হিল ভয়েস, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, চট্টগ্রাম: গতকাল ২৯ নভেম্বর ২০২৪ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৭তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে চট্টগ্রামে র্যালি, গণসংগীত পরিবেশনা ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আয়োজিত অনুষ্ঠানটি নগরের জে এম সেন হল প্রাঙ্গণে বিকেল ৩:০০ ঘটিকায় শুরু হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৭তম বর্ষপূর্তি উদযাপন কমিটি, চট্টগ্রামের আহ্বায়ক শ্রী তাপস হোড় এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানের উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনবোধি ভিক্ষু।
এছাড়াও অনুষ্ঠানে সম্মানিত আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক রণজিৎ কুমার দে, চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউশনের সাবেক সভাপতি দেলোয়ার মজুমদার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক মোস্তফা কামাল যাত্রা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আনন্দ বিকাশ চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সদস্য শরৎ জ্যোতি চাকমা, পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরামের সভাপতি ডিশান তঞ্চঙ্গ্যা, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি অন্তর চাকমা প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরামের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক জগৎ জ্যোতি চাকমা এবং অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন পিসিপি চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সহ-সভাপতি সৌরভ চাকমা। আলোচনা সভার শুরুতে গণসংগীত পরিবেশন করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আদিবাসী শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক সংগঠন রঁদেভূ শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীবৃন্দ।
রণজিৎ কুমার দে বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ায় পাহাড়িদের জীবনে শান্তি ফিরে আসেনি। এ চুক্তি বাংলাদেশের জাতীয় রাজনৈতিক অঙ্গণে একটি ঐতিহাসিক অর্জন ছিল। যখন পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ শান্তিতে থাকতে চেয়েছিল তখন একটি স্বার্থান্বেষী মহল এটিকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য পায়তারা চালায়। এরশাদের আমলে সমতল এলাকা থেকে বাঙালি এনে পার্বত্য অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করানো হয়। এর ফলে পার্বত্য এলাকার জনগণ তাদের অস্তিতের সংকটে পড়ে যায় এবং তাদের ভূমি হারায়। জুম চাষের উপযোগী জমিগুলো দখল হয়। পার্বত্য অঞ্চলের সমস্যাকে স্থায়ী সমাধানের জন্য সরকারকে চুক্তির বাস্তবায়ন করা জরুরি। এভাবেই কেবল পাহাড়ি আদিবাসীদের জীবনে শান্তির সুবাতাস মিলবে।”
দেলোয়ার মজুমদার বলেন, “চুক্তির ২৭ বছর পরেও পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ আজও অধিকারহীন। পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য চুক্তি হলেও তা যথাযথ বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ আজ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। তরুণ ছাত্রসমাজকে শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে উঠতে হবে এবং শোষণ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সামিল হতে হবে।”
আনন্দ বিকাশ চাকমা বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি শুধু পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীদের অর্জন নই। পার্বত্য চুক্তি রাষ্ট্রেরও একটি অর্জন। এই চুক্তি স্বাক্ষরের পেছনে জুম্ম জনগণের বহু ত্যাগ, তিতিক্ষা রয়েছে। বহু আলোচনা পর্যালোচনা করেই রাষ্ট্রের সাথে চুক্তি হয়েছিলো। কিন্তু বিগত সরকারের আমলে নানা ষড়যন্ত্রের ফলে চুক্তি বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছেে। গত ৫ ই আগস্ট ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। দেশে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে । সরকারের উচিত বিগত সরকারের বিপরীতে আন্তরিকতার সাথে পার্বত্য চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা। তাহলেই পার্বত্য চট্টগ্রামে দাঙ্গা, হামলা নিরসন হবে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সুদৃঢ় হবে।”
শরৎ জ্যোতি চাকমা বলেন, “১৯৯৭ সালে ২রা ডিসেম্বরে যে ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিলো, যেখানে জুম পাহাড়ের মানুষদের অধিকারের কথা লেখা আছে,কিন্তু দুঃখের বিষয় এত বছরেও এই চুক্তির সুফল আমরা পাইনি।কারণ শাসকগোষ্ঠী পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক নয়। আমাদের মধ্য বিভিন্ন উপদল সৃষ্টি করে এই চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া বাঁধা প্রদান করা হচ্ছে। পার্বত্য চুক্তি কোনো একক দলের নয় এটি সবার। পার্বত্য চুক্তি যতদিন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হবেনা ততদিন বাংলাদেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী আমাদের দুঃখ বুঝবে না, আমাদেরকে আপন ভাববে না।”
ডিশান তঞ্চগ্যা বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান অবস্থা খুবই নাজুক। পার্বত্য চট্টগ্রামে দিন দিন সেনা শাসন বেড়েই চলেছে এবং জুম্ম জনগণকে নানামুখী চাপের মুখে রাখা হয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়নকে বাধাগ্রস্ত করতে সরকার চুক্তিবিরোধী নানা গোষ্ঠী সৃষ্টি করছে। চুক্তির পরেও পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প কমেনি। চুক্তি অনুযায়ী ভুমি কমিশন গঠন করা হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি সংক্রান্ত সমস্যাগুলো সমাধান হয়নি। সরকারের উচিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের একটি রোডম্যাপ তৈরি করা।”
অন্তর চাকমা বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামের শোষণ বঞ্চনা নিরসনের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি হয়েছিলো। কিন্তু দীর্ঘ ২৭ বছরে এসেও চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়া জুম্ম জনগণকে আরও অনিশ্চয়তার দিকে থেলে দেওয়া হচ্ছে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার বারবার দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে চুক্তিকে নিয়ে মিথ্যাচার করে গিয়েছে। চুক্তির এতবছর পরেও ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়া, অবৈধ সেনাক্যাম্পগুলো প্রত্যাহার না করা এবং সেটেলার সমস্যার সমাধান না হওয়া জুম্ম জনগণকে কঠোর আন্দোলনের দিকে ধাবিত করছে।
স্বাগত বক্তব্যে জগৎ জ্যোতি চাকমা বলেন,” দীর্ঘ সময় ধরে শোষণ বঞ্চনার স্বীকার জুম্ম জনগণ দীর্ঘ দুই যুগের লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সরকারের সাথে ২৬ বার আলোচনার টেবিলে বসে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। যে চুক্তি জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব রক্ষার দলিল। কিন্তু কোনো সরকারই সেই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য উদারতা দেখাতে পারেনি। যার কারণে আজও পাহাড়ের মানুষ অত্যাচারিত হচ্ছে, নিপীড়িত হচ্ছে। সেখানে আজও অলিখিত সেনাশাসন চলমান রয়েছে।”
সভাপতির বক্তব্যে তাপস হোড় বলেন,”পার্বত্য চুক্তির ২৭ বছর অতিক্রান্ত হলেও অধিকাংশ মৌলিক ধারাগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। তার জন্য পাহাড়ী জনগণকে রুখে দাঁড়িয়ে কঠোর আন্দোলন করতে হবে। পাহাড়ী আদিবাসীদের অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য পাবর্ত্য চুক্তির পূর্নাঙ্গ বাস্তবায়ন করাটা জরুরি।”
অনুষ্ঠানের শুরুতে নন্দনকানন থেকে প্রেসক্লাব হয়ে জেএম সেন হল পর্যন্ত মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।