হিল ভয়েস, ৯ আগস্ট ২০২০, ঢাকা: আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল মুক্তিকামী মানুষকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)। তিনি আদিবাসীদের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষায় সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে এগিয়ে আসার এবং দেশের প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে অধিকতরভাবে আদিবাসী জনগণের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
আজ ৯ আগস্ট ২০২০ রবিবার বিকাল ৫টা থেকে শুরু হওয়া বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের ভার্চুয়াল আলোচনার প্রারম্ভে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সদস্য প্রমিলা মেইনথেইন ফোরামের সভাপতি শ্রী লারমার শুভেচ্ছা বার্তা পড়ে শুনান। ‘কিছু কথা’ শীর্ষক সন্তু লারমার শুভেচ্ছা বার্তা নিম্নে দেয়া গেল-
“বছর ঘুরে আমাদের মাঝে আবার এসেছে জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। এই মহান দিবসে আমি বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পক্ষ থেকে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল মুক্তিকামী মানুষকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। এ দিবসটি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নব চেতনায় উজ্জীবিত ও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দিন। বিশেষ অনুপ্রেরণার দিন।
এ বছর কোভিড ১৯ মহামারির কারণে ভিন্নভাবে হলেও বিশ্বের ৯০টি দেশের ৪০ কোটির অধিক আদিবাসী জনগণের মতো বাংলাদেশের আদিবাসীরাও আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস ৯ আগস্ট উদযাপন করছে জেনে আমি আনন্দিত। জাতিসংঘ ঘোষিত আদিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় “Covid-19 and Indigenous People’s Resilience”-এর সাথে সঙ্গতি রেখে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম এবছরের প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করেছে “কোভিড ১৯ মহামারি ও আদিবাসীদের জীবন-জীবিকার সংগ্রাম।” আমরা সবাই জানি, এই করোনাকালে আদিবাসী ও অন্যান্য প্রান্তিক মানুষ অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন অতিবাহিত করছে। সুচিকিৎসার অভাবসহ লকডাউনের কারণে নানা অর্থনৈতিক সংকটে এই প্রান্তিক মানুষেরা দুর্বিষহ জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে। সরকার বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা, দলীয় স্বজনপ্রীতি ও দুঃশাসনের ফলে প্রান্তিক মানুষ এসবের আশানুরূপ সুফল পাচ্ছে না। তাছাড়া প্রত্যন্ত পাহাড়ি ও আদিবাসী অঞ্চলে সরকারি ত্রাণ পর্যাপ্ত হারে পৌঁছাচ্ছে না। আমি করোনা মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসীদের জন্য বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা প্রদানের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই।
দুঃখের বিষয়, দেশে আজো আদিবাসী জনগণের মানবাধিকার পরিস্থিতি ভালো নয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আদিবাসীদের ভূমি জবরদখল ও তাদের চিরায়ত ভূমি থেকে উচ্ছেদ করার হীন উদ্দেশ্যে আদিবাসীদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা, ভূমি জবরদখল ও উচ্ছেদ, আদিবাসী নারীর উপর নির্যাতন ও সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু ২২ বছরেও মৌলিক বিষয়গুলো যথাযথভাবে বাস্তায়ন করেনি। বিশেষত ভূমি কমিশন পুরোপুরি অকার্যকর রয়ে গেছে। বহুবার দাবি তুলে ধরা সত্ত্বেও চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কার্যকর সময়সূচি ভিত্তিক পরিকল্পনা (রোডম্যাপ) ঘোষণা করা হয়নি। অস্থায়ী ক্যাম্পসহ অপারেশন উত্তরণ প্রত্যাহার করা হয়নি। ফলত আদিবাসী জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব আজ বিলুপ্ত প্রায় ও অনিশ্চিত।
বলাবাহুল্য বাংলাদেশ বহু জাতির, বহু ভাষার, বহু সংস্কৃতির বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ। এ দেশে বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠী ছাড়াও ৩০ লক্ষাধিক আদিবাসী মানুষ স্মরণাতীত কাল থেকে বসবাস করে আসছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে তাদের জীবন, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও আশা-আকাঙ্ক্ষ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আদিবাসী জনগণের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। বাংলাদেশের কোটি কোটি জনগণের সঙ্গে তারা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশের আদিবাসী জাতিসমূহের ভাষা ও সংস্কৃতি এদেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যময়তাকে করেছে সমৃদ্ধ। বন, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, ভূমি ও পাহাড়-প্রকৃতি নিয়েই আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ গড়ে উঠেছে। আদিবাসীদের জীবন ও সংস্কৃতি পরিবেশ বান্ধব। কিন্তু উদ্বেগের বিষয়, আজ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রবল আগ্রাসনে তথা বিশ্বায়নের প্রবল জোয়ারে তাদের সেই পরিবেশবান্ধব সংস্কৃতি ও জীবনধারা বিপন্ন হতে চলেছে।
আজ আদিবাসী দিবসে আমি আদিবাসীদের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষায় সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই। পাশাপাশি আদিবাসী দিবসে দেশের প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে অধিকতরভাবে আদিবাসী জনগণের পাশে দাঁড়ানোর আবেদন জানাই।
পরিশেষে এ দেশের শোষিত, নিপীড়িত ও বঞ্চিত আদিবাসীসহ বিশ্বের অধিকার-বঞ্চিত সকল মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এগিয়ে চলুক, এই কামনা করি।
জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা, সভাপতি, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, ৯ আগস্ট ২০২০।”