চুক্তি বিরোধীদের প্রতি খোলা চিঠি (শেষ অংশ)

জীবন চাকমা

জেএসএস শান্তি চুক্তি করে জনগণের সাথে বেঈমানী করেছে বললেও বলুন। কিন্তু তা আপনারা এতকাল কী কী করেছেন কীই বা করতে যাচ্ছেন। এ বি খীসারা তো এতকাল আন্দোলনে সক্রিয় না হয় হলেন না কিন্তু খুব বেশি সহযোগিতা তো করেননি। আন্দোলন প্রতিষ্ঠালগ্নে প্রত্যক্ষ জড়িত ছিলেন বটে কিন্তু সেই আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে সহযোগিতার কথা বাদ দিলাম, সহমর্মিতাও তো দেখাতে পারেননি। বেছে নিয়েছিলেন একটা সাদামাটা একান্ত নিভৃত শিক্ষকতার জীবন। সুতরাং আন্দোলন থেকে বেশি কিছু আশা করেন কোন দুঃখে। বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করতে যথেষ্ট উদারতার প্রয়োজন। এসব লিখতে খুবই খারাপ লাগছে। কিন্তু এ মুহূর্তে এসব বলা খুবই জরুরী। চিঠি পড়ে হয়তো ভাবতে পারেন ব্যক্তিগত আক্রমণ হয়ে গেল। তা মনে করুন। কিন্তু এটাই সত্য। শান্তি চুক্তি সবার মত আমার জীবনেও তেমন কিছু আনতে পারেনি। কিন্তু শান্তি চুক্তির বিরোধিতা কেবল আমার নয় সমগ্র জুম্ম জাতীয় জীবনে অপরিসীম ক্ষতির কারণ হচ্ছে। পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের আগে এর থেকে আমাদের মুক্তি পেতে হবে। নইলে ইতিহাসের চাকা উল্টোদিকে ঘুরে যাবে। অর্থাৎ পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দূরে থাক এই আঞ্চলিক পরিষদও হারাতে হবে। একে তো তিন জুম্ম এমপি নিয়ে জ্বালার শেষ নেই তার উপর ইউপিডিএফ এর উৎপাত। জনগণ কোনটা সইবে। জনগণের বন্ধু হতে হলে তাদের স্বার্থে কর্মসূচী ঠিক করুন। নিছক জেএসএস বিরোধীতাকে পুঁজি করে আন্দোলনের কোন ইতিবাচক দিক নেই। এই সত্যটাই আজ বুঝা উচিত। যেন তেন আন্দোলন নয়। জুম্ম জনগণের স্বার্থ নিয়ে রোমান্টিক স্বপ্নে বিভোর হওয়া চলে না।

দুই যুগের সশস্ত্র সংগ্রাম যখন আঞ্চলিক পরিষদে মুখ থুবড়ে পড়েছে ঠিক সেই জায়গা থেকে গাদা বন্দুক দিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের স্বপ্ন কতটুকু বাস্তবসম্মত তার বিস্তর সন্দেহ থেকে যায়। তবুও মানুষ আশা নিয়েই তো বাঁচে। পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে ক্ষতিইবা কি। আমরাও মনে প্রাণে সেই স্বপ্ন দেখতে কিংবা তারও বেশি আশা করি। জেএসএসও নিশ্চয় পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসন (তা যদি আঞ্চলিক পরিষদ থেকে সামান্যতম বেশি কিছু হয়) পেলে না করবে না। যদি তাই হয় তাহলে জেএসএস আঞ্চলিক পরিষদ নিয়ে থাকুক এবং প্রসিত বাবুরা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠায় আত্মনিবেদিত থাকুক তাহলেই হয়ে গেল। পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসনের প্রথম কাজটা যদি জেএসএস এর উপর আক্রমণ হয় বিপত্তি তখনই হয়। প্রসিত বাবু জুম্ম জনগণ আর আগের মত নেই। বিদ্যায় বিশ্লেষণে এখন অনেক অনেক অগ্রসর। তারা এখন অনেক জটিল এবং কূটিলও বটে। তাদের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বেশি বোকা বানানো যাবে না। গোটা বিশ্বটাই আজ বড়ই জটিল প্রক্রিয়াধীন। সমাজের চেহারাও বদলে গেছে। এ সময়ে অন্ততঃ আপনার নেতৃত্বে নতুন কিছু আশা করে না। আপনার ছেলে মানুষী নেতৃত্বে নির্ভর করা যায় না এটাই তাদের কাছে পরিষ্কার। জেএসএস যেখানে ৫ দফা নিয়ে আন্দোলন এবং আলোচনায় ব্যস্ত ঠিক সেই মুহূর্তে রাঙ্গামাটিতে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর সময় তোমার পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসনের (নয়া রূপকথার গল্প) ডাকের জেরে ব্যাপক অহেতুক আঘাত আর নানিয়ারচরে আপনারই গোয়াতুর্মির কারণে ঘটে যাওয়া ১৭ নভেম্বরের গণহত্যা আমাদের বার বার আপনার নেতৃত্ব সম্পর্কে সর্তক করে দেয়।

অতএব বাস্তবসম্মত নীতি কৌশল ঠিক করুন। জনগণকে নেতৃত্ব দিতে হলে রোমান্টিকতা পরিহার করুন। শত্রু-মিত্রও চিহ্নিত করতে হবে। পরিষ্কার কর্মপদ্ধতি ঠিক করুন। কিন্তু দোহাই খুন খারাবির নেশায় যাতে না পেয়ে বসেন। খুন খুনের জন্ম দেয়। হত্যা হত্যার। বড় বেশি জাতপ্রেমিক হওয়াও ভয়ঙ্কর বিপদের। সময়টা খুবই খারাপ। এসবই আমার চাইতে আপনার বেশি জানা আছে। তবুও লিখলাম। কেবল মনের ঝাল মিটাতে নয়। প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরতে। না হলে নিজেও ডুববেন, জাতটাকেও ডুবাবেন। সময়টা বড় নিষ্ঠুর।

আজকাল আমাদের দেশের অবস্থা দেখে মনে হয দেশ ও জুম্ম জাতির প্রতিযোগিতায় নেমেছি – কাকে মেরে কে আগে জাতপ্রেমিকের দায়িত্ব পালন করবে সেটারই যেন কমপিটিশন চলছে। প্রসিত বাবুদের অবস্থা দেখে তাই কখনো ভাবি আমাদের দেশ-জাত সেবকের অভাব নেই। কেবল অভাব নেই বললেও বোধ হয় ভুল হবে। বলতে হবে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে কে আগে অবদান রাখতে পারে সেটাই যেন বড় হয়ে দাড়িয়েছে। অর্থাৎ অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সুনামের ভাগটা কেড়ে নেওয়ার জনেই তারা উদ্ধত। জাতপ্রেম থাকা খুবই ভাল কিন্তু তা যদি উগ্র জাতপ্রেম হয় তাহলেই বিপদ। আগে ছিল জেলা পরিষদে যারা ছিল এবং তাদের সাথে যারা যোগাযোগ রাখত সেই ছাত্র-যুবকরা দালাল। সেনাবাহিনীর সাথে যাদের যোগসাজশ ছিল তারাও দালাল। তাদের বিরুদ্বে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল প্রসিত বাবুরা। শান্তি চুক্তি করে জেএসএসও রাতারাতি দালাল হবে। জেএসএসও কেবল দালাাল নয় বেঈমানও হয়ে গেছে নাকি। তবে তাদের আক্রমনের লক্ষ্যবস্তু শান্তি চুক্তি নয়। তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য জেএসএস। শান্তিচুক্তির অ আ ক খও পড়েনি। যাদের দালাল বলে তারা এযাবত চিহ্নিত করে আসছে তাদেরও ন্যূনতম জাতপ্রেম আছে। আর যারা নিজেদের বিশুদ্ধ জাতপ্রেমিক মনে করছে তাদের দেশপ্রেমও ১০০ ভাগ খাটি হতে পারে না। কিন্তু কথিত দালালদের নিশ্চিহ্ন করাই হচ্ছে বিশুদ্ধ জাত প্রেমিকদের প্রথম কাজ। এখানেই গৌণ হয়ে যাচ্ছে আসল শত্রুর সাথে সংগ্রামের দিকটা। দালালী সে যে মাপেরই হোক থাকবে চিরকাল। শারীরিকভাবে এই অস্তিত্ব ধ্বংস আজকের দিনের এই সমাজ কাঠামোই একটি অলীক কল্পনা মাত্র। অথচ তাই করবার চেষ্টা করছে শান্তিচুক্তির বিরোধীরা। পরিনামে যা হচ্ছে তা এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কল্পনা করতেও ভয় হয়। আজ ভ্রাতৃঘাতী যে তৎপরতা চলছে তা অনিবার্যভাবেই মূল আন্দোলনকে দুর্বল করবে। পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসন অর্জন দূরে থাক যা আছে যে অবস্থায় আছে তাও হারাতে হবে সে কথা আগেই বলেছি।

জেএসএস আর পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসনপন্থীদের মধ্যে আপাততঃ দ্বন্দ্বটা যদিও শান্তি চুক্তির নামে অপূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসন এবং পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসনের মধ্যে সমস্যা আসলে অন্যখানে। না হলে শান্তি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন হলেও পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসনপন্থীদের তেমন কীইবা ক্ষতি? কারণ তারা তো যেটা অপূর্ণ রয়ে গেছে সেটাই অর্জন করার জন্য লড়াই করছে। অন্যদিকে পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসন প্রতিষ্ঠা হলে জেএসএস এরও কীই বা ক্ষতি? তাহলে তো দ্বন্দ্বটা অন্যখানে। প্রসিত নেতৃত্ব যা চায় তা হলো জেএসএস এর অধীনে নয়, নিজেরই নেতৃত্বে একটি দল নিয়ে জুম্মদের অধিকতর অধিকার অর্জন করা। মূলতঃ জেএসএস এর যে রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক যোগ্যতা তার মনপূতঃ হয়নি কোন কালে। তার ধারণা হচ্ছে জেএসএস এর চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির যে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ তাও বাস্তব বিবর্জিত। যেমন দালাল বিশুদ্ধি অভিযান। দালালমুক্ত না করলে পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকার আদায় সম্ভব নয়। অতএব দালাল নির্মূলই অধিকার অর্জনের প্রথম ধাপ। পথের কাঁটা সরিয়েই এগুতে হবে। দালালরাই পথের কাঁটা। কিন্তু অধিকার অর্জনে দালালদেরও পক্ষে আনার বা নিরপেক্ষ করার জেএসএস এর কৌশল তার সন্তোষজনক হয়নি। দালালদের সাথে কথাবার্তা বলা মানেই তাদের মতে আসকারা (তাদের ভাষায়) দেওয়া, তাদের সাথে মাখামাখি হওয়া। তাদের সাথে কথা বলা মানেই আপোষ করা। দালালদের সাথেও আপোষহীন সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়াও প্রসিত নেতৃত্ব একটি মহান দায়িত্ব বলে মনে করে। অথচ সে যা চায়নি তাই করেছে জেএসএস প্রধান। অর্থাৎ তার কথামত জেএসএস চলেনি বলেই নাখোচ হয়ে যান উনি। সে থেকেই টালবাহানার শুরু। সুতরাং নিজের বিচার বিশ্লেষণ অনুযায়ী এগুতে চায় প্রসিত বাবুরা।

জুম্ম জনগণের এক বিরাট অংশ জেএসএস এর সমর্থক। এই অংশকে বাদ দিয়ে তো আর আন্দোলন এগিয়ে নেওয়া যায় না। তাই তাদের জেএসএস বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ করতে হবে। যা কিছুই খারাপ জেএসএস এর ছিল বা আছে তা তুলে ধরতে হবে এবং সাথে সাথে জেএসএসকে নিশ্চিহ্ন করতে হবে। অতএব হত্যার লীলা খেলা খেলতেই হবে। তা না হলে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে ক্ষতিকর দালাল এমপি দীপঙ্কর তালুকদার, এমপি বীর বাহাদুর ও মন্ত্রী কল্পবাবুর মত আরো কত দালালই তো দিব্যি তাদের ক্রিয়াকর্ম চালাচ্ছে। অথচ তাদের সাথে প্রসিতবাবুদের গভীর ভাবসাব আছে বলে তো শোনা যায়। আড়ালে আবডালে উনারা নাকি এখন কেবল অর্থ নয়, অস্ত্রও যোগাচ্ছে। যে সময় প্রসিত বাবুরা প্রিয়কুমারদের সাজা দিয়ে যাচ্ছিল এবং যাদের বড় দালাল ভাবতেন সেই সময়ও তো আরো কতো বাঘা বাঘা দালাল বিনা বাধায় তাদের অপকীর্তি করেই যাচ্ছিল। অথচ চুনোপুটি প্রিয় কুমারকে নিয়ে প্রসিতবাবুরা মেতে উঠলেন কেন? কারণ একটাই। তা হলো তাদের একান্ত ব্যক্তিগত শত্রুতা। প্রিয় কুমারের সাথে কেবল প্রসিতবাবুর সম্পর্ক খারাপ ছিল তা নয় প্রসিতের বাবা বর্তমানে তুখোড় দেশ-জাত প্রেমিক এবং পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসনপন্থী অনন্ত বিহারী খীসার ব্যক্তিগত সম্পর্কও ভালো ছিল না। একই পাড়ার কাছাকাছি বলেই নয়, বিভিন্ন সামাজিক কাজে নানা মতবিরোধে সৃষ্টি হয় তিক্ততা। প্রিয় কুমারও অত্যন্ত চালাক চতুর প্রকৃতির লোক জ্ঞানে অনন্ত বাবুর সাথে যেমন তার তুলনা হয় না, অন্যদিকে তেমনি বুদ্ধিতে সামান্য ডিসি অফিসের কেরানী প্রিয় কুমার চাকমা অনন্তবাবুকে হার মানায় বটে। প্রসিতবাবু যতই অস্বীকার করুক না কেন তাদের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ছিলই।

আমাদের জন্য যেটা সবচে’ দরকার সেটা হলো প্রকৃত জাতপ্রেম। জুম্মজাত নিয়ে তথাকথিত রাজনীতিকে নিছক পেশা বা নেশা করে সেবা করা যায় না। আর রাজনীতিটা তো প্রসিত বাবুদের একটা নেশা এবং পেশাও হয়ে দাঁড়িয়েছে ইদানিং। তাই ছাত্র পরিষদ, গণ পরিষদ বা জেএসএস সবকিছু বাদ দিয়ে মনগড়া একটা সংগঠন ইউপিডিএফ খুলে বসে আছে। তার এই ইউপিডিএফ সংগঠন করতে কজন জুম্ম জনগণ জানত? কজনকেই বা সম্পৃক্ত করতে পেরেছে প্রসিত বাবু? গুটিকয় ছাত্র যুবককে নিয়ে নানা নামে সংগঠন (দোকান) খুলে বসা যায় কিন্তু আপামর জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনে তেমন কোন ভূমিকা রাখতে পারা চাট্টিখানি কথা নয়। তার এই সংগঠন নিয়ে কী স্বপ্ন আমার জানা নেই। তবে এই কথা পরিষ্কার যে, ব্যাপক মানুষের মনে তার কোন অস্তিত্ব নেই। সাধারণ মানুষের স্বপ্নই আসল। তারা এই সময়ে কী চায়? কীই বা তাদের স্বপ্ন? তা তাদের আশা আকাক্সক্ষা প্রসিতবাবুদের কি জানা আছে? কতিপয় জেএসএস বিরোধীকে নিয়ে চাঁদাবাজি করা যায়, জেএসএস-এর নেতা-কর্মীও খুন করা যায় বটে কিন্তু পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসন অর্জন করা সম্ভব নয়। এটাও একটা সত্য। তবে আত্মজিজ্ঞাসা বলে প্রসিত বাবুদের ডিকশনারীতে কোন কালে কোন শব্দ ছিল না। আর বারে বারে মার খাচ্ছে প্রসিত ঠিক এই জায়গাতে। নিজেদের ভুল-ত্রুটি সম্পর্কে কোন সময়েই তার আত্মবিশ্লেষণ নেই।

শান্তি চুক্তি করে জেএসএস যেমন মহান কিছু করে বসেনি তেমনি বড় কিছু খারাপওবা কী করেছে? যে আশা নিয়ে এতকাল অপরিসীম ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে আন্দোলন করে এসেছে সে অনুযায়ী জেএসএস কিছুই এনে দিতে পারেনি এই শান্তি চুক্তিতে একথা হয়তো অনেকেই বলবেন। কিন্তু চুক্তি করে জেএসএস জুম্ম জনগণের সাথে বেঈমানী করেছে, জুম্ম জনগণের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়েছে বলে আজ যারা সোচ্চার জুম্ম জনগণের স্বার্থ রক্ষায় অতীতে ও বর্তমানে অধিকার অর্জনের লড়াইয়ে তাদের ভূমিকাটাই বা কী ছিল কী আছে তা জানতে ইচ্ছে হয়। আন্দোলনের সুফল তো তারাই ভোগ করেছে এতকাল। এতকাল তারাই যারা আজ জেএসএসকে তুলোধুনো করতে ব্যতিব্যস্ত। আজ যে জনগণ তিলে তিলে আান্দোলনের কারণে সীমাহীন অত্যাচার নিপীড়ন সহ্য করেছে, চরম আত্মত্যাগ করেছে তারা তো জেএসএস এর উপর আজো আস্থা বিশ্বাস রেখে বাস্তব পরিস্থিতিকে মেনে নিয়েছে এবং সামর্থ অনুযায়ী জেএসএস এর আন্দোলনে সক্রিয়। জেএসএস নেতৃত্বের কাছেই সঁপে দিয়েছে তাদের ভাগ্য। এই অতি সাধারণ নিরীহ মানুষদের এই অসাধারণ ভূমিকার মূল্য সত্যিই মহান। এতকাল আন্দোলনে তারা কেবল দিয়েছে। হারিয়েছে সর্বস্ব। আমরা তাদের কিছুই দিতে পারিনি। এই শান্তি চুক্তিও না। আন্দোলনের কানাকড়ি সুফলও তারা পায়নি। অথচ খুবই দুঃখজনক হলেও সত্য যারাই এই আন্দোলনে সুফল ভোগ করেছে কানায় কানায় তারাই জেএসএস বিরোধীতায় এক পায়ে খাড়া। নিজের কর্মীদের না খাইয়ে লক্ষ টাকা খরচ করে উন্নত চিকিৎসা দিয়ে জীবন যাদের বাঁচিয়েছে পার্টি, উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছে, ছোট বড় অনেক চাকরি (পিয়ন, কেরানী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রদূত পর্যন্ত) বা ছোটখাট ব্যবসা সৃষ্টি করে দিয়েছে। দেশে বিদেশে উচ্চ শিক্ষার অসংখ্য বৃত্তি সবই তো আন্দোলনের ফল। মেম্বার, চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে এমপি, মিনিস্টার হতে সাহায্য করেছে যে পার্টি সেই পার্টিকে আজ তারাই লাথি মারছে। এর চেয়ে মর্মান্তিক পরিণতি কী হতে পারে? কথাগুলো খুব সহজ ভাষায় লিখছি বলে খারাপ লাগতে পারে কারো কারো।

যুক্তি তাদের অকাট্য। পার্টি জনগণের জন্য। কাজেই পার্টির টাকা মানেই জনগণের টাকা। সুতরাং জনগণের টাকা দিয়েই তারা যা করার করেছে। এতে পার্টির কাছে দায়বদ্ধতার কোন প্রশ্নই নেই। পার্টি নেতৃত্বের কাছে জি হুজুর করে পার্টির বশ্যতা মেনে নিয়ে দুহাতে জনগণের শুভেচ্ছা আত্মসাৎ করেছে এসমস্ত ছদ্মবেশী ভদ্র সন্তানেরা। এভাবেই এযাবত কৃতঘ্ন ভদ্রলোকেরা পার পেয়ে গেছে। শুধু পার পেয়েই ক্ষান্ত নন তারা পার্টিকে ধ্বংস করার সব রকমের চক্রান্তে সক্রিয়। এই ন্যাক্কারজনক ভূমিকা তাদের কেবল চুক্তির পরে নয় চুক্তির আগেও ছিল। তাই কেবল প্রসিত, সঞ্চয় বা রবি শঙ্করদেরই বলি কেন খোদ পার্টির গুটিকয় কর্মী এবং ছাত্রও পার্টি নেতৃত্বের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে এসেছে। শান্তি চুক্তির কিছুকাল অগেও প্রসিত বাবুরা পার্টির নিম্নস্তরের কর্মীদের মাঝে ভাঙন ধরাতে বান্দরবানের গহীন অরণ্যে গিয়ে চেষ্টা চালিয়েছে। এসব অপচেষ্টা ক্ষমার অযোগ্য। এরকম আরো অনেক অতি গোপন তথ্য জনগণ জানতে পারলে তাদের চরম মূল্য দিতে হবে বৈ কি! অথচ ভাবতে অবাক লাগে যে, তারাই আজ সমঝোতার গল্প শোনাচ্ছে। অতীতের জাতীয় শত্রুদের ন্যায় একদিকে যেমন অনাক্রমণ, ঐক্যফ্রন্ট ইত্যাদি চুক্তির প্রস্তাব দিচ্ছে অন্যদিকে জেএসএস নেতাকর্মীদের ধরে নির্মমভাবে হত্যা করে চলেছে এই পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসনকামী তথাকথিত দেশপ্রেমিকরা। অন্যদিকে চুক্তিপক্ষ আত্মরক্ষার্থে পাল্টা আক্রমণ করতে বাধ্য হচ্ছে। এই পাল্টা খুনোখনির মরণখেলায় প্রত্যক্ষ মদদ নিয়ে যাচ্ছে স্বনামধন্য এমপি মহোদয়রা। এরই সুযোগ নিয়ে নিজের আখের গুছিয়ে নিচ্ছে সামরিক-বেসামরিক কর্তৃপক্ষ আর সাধারণ প্রশাসনের সরাসরি সাহায্যে যার যার অবস্থান পাকাপোক্ত করে নিচ্ছে অনুপ্রবেশকারীরা। আর সরকার তো চুক্তি বাস্তবায়ন না করার সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে গেছে। এ মুহূর্তে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বয়ং ভগবান হাজির হলেও তিক্ততার অবসান বা সহিংসতার কোন সুরাহা করতে পারবে না। কারণ যারাই সহিংসতা প্রশমনে ভূমিকা রাখতে পারত তারাই সক্রিয় মদদ নিয়ে যাচ্ছে প্রসিতচক্রকে। আর যাই কোথায়। জুম্ম জাতের ভাগ্য এভাবেই কি ঘুরপাক খাবে? সবার মনে এই প্রশ্ন গভীরভাবে নাড়া দিচ্ছে।

জেএসএস এর বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগটা প্রসিত বাবুর দীর্ঘদিনের ছিল। যখনি দেখা করতে তাদের নিয়ে যাওয়া হতো তখন সম্মান, আন্তরিকতা, আদর, আপ্যায়নের কোন ত্রুটি থাকত না। ঢাকা বা চট্টগ্রাম যেখান থেকেই তাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে সর্বপ্রকার সামর্থ্য দিয়ে জীপ নতুবা কার ভাড়া করে রাজকীয় অতিথির মত করে নিয়ে যাওয়া হত। সুভাষ, সোহেল, যতনদের মত কেন্দ্রীয় অফিসের কর্মীরা কতদিন যে নাওয়া খাওয়াহীন অবস্থায় দীর্ঘ নৌপথ ভররোদে পুড়ে, ঝড়ে ভিজে এইসব ছাত্রনেতাদের অভ্যর্থনা দিয়েছে তা যদি প্রসিতের অনুগামী বন্ধুরা স্বচক্ষে দেখত তাহলে বুঝত কী সম্মান তারা পার্টির কাছে পেত। নজিরবিহীন ব্যবস্থাপনায় এবং নিরাপত্তা দিয়ে ভেনুতে যখন তারা পৌছে যেত শীতকাল হলে গরম পানিতে স্নান করতে দেয়া হত। সার্বক্ষণিক নিয়োজিত হত পার্টিকর্মী তাদের সুবিধার জন্য। মুখ ধোয়ার পানি এমনকি পায়খানা করার সময় বদনায় পর্যন্ত পানি ভরে দিত দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীরা। পার্টি প্রেসিডেন্ট শত ব্যস্ততার মধ্যেও তাদের সকল ব্যবস্থাপনায় তদারকি করতেন। আর প্রতি সকাল বিকাল ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ এবং ডিনারে দুর্লভ সব খাবার পরিবেশন করে আপ্যায়ন করত পার্টিকর্মীর মা বোনেরা। অরণ্যের শুকর, হরিণ পর্যন্ত শিকার করে প্রসিত বাবুদের রুচিসম্মত খাবার যোগাড় করা হত। ঢাকা চট্টগ্রামের নিত্যদিনের জীবনযাত্রায় যা যা প্রয়োজন টুথব্রাশ, টুথপেস্ট, সাবান, তোয়ালে থেকে শুরু করে যথাসম্ভব ব্যবস্থা করা হত তাদের জন্য যাতে তারা কষ্ট না পায়। নিজে কম খেয়ে, নিজের গরম কাপড় দিয়ে, নিজের মশারী দিয়ে তাদের যাতে কোন অসুবিধা না হয় সে ব্যবস্থা করে দিত পার্টি কর্মীরা। তাদের প্রতি যে সম্মান আর সুযোগ সুবিধা দেয়া হত তা পার্টির অন্য কোন উচ্চ পর্যায়ের নেতা কর্মীও পেত না। আলোচনা শেষে ফিরে যাবার সময় হাতে তুলে দেয়া হতো প্রয়োজনীয় ফান্ড। ছাত্র পরিষদ, গণ পরিষদ, হিল উইমেন্স ফেডারেশন এবং তাদের নিজস্ব নানা কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য যে বাজেট তারা নিয়ে আসত প্রতিবারই সেই বাজেটের অধিক দেয়া হত।

নিখাদ এই আন্তরিকতার মধ্যে একটাই প্রত্যাশা ছিল যে, এই ছাত্রনেতারা জুম্ম জনগণের জন্য কাজ করছে, পার্টির জন্য কাজ করছে এবং একদিন পার্টিতে যোগ দেবে। এরাই পার্টির পরবর্তী কর্ণধার হবে। অথচ বাস্তবতার কি চরম পরিণতি অথচ এই বন্ধুরাই পার্টির নেতাকর্মীদের অপহরণ করছে, নির্মমভাবে হত্যা করছে। পার্টি আজ তাদের প্রধান শত্রু। অপরাধ একটাই। তা হলো শান্তি চুক্তি কেন করলো পার্টি। যুদ্ধ কেন করলো না পার্টি। যুদ্ধ কাকে নিয়ে করবে পার্টি? ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৫ পার্টি আকুল আহ্বান জানায় শিক্ষিত ছাত্র-যুব সমাজের প্রতি সশস্ত্র সংগ্রামে যোগ দেয়ার। তখন প্রসিত বাবুদের নেতৃত্বে ছাত্র আন্দোলন তুঙ্গে উঠে এক পর্যায়ে গতানুগতিক ধারায় ভিন্নখাতে প্রবাহিত হতে থাকে। সম্ভবত শতকার ২ ভাগ ছাত্রও যোগ দেয়নি পার্টিতে তখন। সশস্ত্র সংগ্রামে যোগ দিতে কোন কালেই প্রসিত বাবুরা কাউকে উৎসাহিত করেনি। উল্টো ছাত্র-যুবকদের রাজপথের মিছিলে, মিটিংয়ে ব্যতিব্যস্ত রাখতে চেষ্টা করেছে। এর উদ্দেশ্য একটাই আর তা হলো ছাত্র-যুবকদের মাঝে নিজের ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করা এবং জেএসএসকে শক্তিশালী করতে না দেওয়া। কিন্তু দুর্ভাগ্য তা হয়নি। হয়েছে তার উল্টো। প্রসিত যেদিকে গেছে সেদিকে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে সংগঠন। ব্যাপক ছাত্র-যুবকদের নেতাও হতে পারেনি প্রসিত। জননেতা তো দূরে থাক। আর যাই হোক জেএসএস এর বিকল্প হয়ে গড়ে উঠা কোন আঞ্চলিক সংগঠন অপাততঃ নেই। ইউপিডিএফ তো নয়ই। অথচ এটাই আজ জরুরী। জেএসএস যদি কোন সময় দুর্বল হয়েও যায় জুম্ম জনগণের সামগ্রিক স্বার্থে জেএসএস এর ন্যায় একটি রাজনৈতিক প্লাটফরম খুবই দরকার। এবং এ ভূমিকাটাই রাখতো পারত চুক্তি বিরোধী চক্র।

(সমাপ্ত)

[বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই প্রবন্ধটি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার বিভাগ কর্তৃক ১০ই নভেম্বর ২০০০ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিম “১০ই নভেম্বর স্মরণে” সংকলন থেকে নেয়া হয়েছে।]

More From Author

+ There are no comments

Add yours