সাঁওতাল বিদ্রোহ: নিপীড়িতের মাঝে দ্রোহের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ

         খোকন সুইটেন মুরমু            

৩০ জুন ২০২০ সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৬৫তম বর্ষপূর্তি। ১৮৫৫ সালের এই দিনে ভারতীয় উপমহাদেশের নিপীড়িত আদিবাসী জনগণের মাঝে দ্রোহের এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গের বীজ বপন করেন বীরভান্টা (শহীদ) সিধু মাঝি ওরফে মুরমু। পরাধীন ভারতে আদিবাসী সাঁওতালদের এই বিদ্রোহ স্বাধীনতাকামী জনগণের কাছে ছিল এক পথ প্রদর্শনা।

দু:খের বিষয় যে, উপমহাদেশে সিপাহী বিদ্রোহের ভিত গড়ে দেওয়া সাঁওতাল বিদ্রোহ আজ ভারতীয় ইতিহাসে সঠিক স্থান পায়নি।কোম্পানির পদলেহনকারী ইংরেজ জমিদার, জোতদার ও মহাজনেরা আজ নিজ নিজ দেশ পেলেও সাঁওতালরা এখনো দেশহীন। কোথাও বা তারা আজ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোথাও উপজাতি আবার কোথাও জনজাতি। এসব প্রত্যয় সাঁওতালদের জন্য মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়। আসলে কি সাঁওতাল বিদ্রোহ সাঁওতালদের জন্য সার্থক হয়েছিল? নাকি তারা ম্যাকায়াভেলির উটোপিয়ার সেই ক্রীতদাস যাদেরকে পায়াস’রা শুধুই ভাড়া খাটাবে।

যাহোক, একজন সাঁওতাল হিসেবে আজকে আমি সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট আলোচনা করতে পেরে গর্বিত। এবং সেই সাথে বর্তমান বাংলাদেশে সাঁওতালসহ অন্যান্য ৫৪টির অধিক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার অবস্থারও পর্যালোচনা করব। আলোচনার ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকারের কাছে পরে কিছু সুপারিশ তুলে ধরব।

সাঁওতাল বিদ্রোহের পটভূমি:

‘হুল’ একটি সাঁওতালি শব্দ যার অর্থ বিদ্রোহ। সাঁওতাল বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিল বর্তমান ভারতের ঝাড়খন্ড, বিহারের ভাগলপুর ও পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ এলাকায়। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্ণয়ালিশের প্রর্বতিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে তাদের উপর অত্যাচারের মাত্রাহয় দ্বিগুণ। তৎকালীন ইংরেজ সরকারের দেশীয় জমিদার, মহাজন, নীলকর, সুদখোর ও ইংরেজ কর্মচারীদের জুলুম ও অন্যায়ের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে সাঁওতালরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করেন। সাঁওতালদের সাথে যোগ দিয়েছিল কামার, তেলি, কর্মকার, চামার, ডোম, মোমিন সম্প্রদায়ের গরীব মুসলমান ও গরিব হিন্দু জনসাধারণ।

১৮৫৫ সালের ৩০ জুন বর্তমান ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের সাঁওতাল পরগণার ডুমকা জেলার বারহেড থানার অন্তর্গত ভগনাডিহি গ্রামের মাঠে ৩০ হাজার সাঁওতাল সমবেত হয়। ‘ঢৗরউয়ৗক’ বা এই সমাবেশের আহ্বান জানিয়েছিল ভগনাডিহির চনু মৗঞ্জহির ছেলে সিধু মৗঞ্জহি। ব্রিটিশ শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে এবং স্থানীয় প্রশাসনের কাছে বিচার না পাওয়ার কারণে সমাবেশে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বড়লাটের কাছে নালিশ করার। এই সমাবেশ থেকে সাঁওতালরা পায়ে হেঁটে গণ-পদযাত্রা শুরু করে কলিকাতার অভিমুখে। ভারতীয় উপমহাদেশে এটাই প্রথম গণ-পদযাত্রা। পরে ইংরেজ সরকারের দেশীয় জমিদার, নীলকর ও মহাজনদের চক্রান্তের কারণে এই পদযাত্রা যুদ্ধে রূপ নেয়। এই গণ-বিদ্রোহ সূচনা করেছিল সিপাহী বিদ্রোহের ভিত।

১৮৫৫-১৮৫৬ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত এই বিদ্রোহ বিস্তৃত হয়। সাঁওতালরা দেশীয় তীর-ধনুক নিয়ে যুদ্ধ করলেও ইংরেজ বাহিনীর হাতে ছিল অত্যাধুনিক কামান ও বন্দুক। দেশীয় জমিদারদের প্রদান করা হাতি এবং অশ্বারোহীও ব্যবহার করেছিল ইংরেজরা। বিদ্রোহের অন্যতম নেতা সিধু মুরমু অপর তিন ভাই কানু, চাঁদ, ভৈরব সহ দুই বোন ফুলমনি ও ঝানমনি শহীদ হলে ধীরে ধীরে এই বিদ্রোহ স্তিমিত হয়ে পড়ে।

রাজনৈতিক পটভূমি:

উপমহাদেশে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম-সমাজ ধ্বংসের সূত্রপাত ঘটায়। পলাশীর যুদ্ধের পূর্বে উপমহাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনায় মধ্যস্বত্বভোগী অনুপস্থিত ছিল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত উপমহাদেশের সনাতন জীবনধারার গতিরোধ করে সমাজ জীবন অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ফেলে। এই বন্দোবস্ত ইংরেজ শাসনের বহুমুখী উদ্দেশ্য সাধন করেছিল- (১) ঔপনিবেশিক শাসনের স্থায়ীত্ব বৃদ্ধি; (২) শিল্প পুঁজির কাঁচামাল ভারতীয় উপমহাদেশ হতে সংগ্রহ; (৩) ক্রমবর্ধমান কৃষক বিদ্রোহ হতে ইংরেজ শাসকদের রক্ষা করার জন্য জমিদার নামক শ্রেণিকে জমির বন্দোবস্ত দিয়ে চড়া হারে রাজস্ব আদায় এবং সমস্ত অপকর্মের স্থায়ী সঙ্গী হিসেবে ব্যবহার করা।

ইংরেজ সৃষ্ট ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা উচ্ছেদ জমিদারের কখনও কাম্য ছিল না। কারণ লুন্ঠিত সম্পদের উচ্ছিষ্ট জমিদারেরাও ভোগ করত। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদারের খাজনা ও মহাজনদের চক্রবৃদ্ধি ঋণের বোঝা শোধের পর সাঁওতালদের ভাগ্যে যেটুকু ফসল জুটত তা দিয়ে স্ত্রী, পুত্র-কন্যা ও পিতা-মাতাকে নিয়ে বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। সাঁওতালদের জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিসহ। জমিদারেরা মহাজন, ঠগবাজ ও লুন্ঠনকারীদের প্রশ্রয় দিল সাঁওতাল অঞ্চলে ব্যবসা করার।

সামাজিক পটভূমি:

১৮৩২ সালে রাজমহল পাহাড়ের পাদদেশে সাঁওতালরা বসবাস স্থাপন করে। ‘দামিন-ই-কোহ’ নামে পরিচিত এই অঞ্চল ছিল ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ। ঘন জঙ্গল পরিস্কার করে হিংস্রর জীবজন্তুর সাথে লড়াই করে সাঁওতালরাই প্রথম এই অঞ্চলে চাষের জমি তৈরি করে। অনাড়ম্বর পরিবেশে সনাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে ভালই চলছিল সাঁওতালদের জীবন। কৃষিকাজ, বনজ পরিবেশে ফলমূল সংগ্রহ এবং বিনিময় প্রথার মাধ্যমে তারা দিন অতিবাহিত করত। কোম্পানির শাসনের পরিধি ধীরে ধীরে বিহারের আশেপাশের জঙ্গল অবধি বিস্তৃত লাভ করে।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কায়েমের মাধ্যমে জমিদাররা জঙ্গলের মালিক হলো। সাঁওতালরা ‘দামিন-ই-কোহ’ বসবাসযোগ্য করে তুললেও এই আইনের ফলে রাতারাতি তারা হয়ে যায় প্রজা। জমিদারদের শাসনে এই এলাকার বিনিময় প্রথা ভেঙ্গে পড়ে। প্রচলিত হয় মুদ্রাভিত্তিক বাজার ব্যবস্থা। গ্রামীণ সরল ও অশিক্ষিত সাঁওতালরা মুদ্রা ভিত্তিক এই ক্রয়-বিক্রয়ে হয়ে পড়ে দিশেহারা। মুদ্রা ব্যবস্থার সাথে সাথে সাঁওতালি এলাকায় প্রবেশ করে মহাজন, ফড়িয়া ও দালাল শ্রেণির ব্যবসায়ী। সাঁওতালরা মুদ্রা ব্যবস্থা বুঝে উঠার আগেই অল্প মূল্যে ফসল ক্রয় ও দাদন দেওয়ার প্রলোভনে তারা শুরু করে অবাধ লুন্ঠন।

অর্থনৈতিক পটভূমি:

ইংরেজ কোম্পানি শাসনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রয়োগের ফলে জন্ম নেয় মধ্যবর্তী শোষক ও নতুন আর্থিক রীতি। ফলে বহু শ্রমের মাধ্যমে গড়ে তোলা সাঁওতালদের গ্রামীন অর্থনীতি ও জন-উৎপাদনে ব্যঘাত ঘটে। সাঁওতাল বিদ্রোহের মূল কারণ গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো তাদের পরিবর্তিত উৎপাদন পদ্ধতি ও ভেঙ্গে পড়া আর্থিক রীতি। গো-শকট নৌকা ইত্যাদির পরিবহনের মাধ্যমে সাঁওতালদের মেনতে উৎপন্ন ধান, সরিষা ইত্যাদি মুর্শিদাবাদ, কলিকাতা এমনকি খোদ ইংল্যান্ডে রপ্তানি হতে শুরু হয়। কৃষি পদ্ধতির উপর গড়ে ওঠা সাঁওতালদের গ্রামীন অর্থনীতি ধ্বংসের ফলে লাভবান হতে শুরু করেন ইংরেজ কোম্পানি ও তাদের দেশীয় দোসরদের, যেমন- জমিদার, মহাজন ও সুদখোরদের।

শিক্ষিত কিছু প্রতারকেরাও দলে দলে উপস্থিত হতে থাকে সাঁওতাল পরগণায়। সাঁওতালদের ঠকানোর জন্য ঠগ ও অসাধু হিন্দু ব্যবসায়ীরা দু’ধরনের দাড়িপাল্লা ব্যবহার করত। যেমন: গরীব সাঁওতাল যখন হাটে তার জিনিষপত্র নিয়ে আসতো তখন মাপা হত মাপের চেয়ে বড় পাল্লায়। নকল তালা লাগানো কৌটায় মেপেও তাদের ঠকানো হতো। আর লবন, তেল ইত্যাদি দ্রব্যাদি কিনতে গেলে, ব্যবসায়ীরা তা হালকা ভরের বাটখারা দিয়ে ওজন করতো। প্রতিবাদ করলে নয়-ছয় বুঝিয়ে দেওয়া হত। নব্য এই শ্রেণি সাঁওতালদের কাছে পণ্যসামগ্রী কম দামে কিনে এবং প্রবঞ্চনা করে রাতারাতি ধনীক শ্রেণিতে পরিণত হয়।

সাংস্কৃতিক পটভূমি:

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদাররা হয়ে যায় সাঁওতালদের নিজ হাতে তৈরি বসতির মালিক। জমিদার আবার সেগুলো লিজ দিতেন জায়গিরদার বা জোতদারদের। সে সাথে সাঁওতালদের চিয়ায়ত কৌম প্রথার বিলুপ্তি ঘটে। সাঁওতলদের স্ব-শাসন পদ্ধতি; মৗঞ্জহি পরিষদ (গ্রাম পরিষদ), পারগানা পরিষদ (কতিপয় গ্রাম মিলে যে পরিষদ) ও দেশ মৗঞ্জহি (সারা সাঁওতাল পরগণা মিলে যে পরিষদ) ভেঙ্গে পড়ে। মৗঞ্জহি ব্যবস্থা ছিল সাঁওতালদের শক্তিশালী গ্রামীন সংস্কৃতির প্রধান অঙ্গ। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সাঁওতালদের মৗঞ্জহি, পারগাণা ও দেশ মৗঞ্জহিরা রাতারাতি ক্ষমতা, যশ, প্রতিপত্তি ও সম্পদ সব হারিয়ে ফেলে।

সাঁওতাল জীবনে ছন্দ পতন শুরু হয়। আগে তাদের আহারের সমস্যা ছিল না। নিজের তৈরি করা জমিতে উৎপাদিত ফসলে তাদের অন্ন যোগাত। খরা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগেও তারা বন থেকে খাদ্য আহরন করতে পারত। নিজেদের শাসন ব্যবস্থায় তারা আমোদ-প্রমোদে সময় কাটাতে পারত। নিজেদের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যসমূহ, ধর্মীয় উৎসব, বিবাহ ও শেষকৃত্য তারা নিজেদের মতই পালন করত। জমিদার, মহাজন, হিন্দু টাউট ব্যাবসায়ীরা সাঁওতালদের চিয়ায়ত সংস্কৃতিতেও আঘাত হানে।

সাঁওতাল বিদ্রোহের সার্থকতা:

সাঁওতালদেরকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে, জমিদার ও মহাজনদের সাথে ঠগ ও টাউটেরাও রাতারাতি সাঁওতাল এলাকায় গড়ে তুলেছিল নিজেদের রাজ-প্রসাদ দু:শাসন। ফলশ্রুতিতে সংগঠিত হয় সাঁওতাল বিদ্রোহ। সাঁওতাল বিদ্রোহই পরাধীন ভারতবর্ষে স্বাধীনতার বীজ বপন করেছিল। চাপের মুখে ইংরেজ সরকার বাধ্য হয় সাঁওতালদের অভিযোগ তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করতে। তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট এডন সাহেব সাঁওতালদের সমস্যা শুনেন। এবং তদন্ত কমিটির কাছে রিপোর্ট পেশ করেন। তদন্ত সাপেক্ষে ব্রিটিশ সরকার, ‘সান্তাল পরগণা টেন্যান্সি এ্যাক্ট ১৮৫৫’ পাশ করতে বাধ্য হন।

এ আইনে সরকার সাঁওতালদের জন্য সাঁওতাল পরগণা বরাদ্দ করেন। সাঁওতালদের স্বশাসন পদ্ধতিকে সম্মান জানিয়ে মৗঞ্জহি, পারগাণা ও দেশ মৗঞ্জহিদের ক্ষমতা প্রদান করেন। এ আইনে সাঁওতাল পরগণায় সরকারি আধিকারিক ও পুলিশেরা ইচ্ছামাফিক কোন আইন সাঁওতালদের উপর চাপিয়ে দিতে পারেন না। নিজেদের বিচার সালিশ সাঁওতালরা নিজেই করতে পারেন। আইনের ফলে সাঁওতালরা নিজেরাই জমির খাজনা ডেপুটি কালেক্টরের কাছে দিতে পারেন।

সাঁওতাল বিদ্রোহ বর্তমান প্রেক্ষাপট:

বিদ্রোহের পরে সাঁওতালরা হয়ে পড়ে দেশান্তরিত। ইংরেজ সৈন্যরা প্রায় ৫০ হাজারের বেশি সাঁওতাল গ্রাম গুড়িয়ে দেয় এবং ৩০ হাজারের অধিক সাঁওতাল হত্যা করেন। সৈন্যরা সাঁওতাল বিদ্রোহী ছাড়াও নারী ও শিশুদের হত্যা করেন। এ বিদ্রোহে পরাজয় সাঁওতালদের মুক্তির সংগ্রামকে স্তিমিত করে। বিদ্রোহের পরে ‘সান্তাল পরগণা টেন্যান্সি এ্যাক্ট ১৮৫৫’ গঠিত হলেও তারা পরাধীনতার নাগপাশে আবদ্ধ হয়। ইংরেজদের দেশীয় দোসর জমিদার, মহাজন, ঠিকাদার ও ধর্মীয় ব্যবসায়ীদের স্থলে তাদের পাশে সাহায্যের হাত ধরে আসে বিদেশী ধর্মীয় ব্যবসায়িরা।

দিশেহারা সাঁওতাল ধর্মীয় ব্যবসায়িদের ফাঁদে পা দিতে বাধ্য হন। এ ধর্মীয় ব্যবসায়িরা ইংরেজদের পরবর্তী এজেন্ডা বাস্তবায়নে ইংরেজদের সহায়তা করে। নিজের বাসভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে সাঁওতালরা ধর্মীয় ব্যবসায়ীদের আশ্বাসে ইংরেজ শাসিত আসাম, বাঙলা, আন্দামান, মরিসাস ও ফিজিতে পাড়ি জমায়। বেশিরভাগ সাঁওতাল এবার সম্পূর্ণভাবে ইংরেজদের ধর্মীয় ক্রীতদাসে পরিণত হয়। কেউ কেউ নিজেদের মত করে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে।

সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৬৫তম বছর পরেও সাওঁতালরা আজ নিজ দেশে পরাধীন। তাই তো খোদ ঝাড়খন্ডে গত ১২ জুন ২০২০ বিদ্রোহের নেতা সিধু মুরমু’র বংশধর রামেশ্বর মুরমু প্রাণ দিতে হয়। ঘাতক সাদ্দাম আনসারিকে আজও গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়না। ঠিক সেভাবেই বাংলাদেশেও সাঁওতালরা আজও নির্যাতিত, নিপীড়িত, অত্যাচারিত ও ধর্ষিত হচ্ছে। এর ফলে ২০০০ সালে ৪ আগস্ট নওগাঁর ভীমপুরে সাম্প্রদায়িক হামলা ও আলফ্রেড সরেন খুন; ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি দিনাজপুরের চিড়াকুটায় সাম্প্রদায়িক হামলা; ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর  গাইবান্ধা জেলার বাগদা ফার্মে পুলিশের গুলিতে তিন সাঁওতাল নিহত সহ কোন ঘটনার আজও পর্যন্ত সুষ্ঠু তদন্ত ও সংঘটনকারীদের বিচার হয়নি।

‘সান্তাল পরগণা টেন্যান্সি এ্যাক্ট ১৮৫৫’ এর আদলে প্রণয়নকৃত ‘ইস্ট ইন্ডিয়া টেন্যাসি এ্যাক্ট ১৯৫০ সালের ধারা ৯৭’ বাংলাদেশে এখনও বর্তমান। কিন্তু এই আইনকে পাশ কাটিয়ে ভূমি অফিসের কিছু অসাধু চক্র ও ভূমি খেকোরা সাঁওতালসহ বাংলাদেশের আদিবাসীদের জমি প্রতি নিয়তই কেড়ে নিচ্ছে। ফলে উত্তরবঙ্গের ৯০ শতাংশ আদিবাসী জনগণ আজ ভূমিহীন। তাছাড়া ভারতবর্ষে সাঁওতালদের জন্য পার্লামেন্টে রিজার্ভ সিট থাকলেও বাংলাদেশের পার্লামেন্টে আদিবাসীদের জন্য নেই কোন রির্জাভ সিট।

সুপারিশসমূহ:

এমতাবস্থায় উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদেরা আইন প্রণয়নের জায়গায় কোন আওয়াজ তুলতে পারছে না এবং বঞ্চিত থাকছে। বাংলাদেশে সাওঁতাল সহ অন্যান্য আদিবাসীরা যাতে নিজেদের অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে জীবন অতিবাহিত করতে পারে তার জন্য নিম্নের সুপারিশগুলো তুলে ধরছি-

১. আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে।

২. দখলী শর্তে সরকারি খাস, জমিদারী খাস ও দীর্ঘদিন যাবত বসবাসরত বাস্তুভিটা আদিবাসীদেরকে আইনগত মালিকানা দিতে হবে।

৩. আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এবং বাংলা ও ইংরাজীর পাশাপাশি আদিবাসী শিশুদেরকে নিজ ভাষায় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা চালু করতে হবে।

৪. অবৈধ, জাল ও বেদখলকৃত সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারি খরচে আইনগত সহায়তা দিতে হবে।

৫. সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিশেষ সুযোগ ও চাকরির ক্ষেত্রে কোটা কার্যকর করতে হবে।

৬. ছিন্নমূল আদিবাসীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।

৭. অর্পিত সম্পত্তি আইন বাতিল করতে হবে এবং এই আইনের কারণে যে সকল সম্পত্তি আদিবাসীদের হাতছাড়া হয়েছে তা যথাযথভাবে উত্তরাধিকারীদের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে।

৮. প্রতিটি জেলায় আদিবাসী সাংস্কৃতিক একাডেমী প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

৯. আদিবাসীদের উপর সকল প্রকার নির্যাতন ও অন্যায়-অত্যাচার বন্ধ করতে হবে। আলফ্রেড সরেন হত্যা মামলা, বাগদা-ফার্মে তিন সাঁওতাল হত্যা মামলা সঠিক তদন্ত বাস্তবায়ন ও অপরাধীদের সঠিক বিচার করতে হবে।

১০. সমতল আদিবাসীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন করতে হবে।

১১. জাতীয় বাজেটে আদিবাসীদের জন্য পর্যাপ্ত ও সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ প্রদান করতে হবে।

১২. সমতল আদিবাসীদের ভূমির উপর অধিকার রক্ষা ও বেহাত হওয়া জমি পুনরুদ্ধারের জন্য বিশেষ ভূমি কমিশন গঠন করতে হবে।

১৩. সংরক্ষণের ভিত্তিতে আদিবাসীদের জন্য সংসদে ও স্থানীয় সরকার পরিষদে আসন সংরক্ষণ করতে হবে।

বি:দ্র: গত ২৮ জুন ২০২০ তারিখে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ কর্তৃক “৩০ জুন: মহান সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৬৫তম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনলাইন আলোচনা”য় প্রবন্ধটি পঠিত।

খোকন সুইটেন মুরমু: জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও কাপেং ফাউন্ডেশনে প্রকল্প সম্বন্বয়কারী। যোগাযোগ: ksmurmu@gmial.com

More From Author