হিল ভয়েস, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, বিশেষ প্রতিবেদক:
পার্বত্য জেলা পরিষদ
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
পার্বত্য চুক্তির ‘খ’ ও ‘গ’ খন্ডের বিধানাবলীর মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এবং রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের বিধান করা হয়েছে। কিন্তু চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ায় এখনো পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ শাসনব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করতে পারেনি।
পার্বত্য চুক্তির ‘খ’ খন্ডে পার্বত্য জেলা পরিষদ সংক্রান্ত ৩৫টি ধারার মধ্যে ৩৩টি ধারা বাস্তবায়িত ও ১টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে এবং অবশিষ্ট ২টি ধারার বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে বিগত সরকার দাবি করেছে। কিন্তু জনসংহতি সমিতির মতে, প্রকৃত অর্থে মাত্র ১৬টি ধারা বাস্তবায়িত, ১৫টি ধারা অবাস্তবায়িত এবং অবশিষ্ট ৪টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে। পার্বত্য জেলা পরিষদ সংক্রান্ত চুক্তির ‘খ’ খন্ডের গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলো নিম্নে উত্থাপন করা গেল, যেগুলো সরকার ‘বাস্তবায়িত’ হয়েছে মর্মে দাবি করছে, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তা বাস্তবায়িত হয়নি-
“অউপজাতীয় স্থায়ী বাসিন্দা” সংজ্ঞা সংক্রান্ত চুক্তির ‘খ’ খন্ডের ৩নং ধারা তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সত্য, কিন্তু কার্যকর করা হয়নি। উক্ত ধারা লঙ্ঘন করে ২১ ডিসেম্বর ২০০০ তারিখে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক অফিসাদেশের মাধ্যমে সার্কেল চীফের পাশাপাশি ডেপুটি কমিশনারদেরও স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র প্রদানের যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তা প্রত্যাহারের জন্য বার বার দাবি করা সত্ত্বেও প্রত্যাহার করা হয়নি। ডেপুটি কমিশনাররা পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দা নন এমন অউপজাতীয় ব্যক্তিদেরকে স্থায়ী বাসিন্দা সনদপত্র দিয়ে চলেছেন।
‘ভোটার হওয়ার যোগ্যতা ও স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়ন’ সংক্রান্ত চুক্তির ‘খ’ খন্ডের ৯নং ধারাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনে সংযোজিত করা হলেও বাস্তবায়ন করা হয়নি। ২০০০ খ্রিস্টাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদের জন্য পার্বত্য জেলা ভোটার তালিকা বিধিমালা- ২০০০ এবং পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নির্বাচন বিধিমালা- ২০০০ এর খসড়া প্রণয়ন করে। আইনের ৫৩ ধারা অনুসরণে আঞ্চলিক পরিষদ এসব বিধিমালার উপর সুপারিশ পেশ করে। তবে উক্ত বিধিমালাসমূহ আজ অবধি প্রণীত হয়নি। “নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ” সংক্রান্ত চুক্তির ‘খ’ খন্ডের ১০নং ধারাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও এখনো “নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ” করা হয়নি। ফলে বিগত ২৭ বছরেও এই তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। এসব পরিষদ অনির্বাচিত অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদের মাধ্যমে অগণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে।
‘উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, গ্রহণ ও বাস্তবায়ন’ সংক্রান্ত চুক্তির ‘খ’ খন্ডের ১৯নং ধারায় সন্নিবেশিত “জাতীয় পর্যায়ে গৃহীত সকল উন্নয়ন কার্যক্রম পরিষদের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/ বিভাগ/ প্রতিষ্ঠান বাস্তবায়ন করবে”- এই অংশটি আইনে সংযোজিত করা হয়নি। অপরদিকে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের উন্নয়ন কার্যক্রম পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। এছাড়া আঞ্চলিক পরিষদকে পাশ কাটিয়ে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড অধিকাংশ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে থাকে। ফলে এখনো পার্বত্য জেলা পরিষদের মাধ্যমে পার্বত্যবাসীর নিজেদের উন্নয়ন নিজেরাই নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করার আত্মনিয়ন্ত্রিত উন্নয়ন ধারা গড়ে উঠেনি।
‘পার্বত্য জেলা পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর ও তদনিম্ন স্তরের সদস্য নিয়োগ বদলি’ সংক্রান্ত চুক্তির ‘খ’ খন্ডের ২৪নং ধারাটির বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে সরকার দাবি করছে। এ বিধানটি আইনে অন্তর্ভুক্ত হলেও আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ক্ষমতা পার্বত্য জেলা পরিষদের মাধ্যমে কার্যকরী করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এখনো পর্যন্ত উপজাতীয়দের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে পার্বত্য পুলিশ বাহিনী গঠিত হয়নি। অপরদিকে পূর্বের মতো পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কতৃর্ক পুলিশবাহিনীর বদলি, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ইত্যাদি ক্ষমতা সরাসরি প্রয়োগ করা হয়ে আসছে।
উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির সভায় নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে ‘পুলিশ (স্থানীয়)’ ও ‘আইন-শৃঙ্খলা সংরক্ষণ ও উন্নয়ন’ বিষয় হস্তান্তর করা ও পার্বত্য জেলা পুলিশ বাহিনী গঠন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু কমিটির এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না করে ১৩ এপ্রিল ২০২২ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার্স থেকে সেনাবাহিনীর প্রত্যাহারকৃত ক্যাম্পের জায়গায় এপিবিএন মোতায়েন করার নির্দেশনা জারি করা হয়, যা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সরাসরি লঙ্ঘন।
পার্বত্য জেলা পরিষদের পূর্বানুমোদন ব্যতীত ভূমি বন্দোবস্তী, হস্তান্তর, ক্রয়-বিক্রয়, ইজারা প্রদান, অধিগ্রহণে বিধিনিষেধ সংক্রান্ত চুক্তির ‘খ’ খন্ডের ২৬নং ধারাটির বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে সরকার দাবি করছে। বস্তুত বিধানটি আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও ইহা কার্যকর করা হচ্ছে না। আজ অবধি উক্ত বিষয় ও ক্ষমতা পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তর করা হয়নি। ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির দোহাই দিয়ে পার্বত্য জেলা পরিষদের পূর্বানুমোদন ব্যতীত ডেপুটি কমিশনারগণ নামজারি, ইজারা ও বন্দোবস্তী প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছেন।
চুক্তির ‘খ’ খন্ডের ৩৪(ক) ধারা মোতাবেক ‘ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা’ বিষয়টি পার্বত্য জেলা পরিষদের আওতাধীন অন্যতম একটা বিষয়। কিন্তু আজ অবধি উক্ত বিষয় পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তর করা হয়নি। হেডম্যান, চেইনম্যান, আমিন, সার্ভেয়ার, কানুনগো ও সহকারী কমিশনার (ভূমি)-দের কার্যাদিও পার্বত্য জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণাধীন করা হয়নি।
‘ভূমি উন্নয়ন কর আদায়’ সংক্রান্ত চুক্তির ‘খ’ খন্ডের ২৭নং ধারাটি আইনে সংযোজিত হওয়ার মধ্য দিয়ে বাস্তবায়িত হয়েছে বলে সরকার দাবি করছে। অথচ জেলার ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ের দায়িত্ব পরিষদের হস্তে এখনো ন্যস্ত করা হয়নি। এ ক্ষমতা এখনো ডেপুটি কমিশনারগণ প্রয়োগ করে চলেছেন। তাই এ বিধান ‘বাস্তবায়িত’ হয়েছে বলে সরকারের অভিমত সঠিক নয়।
পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তরযোগ্য বিষয় বা কার্যাবলী সংক্রান্ত চুক্তির ‘খ’ খন্ডের ৩৩ ও ৩৪নং ধারা অনুসারে সংশ্লিষ্ট বিষয় বা কার্যাবলী আইনে সংযোজিত হলেও যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। যেমন জেলার আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ (স্থানীয়), ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয় এখনো তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তর করা হয়নি। এছাড়া পর্যটন, মাধ্যমিক শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়গুলো ত্রুটিপূর্ণভাবে পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তর করা হয়েছে। তাই এ বিধানগুলো সম্পূর্ণ ‘বাস্তবায়িত’ হয়েছে মর্মে সরকারের অভিমতও সঠিক নয়।
বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির স্বাক্ষরের পর বিগত ২৭ বছরেও চুক্তির মৌলিক বিষয়সহ দুই-তৃতীয়াংশ ধারা অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে।