হিল ভয়েস, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, বিশেষ প্রতিবেদক:
ভূমি কমিশন ও ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
পার্বত্য চুক্তির ‘ঘ’ খন্ডের ৪নং ধারায় বলা আছে যে, জায়গা-জমি বিষয়ক বিরোধ নিষ্পত্তিকল্পে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে একটি কমিশন (ল্যান্ড কমিশন) গঠিত হবে। পুনর্বাসিত শরণার্থীদের জমিজমা বিষয়ক বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তি করা ছাড়াও এযাবৎ যেসব জায়গা-জমি ও পাহাড় অবৈধভাবে বন্দোবস্ত ও বেদখল হয়েছে সে সমস্ত জমি ও পাহাড়ের মালিকানা স্বত্ব বাতিলকরণের পূর্ণ ক্ষমতা এই কমিশনের থাকবে। এই কমিশনের রায়ের বিরুদ্ধে কোন আপিল চলবে না এবং এই কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে। ফ্রীঞ্জল্যান্ড (জলেভাসা জমি) এর ক্ষেত্রে ইহা প্রযোজ্য হবে।
৬নং ধারা অনুসারে কমিশনের মেয়াদ তিন বৎসর হবে। তবে আঞ্চলিক পরিষদের সাথে পরামর্শক্রমে ইহার মেয়াদ বৃদ্ধি করা যাবে। কমিশন পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি করবেন।
১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠন করা হয়ে আসছে। ১৯৯৯ সালে এ যাবৎ ৫ জন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
২০০১ খ্রিস্টাব্দে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১’ প্রণীত হয়। উক্ত আইনে চুক্তির সাথে বিরোধাত্মক কতিপয় ধারা অন্তর্ভুক্ত হয়। এসব বিরোধাত্মক ধারা সংশোধনের জন্য প্রায় ১৫ বছর আন্দোলন করার পর গত ৬ অক্টোবর ২০১৬ জাতীয় সংসদে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন ২০১৬ পাশের মধ্য দিয়ে আইনটির বিরোধাত্মক ধারা সংশোধন করা হয়। আইন সংশোধনের পর ভূমি কমিশনের বিধিমালার খসড়া তৈরি করে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের তরফ থেকে ০১ জানুয়ারি ২০১৭ ভূমি মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে। কিন্তু সরকার এখনো সেই বিধিমালা চূড়ান্ত করেনি। এর ফলে ভূমি কমিশনের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির কাজ এখনো শুরু করা যায়নি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন আইন সংশোধনের পর গত ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি নিষ্পত্তি কমিশনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের কার্যালয় থেকে ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ইস্যুকৃত গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে সংক্ষুব্ধ যে কোন ব্যক্তি ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ এর ৯ ধারার বিধান মোতাবেক আবেদনকারী তাঁর দখস্তখত বা টিপসহিযুক্ত দরখাস্ত সাদা কাগজে সরাসরি অথবা প্রতিনিধির মাধ্যমে অথবা ডাকযোগে কমিশনের কাছে আবেদন দাখিল করার আহ্বান জানানো হয়েছে। জানা গেছে যে, খাগড়াছড়িতে ভূমি কমিশনের কার্যালয়ে ২২,৮৬৬টি দরখাস্ত জমা পড়ে।
ভূমি কমিশন গঠিত হয়েছে বটে, তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের পর্যাপ্ত জনবল, তহবিল ও পরিসম্পদ নেই। খাগড়াছড়ি জেলায় কমিশনের প্রধান কার্যালয় এবং রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ কার্যালয়ে যথাক্রমে রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় শাখা কার্যালয় স্থাপিত হলেও তহবিল, জনবল ও পারিসম্পদের অভাব রয়েছে। বর্তমানে ভূমি কমিশনের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
অন্যদিকে আশি ও নব্বই দশকে বান্দরবান সদর, লামা, আলিকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় সমতল জেলার অধিবাসীদের নিকট সর্বমোট ১,৮৭৭ প্লটের বিপরীতে প্রায় ৪৬,৭৫০ একর জমি ইজারা দেয়া হয়েছে।
২০০৯ সালে খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে অনুষ্ঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় বান্দরবান জেলায় অ-স্থানীয়দের নিকট প্রদত্ত ইজারার মধ্যে যে সমস্ত ভূমিতে এখনো চুক্তি মোতাবেক কোন রাবার বাগান ও উদ্যান চাষ করা হয়নি সে সমস্ত ইজারা বাতিলের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। উক্ত সিদ্ধান্তের আলোকে বান্দরবান জেলা প্রশাসক কর্তৃক ৫৯৩টি প্লটের প্রায় ১৫,০০০ একর জমি এবং রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক কর্তৃক প্রায় ৩৫০ একর ভূমি লীজ বাতিল করা হয়। তবে বান্দরবান পার্বত্য জেলা প্রশাসন কর্তৃক উক্ত সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে লীজ বাতিলের দু’ মাসের মাথায় বাতিলকৃত প্লটগুলোর মধ্যে প্রায় অধিকাংশ প্লট পুনরায় বহাল করা হয়।
লীজের নামে বিভিন্ন কোম্পানী জুম্মদের জুমভূমি ও মৌজাভূমি জবরদখল ও জুম্মদেরকে স্বভূমি থেকে উচ্ছেদ করে চলেছে। তার অন্যতম উদাহরণ হলো লামা রাবার ইন্ডাষ্টিজ লিমিটেড কর্তৃক স্থানীয় প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর সহায়তায় লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের তিনটি ম্রো ও ত্রিপুরা গ্রামের জুমভূমি জবরদখল করা হয়েছে। এলক্ষ্যে ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে লামা রাবার ইন্ডাষ্টিজ লিমিটেড তিনটি জুম্ম গ্রামে এক ডজনের অধিক বার হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে।
বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির স্বাক্ষরের পর বিগত ২৭ বছরেও চুক্তির মৌলিক বিষয়সহ দুই-তৃতীয়াংশ ধারা অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে।