হিল ভয়েস, ১২ জুন ২০২০, রাঙ্গামাটি: আজ কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৪ বছর পূর্ণ হচ্ছে। ২৪ বছরেও বাংলাদেশ রাষ্ট্র কল্পনা চাকমার হদিশ দিতে পারেনি। এই জঘন্য ঘটনার সাথে কাউকে বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারেনি সরকার। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর অপকর্মের যথাযথ বিচার ও দেশে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগের সরকারের এটা একটা চরম ব্যর্থতা।
উল্লেখ্য যে, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন দিবাগত রাতে রাঙ্গামাটি জেলাধীন বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউলাল্যাঘোনা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমাকে পার্শ্ববর্তী কজইছড়ি সেনাক্যাম্পের কমান্ডার লেঃ ফেরদৌসের নেতৃত্বে একদল ভিডিপি ও সশস্ত্র দুর্বৃত্ত কর্তৃক নির্মমভাবে অপহরণ করা হয়।
কল্পনা অপহরণ ঘটনার প্রতিবাদে হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের উদ্যোগে ডাকা ২৭ জুন ১৯৯৬ অর্ধদিবস সড়ক অবরোধ চলাকালে আবার তৎকালীন বাঘাইছড়ি সেনা কর্তৃপক্ষের মদদে স্থানীয় ভিডিপি ও সেটেলারদের সাম্প্রদায়িক হামলায় বাবুপাড়া ও মুসলিম ব্লক এলাকায় গুলি করে রূপন চাকমাকে এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে সুকেশ, মনোতোষ ও সমর বিজয় চাকমাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
কল্পনা অপহরণ ঘটনার পর দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রতিবাদ ও নিন্দার মুখে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আব্দুল জলিলের নেতৃত্বে ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করলেও বিগত ২৪ বছরেও সরকার সেই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি।
অপহরণ ঘটনার পরপরই কল্পনার বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমার অভিযোগ স্থানীয় বাঘাইছড়ি থানায় মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হওয়ার প্রায় ১৪ বছর পর ২০১০ সালের ২১ মে ঘটনার বিষয়ে পুলিশের চূড়ান্ত তদন্ত রিপোর্ট পেশ করা হলেও সেই রিপোর্টে অভিযুক্ত ও প্রকৃত দোষীদের সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়। ফলে বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা আদালতে উক্ত চূড়ান্ত রিপোর্টের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদন দাখিল করেন।
এরপর আদালতের নির্দেশে একে একে চট্টগ্রাম জোন সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তা, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার কয়েকজন পুলিশ সুপার রাঙ্গামাটির চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একের পর এক ‘তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন’ দাখিল করেন। নামে এগুলো ‘তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন’ হলেও বাস্তবে তদন্তে কোন কিছুই অগ্রগতি নেই।
সর্বশেষ কল্পনা অপহরণ মামলার বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা ইতোমধ্যে উক্ত ৩৯তম তদন্তকারী কর্মকর্তার চূড়ান্ত প্রতিবেদন এবং মামলার কার্যক্রম বন্ধ রাখার সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করে আদালতে নারাজি আবেদন দাখিল করেছেন এবং উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত করে যথাযথ বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন।
এরপর থেকে আদালত একের পর এক শুনানির দিন ধার্য করলেও পুলিশ এ বিষয়ে বার বার প্রতিবেদন দাখিলে অপারগতা প্রকাশ করে ক্রমাগত সময় চাইতে থাকেন। এভাবে সরকারের তরফ থেকে সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের প্রতি রাষ্ট্রের বিচারহীনতার একটি হীন দৃষ্টান্ত। এটাই এ দেশের নারী সমাজের প্রতি রাষ্ট্রের চরম অবহেলা ও বঞ্চনার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের ঘোষিত ‘জিরো টলারেন্ট’ নীতির এটি একটি জঘন্য পরিহাস!
এটাই দেশের দুর্বল ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি রাষ্ট্রের বৈষম্য ও উপেক্ষার খন্ডচিত্র। এটাই অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রতি রাষ্ট্রের নির্লজ্জ দায়মুক্তির জ্বলন্ত প্রমাণ। এটাই আঙ্গুল দিয়ে প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য দেয় সামরিক যাঁতাকলে চরমভাবে পিষ্ট জুম্ম অধ্যুষিত এই পার্বত্য চট্টগ্রাম।
এটাই প্রমাণ করে যে, ভূমি বেদখল, জুম্মদেরকে জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণ, সর্বোপরি জুম্ম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত পরিণত করার জন্য জঘন্য হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে জুম্ম নারীর উপর জঘন্য সহিংসতা, অপহরণ, ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যা করার মতো নৃশংসতাকে।
আরও উল্লেখ্য যে, শুধু কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনা নয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধান এবং পার্বত্য অধিবাসীদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরও চুক্তিটি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ায় বিশেষত সেটেলার বাঙালি ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা বহু জুম্ম নারী যৌন নিপীড়ন ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন।