যথাযথ মর্যাদায় পুনর্বাসন করা হয়নি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষিকা ড.স্নিগ্ধা রেজওয়ানা তার বক্তব্যে বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যে দশটি কমিশন রাখা হয়েছে সেখানে আদিবাসীদের জন্য পৃথক কোনো কমিশন রাখা হয়নি। তাহলে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে যে বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের কথা বলা হচ্ছে সেখানে আদিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে না। বাংলাদেশ রাষ্ট্র শুরু থেকেই একক ধর্মীয় ও বাঙালী জাতীয়তাবাদকে কেন্দ্র করে শাসন ব্যবস্থা জারি রেখেছে, তাতে উপরন্তু বাঙালি ব্যতীত অন্যান্য সংখ্যালঘু আদিবাসী মানুষের অধিকার লংঘিত হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, দেশে গণতান্ত্রিক সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা শুনতে হবে। জাতীয় সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে, দেশের জাতীয় ইতিহাসে ও সমাজ বিজ্ঞানের পাঠ্যসূচিতে পার্বত্য চুক্তির ইতিহাস তুলে ধরতে হবে এবং বাস্তবায়নের অবস্থার জবাবদিহিতা থাকতে হবে।
কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান বলেন, রাষ্ট্র আদিবাসীদের কিভাবে মূল্যায়ন করে সেটি এখনো স্পষ্ট নয়। প্রান্তিক জনগণকে সংখ্যায় শক্তিতে আরো প্রান্তিকতার দিকে এই আধিপত্যবাদী শাসনব্যবস্থা ঠেলে দিচ্ছে। ১৯৯৭ এর অবস্থা থেকে বর্তমানে এই অবস্থার আরও অবনতি ঘটছে। সরকারের পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের প্রতি অনীহা এবং সরকার ব্যর্থ হচ্ছে। আজকে পার্বত্য চট্টগ্রামে শাসকগোষ্ঠী বাঙালীদেরকে সামরিক বেসামরিকভাবে পৃষ্টপোষকতা যুগিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ে শাসকগোষ্ঠীর সৃষ্ট সংঘাত এবং দ্বন্দ্ব নিয়ে তরুণ সমাজকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। তিনি আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদের নির্বাচনের দাবি জানান। একই সাথে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের নির্দিষ্ট সময়সীমা এবং রোডম্যাপ ঘোষণা করার জোর দাবি জানান।
সভাপতির বক্তব্যে অজয় এ মৃ বলেন, এম এন লারমা ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের এবং আদিবাসীদের মুক্তির লক্ষে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। বর্তমানে প্রতিটা সরকারই আদিবাসীদের বিষয়ে ফ্যাসিবাদী চরিত্র জারি রেখেছে। তিনি সুশীল সমাজ এবং ছাত্র-যুব সমাজ মিলে আলোচনার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণের দাবি তোলেন।