হিল ভয়েস, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ঢাকা: আজ ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ঢাকার ডেইলী স্টার ভবনের আজিমুর রহমান কনফারেন্স হলে কাপেং ফাউন্ডেশনের আয়োজনে “বাংলাদেশের আদিবাসীদের সামগ্রিক অবস্থা পর্যালোচনা ও করণীয় শীর্ষক” জাতীয় পর্যায়ের এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।
কাপেং ফাউন্ডেশনের এডভোকেসী এন্ড কমিউনিকেশন অফিসার হ্লাম্রাচিং চৌধুরী রনির সঞ্চালনায় ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম এর সহ-সভাপতি অজয় এ মৃ এর সভাপতিত্বে উক্ত সভায় সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব প্রদীপ কুমার মহোত্তম, এনডিসি, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য নাইউপ্রম্ন মারমা মেরী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. স্নিগ্ধা রেজওয়ানা, এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, কবি ও দৈনিক প্রথম আলোর যুগ্ন-সম্পাদক সোহরাব হাসান, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার জাতীয় সমন্বয়ক আলেক্সিউস চিছাম, জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সারোয়ার তুষার, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সহ-সভাপতি ডা. ফিলিমন বাস্কে, কুবরাজ আন্ত:পুঞ্জি উন্নয়ন সংগঠন এর সাধারণ সম্পাদক ফ্লোরা বাবলী তালাং প্রমুখ। এতে কাপেং ফাউন্ডেশনের ত্রিজিনাদ চাকমা স্বাগত বক্তব্য ও নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
স্বাগত বক্তব্যে প্রকল্প সমন্বয়ক ত্রিজিনাদ চাকমা বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে দেশ গঠনের নানা পর্যায়ে এদেশের আদিবাসীদের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। তারা এদেশের মাটি, মানুষ ও পরিবেশের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। এজন্য তারা বাংলাদেশের সংবিধানে তাদের অন্তর্ভুক্তির কথা বলেছেন। ’৭২ সালে আদিবাসীদের প্রতিনিধি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা নিজেদের আত্মপরিচয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতির জন্য তুমুল বিতর্ক করেছিলেন।
স্বাধীনতার ৫৩ বছরে অনেক সরকার এসেছে আর গেছে। কোন সরকারের আমলেই আদিবাসীদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। আদিবাসীদের উপর যে মানবাধিকার লংঘন বিশেষ করে ভূমি বেদখল, একে কেন্দ্র করে হত্যা, নারীর প্রতি সহিংসতা, সাম্প্রদায়িক হামলা ইত্যাদি দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে আদিবাসীরা ন্যায়-বিচার তো দূরে থাক বরং অনিরাপদ ও হতাশাগ্রস্ত জীবন অতিবাহিত করতে বাধ্য হয়। কল্পনা চাকমা, পিরেন স্নাল, চলেশ রিছিল ইত্যাদি মামলাগুলোর বিচারের বাণী এখন নিরবে নিভৃতে কাঁদে।
গত ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের আপামর জনগন নতুন স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছে যে স্বপ্ন বিগত সরকারের আমলে তছনছ হয়েছে। বহু জাতি, বহু ভাষা, বহু বর্ণ, বহু ধর্ম, বহু সংস্কৃতির অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক সবার অন্তর্ভুক্তির বৈচিত্র্যের বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন এখন বাংলাদেশের মানুষের মুখে মুখে। নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করে সেই উদ্যোগের কিছুটা এগিয়েছে। আমরা আশা রাখতে চাই নতুন সরকারের হাত ধরেই সেই কাঙ্খিত সবার অন্তর্ভুক্তিমূলক সোনার বাংলাদেশ গঠিত হবে। এবং এতেই বাংলাদেশের গ্যারান্টি থাকবে নি:সন্দেহে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের স্বপ্নও এ সরকারের আমলে দেখা যেতে পারে।
মূল প্রবন্ধে পল্লব চাকমা বাংলাদেশের আদিবাসীদের মানবাধিকার পরিস্থিতি বর্ণনা করেন। তিনি আদিবাসীদের সামগ্রিক অবস্থা পর্যালোচনা করেন। তিনি কাপেং কতৃর্ক সংগৃহীত কিছু উপাত্তেরও বিশ্লেষণ করেন। বাংলাদেশের আদিবাসীদের সমকালীন পরিস্থিতি, বিভিন্ন নীতিমালায় তাদের বাস্তবতা ইত্যাদি বিষয়গুলো তার বক্তব্যে তুলে ধরা হয়। সবশেষে তিনি কয়েকটি সুপারিশের অবতারণা করেন—
১। আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি
২। রোডম্যাপ প্রণয়নপূর্বক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন
৩। সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠন
৪। বিচারহীনতার সংস্কৃতি বন্ধ করা
৫। যেকোন কর্মপরিকল্পনায় আদিবাসীদের সম্পৃক্তকরণ ইত্যাদি।
লেখক, গবেষক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সারোয়ার তুষার বলেন- বাংলাদেশের সংবিধান পর্যালোচনায় এমএনলারমা একটি উজ্জল নক্ষত্রের নাম। এমএন লারমা শুধু আদিবাসীদের জন্য সংগ্রাম করেননি তিনি সবার জন্য সংগ্রাম করেছেন। লিবারেল ডেমোক্রেসীতে সংখ্যালঘুরা অধিকার পাচ্ছে কিনা তা দেখা হয়। বাংলাদেশের সংবিধান সেরকম নয়। এ সংবিধান জাতিনিরপেক্ষতা বজায় রাখে না। এখানে বলা আছে, জাতি হতে গেলে আপনাকে বাঙালী হতে হবে। এটা একটা সাম্প্রদায়িক ব্যাপার।
আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের রক্ষার জন্য এমন কিছু কিছু বিধান রাখা উচিত যেমন আদিবাসীদের ভূমি-সম্পত্তি বিক্রি করা যাবে না। তাহলে তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করা যাবে। এখানে আরো বলা দরকার যে, আমাদের দেশ এখনো রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারেনি। এজন্য আমাদের সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। প্রাসঙ্গিকভাবে আরো উল্লেখ্য, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এটা চরম অপমানজনক।
নতুন সরকার অনেকগুলো সংস্কার কমিশন করেছে। আমি মনে করি আরো দুটি সংস্কার কমিশন হওয়া বাঞ্চনীয়। তা হলো- শিক্ষা সংস্কার কমিশন এবং জাতি ও সংখ্যালঘু কমিশন। যেখানে আমলারা নয় এবিষয়ে অভিজ্ঞ লোকরাই এখানে কাজ করবেন। আমি বারবার বলি, ১৮ কোটি মানুষের দেশে শুধুমাত্র ৪০ লক্ষ আদিবাসীদের নিয়ে এ ৫৩ বছরেও কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না এটা খুবই লজ্জাজনক।
কবি ও দৈনিক প্রথম আলোর যুগ্ন-সম্পাদক সোহরাব হাসান বলেন- আদিবাসীদের তো রাষ্ট্রই স্বীকার করে না। নিজেদের অধিকার আদায় করা প্রথম কর্তব্য। রাষ্ট্র কীভাবে তার জনগনকে দেখে তার উপরও নির্ভর করে জনগনের ভাগ্য। সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্র তার জনগনকে বৈষম্য করতে পারে না। কিন্তু এরা প্রতি পদে পদে বৈষম্যে শিকার হচ্ছে। রাষ্ট্র যদি মানবিক না হয় তাহলে মানুষ তাদের অধিকার পাবে না।
পার্বত্য চট্টগ্রামে কেন চুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এর সমস্যা অনেক গভীর। সমতলের আদিবাসীরা বেশি প্রান্তিকতার শিকার হচ্ছে। রাষ্ট্র বধির। রাষ্ট্র এগুলো দেখতে পাচ্ছে না। ইতিবাচক পরিবর্তন যদি না হয় তাহলে নিষ্ফল চিৎকার করতে হবে বারবার। মানুষের জন্য রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের জন্য মানুষ নয়। রাষ্ট্র নয় মানুষকেই বড় কেও দেখতে হবে। আদিবাসীদের নিয়ে বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে অনেক কথা হয়। আমাকে দেখান, আদিবাসীদের অধিকার দিয়ে কোন দেশ বিচ্ছিন্ন হয়েছে? পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে।
এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন- বাংলাদেশের আদিবাসীরা কেমন আছেন তা আর নতুন করে বলার দরকার নেই। স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্যে সুন্দর একটা দেশ পাবো আশা করেছিলাম। কিন্তু অনেক দুর্বলতার কারণে আমরা সেই সুফল ভোগ করতে পারিনি। এযাবতকালে সংবিধানের কাঁটাছেড়া একটা কিম্ভুতকিমাকার করে রেখেছে। জুলাই অভ্যুত্থানে ঐতিহাসিক সেই অনিবার্যতা ছিল। এই তরুণ প্রজন্ম সেই আকাঙ্খা আবারো নিয়ে এসেছে। আমি সারোয়ার তুষারের পাশাপাশি ভূমি-কৃষি সংস্কার কমিশনও হওয়া উচিত বলে মনে করি।
আমরা দেখেছি, শাসকদের একটা অস্বীকারের সংস্কৃতি রয়েছে। বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই এভাবে জাতিসংঘে আমাদের সরকার বারবার অস্বীকার করে এসেছে। আমি মনে করি এগুলোর পরিবর্তন হওয়া দরকার। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। সেটেলার সমস্যা আদিবাসীরা সৃষ্টি করেনি। এটা রাষ্ট্রই সৃষ্টি করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান রাষ্ট্রকে করে নিতে হবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. স্নিগ্ধা রেজওয়ানা বলেন, রাষ্ট্র বাংলাদেশের আদিবাসীদের দেখতে চায় না। না দেখার এ প্রক্রিয়া ক্রমশ চলমান। গণতন্ত্র মানে হচ্ছে সংখ্যলঘুদের কথা শুনা। কিন্তু বাংলাদেশে এ চর্চাটা এখনও হয়ে ওঠেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামে অহরহ রিসোর্ট পাওয়া যায়, কিন্তু যেটা সবচেয়ে প্রয়োজন হাসপাতাল, স্কুল এগুলো পাওয়া যায় না। এখানে রিসোর্ট এর মালিক কারা হচ্ছে? এটা বুঝতে হবে। এভাবেই আদিবাসীরা সিস্টেমেটিক ডিসক্রিমিনেশনের শিকার হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি এখনো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। হবেই বা কেন। এখানে শাসকের মনে তো সাম্প্রদায়িকতা ও জাত্যাভিমান লুকিয়ে রয়েছে। এজন্য তো ’তোরা বাঙালি হয়ে যা’ বলা হয়েছে। এখন বর্তমানে এতগুলো সংস্কার কমিশন গঠন করা হলো, কোনটাতেই আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্ব নেই। এরকম অবজ্ঞা-অবহেলার প্রক্রিয়া চলতে থাকলে কোন অধিকারই প্রতিষ্ঠিত হবে না। কিন্তু, আমার মনে হয়, আদিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব প্রদীপ কুমার মহোত্তম, এনডিসি বলেন- সরকার আসে যায় কিন্তু সরকারের পলিসি কখনোই বদল হয় না। সংবিধানে সবার সমানাধিকারের কথা বলা আছে। যারা পিছিয়ে রয়েছে তাদের তুলে আনার ব্যবস্থাও এ সংবিধানে রয়েছে। বাংলাদেশে একটা ডেল্টা প্রকল্প হাতে নেওয়া আছে। ৬টি অঞ্চলের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামর আছে। এর উদ্দেশ্য পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের জীবনমান বাড়ানো।
টিআইবি’র পরিচালক ও দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন- আমি মনে করি, আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতিটি আদিবাসীদের জন্য অপরিহার্য। সংবিধান সংস্কার কমিশনে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি বিষয়টি উঠে আসা উচিত। বৈচিত্র্যভিত্তিক ও সমতার জন্য স্থায়ীভাবে ডাইভারসিটি কমিশন থাকা উচিত। আমি মনে করি, বাংলাদেশে আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম যতক্ষণ না পর্যন্ত বাঙালীদের কাতারে আসবে ততক্ষণ আমাদের বেগ পেতে হবে।
পাহাড়ী দীর্ঘ ত্যাগ-তিতীক্ষার ফসল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মাধ্যমে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় পাহাড়ের জন্য কী করছে? যেগুলো করছে তা পাহাড়ী জনগণের জন্য বুমেরাং হচ্ছে। ভালোর চাইতে মন্দই হচ্ছে বেশি। এ মন্ত্রণালয় অপরাপর মন্ত্রণালয়গুলোর মত কাজ করছে যা একটা বিশেষ স্বার্থান্বেসী গোষ্ঠীর লাভ হচ্ছে। এ মন্ত্রণালয় আদিবাসীদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারছে না। আদিবাসীদের স্বার্থ রক্ষা করতে না পারলে বা আদিবাসীদের কাজে না আসলে এ মন্ত্রণালয় থেকে কী লাভ। এ মন্ত্রণালয়ের যে বিশেষত্ব সে মর্যাদা এ মন্ত্রণালয় রাখতে পারেনি।
এছাড়াও বক্তব্য রাখেন, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য নাইউপ্রম্ন মারমা মেরী, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার জাতীয় কর্মসূচী সমন্বয়ক আলেক্সিউস চিছাম, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সহ-সভাপতি ডা. ফিলিমন বাস্কে, কুবরাজ আন্ত:পুঞ্জি উন্নয়ন সংগঠন এর সাধারণ সম্পাদক ফ্লোরা বাবলী তালাং প্রমুখ।