হিল ভয়েস, ৮ আগস্ট ২০২০, বান্দরবান: বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে জমি দখলের জন্য ৩টি ম্রো পাড়ার ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পরিবারগুলোর অভিযোগ, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ ও মেরিডিয়ান কোম্পানীসহ বিভিন্ন রাবার কোম্পানীগুলো এই হুমকি দিয়ে চলেছে।
যদি পরিবারগুলো উচ্ছেদ না হয়ে না যায় তাহলে ম্রো গ্রামবাসীদের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের ভয় দেখানো হচ্ছে। এদিকে গত বছর ২০১৯ সালে বান্দরবান জেলা প্রশাসক ও লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে ম্রো পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পরও এখনও তারা সুবিচার পায়নি কিংবা তাদের জমি উদ্ধার করে দেয়া হয়নি বলে জানা যায়।
এদিকে সরই ইউনিয়নের ঢেঁকিছড়া নতুনপাড়ার কার্বারি (পাড়াপ্রধান) রেংইয়েন ম্রো বলেন, ইউনিয়নের ডলুছড়ি মৌজার ঢেঁকিছড়া এলাকায় তাঁরা বংশ পরম্পরায় বসবাস করে আসছেন। ৪৮টি পরিবারের মধ্য দুই বছর আগে রাবার কোম্পানীগুলোর হয়রানি ও হুমকিতে ১৪টি পরিবার ঢেঁকিছড়া নতুন পাড়ায় চলে যায়। আর ১৬টি পরিবার বেশ কয়েক বছর ঢেঁকিছড়া নোয়াপাড়ায় বাস করছে।
তিনি আরো জানান, ‘যুগ যুগ ধরে জুমচাষ করে আসছে এসব ম্রো পরিবারগুলো। পাড়ার আশপাশের জুমের জমিগুলো এখন লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ ও মেরিডিয়ান কোম্পানী মিলে আমাদের পূর্বপুরুষদের ভোগদখলীয় জমিগুলো জবরদখল করেছে। কোম্পানির লোকজনগুলো আমাদেরকে পাড়া ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। পাড়া ছেড়ে না গেলে আমাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া হবে এবং লোকজন এসে আমাদেরকে হামলা করবে বলে তাদের জানানো হয়েছে’।
কার্বারিসহ চারজন পাড়াবাসীর স্বাক্ষরে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত আবেদনের প্রেক্ষিতে একসময় লামা উপজেলা সদরস্থ পুলিশ ক্যাম্পে তাঁদের কয়েকজনকে ডাকা হয়। সেসময় পুলিশের পক্ষ থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে তাঁদের পাড়া ছেড়ে চলে যেতে মৌখিক নির্দেশ দেওয়া হয়। চলে না গেলে পাড়াবাসীকে উচ্ছেদ করে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের জমি দখলমুক্ত করা হবে বলে তাঁদের জানানো হয়।
জানতে চাইলে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপক আরিফ হোসেন প্রতিবেদক জানান, ১৯৮৮-৮৯ সালে রাবার বাগানের জন্য ইজারা নেওয়া জমিতে ম্রোরা অবৈধভাবে বসবাস করছে। শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাদের পাড়া ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য বলা হয়েছে। কোনো হুমকি দেওয়া হয়নি। সেখানে কোম্পানির ৬৪ জন শেয়ারহোল্ডারের ১ হাজার ৬০০ একর জমির মধ্যে ম্রোদের দখলে ৬০০ একর জমি রয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
কয়েকজন কার্বারি বলেন, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের কোনো কোম্পানির জমি সরই ইউনিয়নে নেই। এ বিষয়ে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের আরিফ হোসেন ও মোঃ সেলিম, আলতাফ হোসেন, আবু দাউদ, দেলোয়ার হোসেন বলেন ব্যক্তির নামে জমি ইজারা নিয়ে শেয়ারহোল্ডাররা কোম্পানিকে দিয়েছেন।
ঢেকিঁছড়া নতুন পাড়ার রেংইয়েন ম্রো (কার্বারী) জানান, লামা উপজেলায় কয়েকটি রাবার কোম্পানী মিলে আমাদের ভোগদখলীয় জায়গা-জমি ও বাগান দখল করেছে। তার মধ্যে লামা উপজেলায় লামা রাবার ইন্ডাষ্ট্রিজ ১ হাজার ৬ শ একর, মেরিডিয়ান কোম্পানী ৩ হাজার একর ও লামা কোয়ান্টাম কসমো স্কুলের নামে ৩ হাজার ৫ শ একর জমি দখল করা হয়েছে। তাদের বাধা, হয়রানি ও হুমকির কারণে আমরা জুম চাষ, বাগান-বাগিচা, ঘরবাড়ি নির্মাণ কিছুই করতে পারছি না।
ডলুছড়ি মৌজার হেডম্যান (মৌজাপ্রধান) যোহন ত্রিপুরা বলেন, ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও সরকার ও ইজারাদারদের মধ্যকার ইজারা চুক্তি অনুযায়ী ইজারা নেওয়া জমিতে ১০ বছরের মধ্যে রাবার বাগান সৃজন করা না হলে ইজারা চুক্তি বাতিল হিসেবে গণ্য হবে। ১৯৮৯ সালে নিয়ে ২৮ বছরেও বাগান না হওয়ায় ওই ইজারা এমনিতেই বাতিল হয়ে যায়। এ জন্য তিনি গত বছর বান্দরবান জেলার জেলা প্রশাসকের কাছে ওই ইজারা জমি মৌজা দখলে নিয়ে আসার আবেদন করছিলেন।
এদিকে ম্রোদের পাড়া ত্যাগ না করতে বলেছেন বান্দরবানের জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিক। এই বিষয়টি লামা উপজেলার নির্বাহী অফিসার নূরে জন্নাত রুমিকে সরেজমিনে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্হা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
মামলার ভোক্তভোগী ইয়ংরিং ম্রো জানান, লামা রাবার কোম্পানীগুলো আমাদের বিরুদ্ধে লামা থানায় মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে। মামলায় আসামী করা হয়েছে ২০/৩০ জনকে। যাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের নতুন পাড়া ঢেকিঁছড়ার ১. রেংইয়েন ম্রো (কার্বারী), পিতা মৃত লাইপুং ম্রো, ২. চাকো ম্রো, পিতা- অজ্ঞাত, ৩. ইয়ংরিং ম্রো,পিতা রেংইয়েন ম্রো, ৪ রেংরুম ম্রো, পিতা রেংয়েন ম্রো, ৫. নালে ম্রো, পিতা এময় ম্রো, ৬. ইংয়ংরিং ম্রো, পিতা নালে ম্রোসহ আরো ৮/৯ জন অজ্ঞাতনামা।
তিনি আরো জানান, আমরা এখন আতংকে দিনযাপন করছি। কোম্পানীর লোকজন যে কোন মুহুর্তে আমাদের উপর হামলা করতে পারে। তারা বর্তমানে আমাদের দখলকৃত জায়গা-জমির মধ্যে রুপিত বাঁশ-গাছ কাটা ও চাষাবাদের কাজে বাধা দিচ্ছে।
লামায় বনখেকো গং কর্তৃক কালু ম্রো পাড়ার পাড়া বন ধ্বংস, আতংকে গ্রামবাসী
একদল বনখেকো ব্যক্তি কর্তৃক বান্দরবানের লামা উপজেলার গজালিয়া ইউনিয়নের ডলুছড়ি মৌজার দুর্গম কালু ম্রো পাড়ার ‘পাড়াবন’-এর জায়গা দখল ও সেখান থেকে গাছ বাঁশ কেটে নেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ওই পাড়ার বাসিন্দারা। পাড়া বনের জায়গা ও পাড়া বন রক্ষায় সংশ্লিষ্টদের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন ম্রোরা। পাড়ার কার্বারী মাং রু ম্রো জানিয়েছেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে বিচার দিয়েও তারা প্রতিকার পাচ্ছেন না।
মাং রু ম্রো আরো জানান, ‘দেড় শত বছর যাবৎ কয়েক পুরুষ ধরে ওই এলাকায় তাদের বসবাস। পাড়ার আশপাশের পাড়া বনের গাছ ও বাঁশ দিয়ে চলে তাদের জীবন-জীবিকা। তাদের রয়েছে জায়গার কাগজপত্র। তারপরেও তারা তদের ভূমি রক্ষা করতে পাচ্ছে না।’
পাড়া বন হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে জীব বৈচিত্র্য, পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষিত এক বিস্তীর্ণ বনভূমি। পানির উৎস সংরক্ষণ, পাহাড়িদের জীবন-জীবিকা থেকে শুরু করে সব কিছুতেই পাড়া বনের গুরুত্ব অপরিসীম এবং অপরিহার্য।
কালু ম্রো পাড়ার বাসিন্দা ক্রং পং ম্রো সহ অনেকে জানান, ‘প্রায় মাস দুয়েক ধরে পাহাড়ের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বন ধ্বংস করা হচ্ছে। অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও মৌজার হেডম্যান হ্লাথুই মং মার্মার ছেলে সুইক্যাছা মারমা, ব্যবসায়ী মো. ইউনুস, বেলাল এবং মো. ইলিয়াস আমাদের পাড়া বনটি ধ্বংস করে দিচ্ছে। গাছ-বাঁশ পাচারকারীরা নির্বিচারে পানির উৎস নষ্ট করে দিচ্ছে। পানি ছাড়া দুর্গম এই পাহাড়ে আমরা কিভাবে টিকে থাকব? পাচারকারীরা দুটো হাতি দিয়ে নিয়মিত গাছ টানছে।’
পাড়াবাসী আরো বলেন, ‘আমরা ইউনিয়ন পরিষদ এবং উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানকে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলাম, কিন্তু তারা আমাদের কোন সাহায্য না করে বন ধ্বংসকারীদের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে আমাদের পাড়া বন থেকে প্রায় ছয় হাজার বাঁশ এবং প্রায় ৪০টি বড় গর্জন গাছ কেটে নিয়ে গেছে।’
কার্বারী মাং রু ম্রো আরো বলেন, ‘আমাদের পাড়ায় ৩৪ জন সদস্য নিয়ে ৭টি পরিবারের বাস। প্রায় মাস তিনেক আগে আমাদের পাড়ায় চরম খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। পাড়াবাসীর খাবারের ব্যবস্থা হয়েছিল এই পাড়া বনের কয়েকটি গাছ বিক্রি করেই। খাদ্য সঙ্কটসহ পাড়াবাসী যে কোনো বড় ধরনের সমস্যার মুখোমুখী হলে পাড়া বনটি সবসময় আমাদের সুরক্ষা করে। এছাড়া আমরা প্রতিবাদ করতে চাইলে গাছ পাচারকারীরা আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করেছে।‘
এই বিষয়ে সুইক্যাছা মার্মা বলেন, ‘মুরুংরা অনেক জায়গা দখল রেখেছে। আমি হেডম্যান রিপোর্ট নিয়ে জায়গা দখল করেছি। আমি আমার জায়গা থেকে গাছ-বাঁশ কাটছি।’ আত্মপক্ষ সমর্থন করে অভিযুক্ত মো. ইলিয়াস বলেন, ‘আমি কোনো গাছ, বাঁশ কাটিনি।’
এলাকার চেয়ারম্যান মিন্টু কুমার সেন এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘পাড়ার লোকেরাই অতিরিক্ত জায়গা দখল করে আছে। যেখান থেকে বাঁশ-গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে সেই জায়গাটি পাড়া বন নয়।’
লামা উপজেলা চেয়ারম্যান মো. মোস্তফা জামাল বলেন, ‘মূলত মৌজার হেডম্যান বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনকে বন্দোবস্তীর প্রতিবেদন দেওয়ার কারণেই সমস্যাগুলো তৈরি হচ্ছে।’
লামা বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এস এম কাইচার বলেন, ‘হাতি দিয়ে পাড়াবন থেকে গাছ পাচার খুব দুঃখজনক, আমি দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছি।’