প্রীতিবিন্দু চাকমা
আশি দশকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগই পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলে আসছিল। তাই নব্বইয়ের গণঅভ্যূত্থানে জেনারেল এরশাদ সরকারের পতনের পর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ আওয়ামী লীগকেই সমর্থন দিয়ে আসছিল। স্বভাবতই ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ সরকারের সাথে যখন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, দেশবাসী ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়সহ জুম্ম জনগণ আশা করেছিল এবার বুঝি পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান হতে চলেছে।শেখ হাসিনার প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রেখে এই আশায় বুক বেঁধেছিল যে, এবার শত শত বছরের অবহেলা ও বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে জুম্ম জনগণ তার হৃত অধিকার ফিরে পাবে। কিন্তু পার্বত্য চুক্তির ২৩ বছরের মাথায় এসে জুম্ম জনগণের সেই প্রত্যাশা আজ সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৭ সালে ব্যাপক ঢাকঢোল পিটিয়ে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের পরাকাষ্ঠা সেজে দেশবাসী ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সাক্ষী রেখে যে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন, তিনি তা যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করলেন না। পার্বত্য চুক্তিতে যে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক অধিকার স্বীকার করে নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য তিনি যে রাজনৈতিক অঙ্গীকার করেছিলেন, তা তিনি বাস্তবায়নে কোনও উদ্যোগই নিলেন না। পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের নামে একের পর এক গালভরা বুলি ঠিকই আওড়ালেন, কিন্তু তা বাস্তবায়নে ধারে কাছেও গেলেন না। তাহলে তিনি যেই হোন না কেন, তার এই ভূমিকা বা আচরণকে রাজনৈতিক ভন্ডামি, প্রতারণা ও বেঈমানি ছাড়া আর কী বলার থাকে?
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর প্রায় ২৩ বছর অতিক্রান্ত হতে চললো। তার মধ্যে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের ৫ বছর ও ড. ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বাধীন ২ বছর বাদ দিলে চুক্তি স্বাক্ষরের পরে এ পর্যন্ত প্রায় ১৬ বছর ধরে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরকারী শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় রয়েছে। এই দীর্ঘ ১৬ বছরে সরকার পার্বত্য চুক্তির কম গুরুত্বপূর্ণ নানা ধারা-উপধারা বাস্তবায়ন করেছেন বটে, কিন্তু চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ নিলেন না। চুক্তির যে মৌলিক বিষয়সমূহের উপর পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান নির্ভর করে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বশাসিত বিশেষ শাসনব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে সেই মৌলিক বিষয়সমূহ রেখে দিলেন একেবারেই অবাস্তবায়িত অবস্থায়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অবাস্তবায়িত মূল বিষয়সমূহের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণে আইনী ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা; পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, পর্যটন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদিসহ রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও কার্যাবলী হস্তান্তর করা; নির্বাচন বিধিমালা ও ভোটার তালিকা বিধিমালা প্রণয়ন পূর্বক তিন পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়ন এবং আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা; ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামক একপ্রকার সেনাশাসনসহ সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা; ভূমি কমিশনের মাধ্যমে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করে বেহাত হওয়া জুম্মদের জায়গা-জমি ফেরত দেয়া; ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তদের তাদের স্ব স্ব জায়গা-জমি প্রত্যার্পণ পূর্বক পুনর্বাসন প্রদান করা; অস্থানীয়দের প্রদত্ত ভূমি ইজারা বাতিলকরণ; পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল চাকরিতে জুম্মদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়োগ করা; চুক্তির সাথে সঙ্গতি বিধানকল্পে পুলিশ এ্যাক্ট, পুলিশ রেগুলেশন ও ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য অন্যান্য আইন সংশোধন; পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সেটেলার বাঙালিদের সম্মানজনক পুনর্বাসন করা ইত্যাদি অন্যতম। এসব মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে গড়িমসি করে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরকারী শেখ হাসিনা সরকার একে একে ১৬টি বছর ক্ষেপণ করেছে।
বস্তুত পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা সরকারের প্রবঞ্চনা ও টালবাহানার প্রথম অপচেষ্টা লক্ষ্য করা যায় চুক্তি মোতাবেক যখন ১৯৯৮ সালে এপ্রিল-মে মাসে জাতীয় সংসদে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন প্রণয়ন করা হচ্ছিল সেই সময়। কথা ছিল খসড়া আইনগুলোর উপর মতামত গ্রহণের জন্য প্রথমে জনসংহতি সমিতির নিকট পাঠানো হবে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে জনসংহতি সমিতির নিকট প্রেরণ না করে খসড়া আইনগুলো এপ্রিল মাসে সরাসরি জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়ে থাকে। দেখা গেলো, সেই আইনগুলোতে চুক্তির সাথে অন্তত চারটি বিরোধাত্মক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, যেগুলো চুক্তিতে স্বীকৃত এখতিয়ার ও অধিকারকে মারাত্মকভাবে খর্ব করেছিল। এর বিরুদ্ধে জনসংহতি সমিতি তাৎক্ষণিকভাবে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। উভয়পক্ষে বিশেষ বৈঠকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে উক্ত বিরোধাত্মক বিষয়সমূহ সংশোধন করা হবে। তা সত্ত্বেও সরকার কর্তৃক চারটি বিরোধাত্মক ধারার মধ্যে তিনটি সংশোধন করা হলেও উন্নয়ন সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ ধারাটি অসংশোধিত অবস্থায় থেকে যায়।
এরপর দেখা দেয় অন্তর্বর্তীকালীন আঞ্চলিক পরিষদ গঠন নিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের চুক্তি লঙ্ঘন। সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে অলিখিত চুক্তির মধ্যে অন্যতম একটি ছিল, অন্তর্বর্তীকালীন আঞ্চলিক পরিষদ জনসংহতি সমিতি গঠন করবে।তদনুসারে জনসংহতি সমিতি অন্তর্বর্তীকালীন আঞ্চলিক পরিষদের সদস্যদের নামের তালিকা সরকারের নিকট পেশ করে। কিন্তু প্রস্তাবিত সদস্যদের মধ্যে অউপজাতীয় (বাঙালি) তিনজন সদস্যকে বাদ দিয়ে জনসংহতি সমিতির সাথে আলোচনা ছাড়া আওয়ামী লীগের মনোনীত অপর তিনজন অউপজাতীয় সদস্যদের সমন্বয়ে সরকার ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮ অন্তর্বর্তী আঞ্চলিক পরিষদ গঠনের গেজেট প্রকাশ করে। শেখ হাসিনা সরকারের এই চুক্তি বিরোধী কার্যকলাপের কারণে অন্তর্বর্তীকালীন আঞ্চলিক পরিষদের দায়িত্বভার গ্রহণে অন্তত ৮ মাস পিছিয়ে পড়ে। এভাবেই শেখ হাসিনা সরকার চুক্তি ভঙ্গের ধারাবাহিক প্রক্রিয়া শুরু করতে থাকে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে ভারত-প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থীদের ন্যায় আভ্যন্তরীণ জুম্ম (উপজাতীয়) উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের বিধান রয়েছে। কিন্তু যখন ভারত প্রত্যাগত ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু চিহ্নিতকরণ ও পুনর্বাসন সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের মাধ্যমে আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের কার্যক্রম শুরু হয়, তখন শেখ হাসিনা সরকার পার্বত্য চুক্তিকে লঙ্ঘন করে সেটেলার বাঙালি মুসলমানদেরকেও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবে গণ্য করে পার্বত্য চট্টগ্রামের পুনর্বাসনের জন্য চুক্তি বিরোধী প্রস্তাব উত্থাপন করে।যদিও অলিখিত চুক্তি অনুযায়ী অউপজাতীয় সেটেলারদের পার্বত্য অঞ্চলের বাইরে সন্মানজনকভাবে পুনর্বাসনের বিধান ছিল।এতে জনসংহতি সমিতি ও জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ সমিতি বিরোধিতা করলেও চুক্তি লঙ্ঘন করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের স্পেশাল এ্যাফেয়ার্স বিভাগ থেকে ১৯ জুলাই ১৯৯৮ তারিখের এক আদেশ জারি করা হয়, যেখানে আভ্যন্তরীণ উপজাতীয় উদ্বাস্তুদের সাথে সেটেলার বাঙালিদেরও পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসনের নির্দেশনা ছিল। জনসংহতি সমিতি ও জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ সমিতির প্রতিবাদ ও ওয়াকআউটের মধ্যেও ১৫ মে ২০০০ অনুষ্ঠিত টাস্ক ফোর্সের একাদশ সভায় সরকার পক্ষ অবৈধ ও একতরফাভাবে ৯০,২০৮ উপজাতীয় পরিবার এবং ৩৮,১৫৬ অউপজাতীয় সেটেলার পরিবারকে আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবে ঘোষণা করে। শেখ হাসিনা সরকারের চুক্তি বিরোধী এই উদ্যোগের ফলে আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া মুখ থুবড়ে পড়ে, ফলে জুম্ম উদ্বাস্তুরা এখনো দুর্গম পাহাড়ে ও রিজার্ভ ফরেস্টে শিক্ষা, চিকিৎসা, উন্নয়ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়া সত্ত্বেও সরকার সেটেলার বাঙালি মুসলমানদের পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসনের উক্ত চুক্তি পরিপন্থী আদেশ এখনো বাতিল করেনি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর চুক্তি মোতাবেক জনসংহতি সমিতি ৪৫ দিনের মধ্যে সমিতির সদস্যদের আওতাধীন সকল অস্ত্র ও গোলাবারূদ সরকারের নিকট জমা দেয় এবং সমিতির সশস্ত্র শাখা বিলুপ্তির ঘোষণা দেয়। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘদিনের রক্তাক্ত সংঘাতের অবসান ঘটে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আশি দশকে কাউন্টার ইনসার্জেন্সী কার্যক্রম হিসেবে জারিকৃত ‘অপারেশন দাবানল’ এর পরিবর্তে শেখ হাসিনা সরকার পার্বত্য চুক্তিকে লঙ্ঘন করে ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে একতরফাভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামে একপ্রকার সেনাশাসন জারি করে এবং ‘শান্তকরণ প্রকল্প’ নামে অপর আরেকটি কাউন্টার-ইনসার্জেন্সী কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। শান্তকরণ প্রকল্পের অধীনে পূর্বের মতো সেনাবাহিনীকে ১০ হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ দেয়া হতে থাকে। সেটেলারদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে পুনর্বাসনের পরিবর্তে সেনাবাহিনী উক্ত বরাদ্দসেটেলারদের গুচ্ছগ্রাম সম্প্রসারণ, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যয় করতে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিবাস্তবায়নে সিভিল প্রশাসনের সহায়তার নামে জারিকৃত ‘অপারেশন উত্তরণ’-এর ক্ষমতা বলে সেনাবাহিনী কার্যত পার্বত্যচট্টগ্রামের সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, ভূমি প্রশাসন, উন্নয়ন কার্যক্রম, বিচার ব্যবস্থাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল বিষয় ওকার্যাবলী নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব করতে থাকে। অথচ পার্বত্য চুক্তিতে সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের বিধান রয়েছে। কিন্তু বিগত ২৩বছরে শেখ হাসিনা সরকার মাত্র শ খানেক অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করেছে। এখনো ৪ শতাধিক অস্থায়ী ক্যাম্প পার্বত্য চট্টগ্রামে বলবৎ রয়েছে। বর্তমানে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে প্রধান বাধা হিসেবে রয়েছে এই ‘অপারেশ উত্তরণ’ নামক সেনাশাসন ও চার শতাধিক অস্থায়ী ক্যাম্পের সেনা কর্তৃত্ব। এভাবে খোদ শেখ হাসিনা সরকারই প্রতি পদে পদে পার্বত্য চুক্তি লঙ্ঘন ও খর্ব করতে থাকে, যা জনসংহতি সমিতি তথা জুম্ম জনগণের সাথে চরম প্রতারণা ও বেঈমানীর সামিল বলে বিবেচনা করা হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার অন্যতম দিক হচ্ছে পার্বত্যাঞ্চলের ভূমি সমস্যা। ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ সরকার সরকারি অর্থায়নে সমতল জেলাগুলো থেকে চার লক্ষাধিক বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতিপ্রদান করে। পার্বত্য চট্টগ্রামে চাষযোগ্য ভূমির অভাবের কারণে সেটেলারদেরকে কার্যত জুম্ম জনগণের ভোগদখলীয় ও রেকর্ডীয় ভূমির উপর বসতি প্রদান করা হয়। যুগ যুগ ধরে বসবাসরত জুম্মদের উচ্ছেদ করে তাদের চিয়ারত জায়গা-জমি ও বসতভিটা দখল করে নেয় সেটেলাররা। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় এক জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ড। পার্বত্য চুক্তিতে জুম্মদের বেহাত হওয়া এসব জায়গা-জমি ফেরত প্রদানের জন্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত একটি ভূমি কমিশনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির বিধান করা হয়। ভূমি কমিশনের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে সেটেলাররা যদি বেদখলকৃত জায়গা-জমি জুম্ম মালিকদের নিকট ফেরত দিতে বাধ্য হয়, তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সেটেলারদের পুনর্বাসনের কার্যক্রমেও সহায়ক হবে। এমনটাই ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অন্যতম একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
কিন্তু পার্বত্য চুক্তির অব্যবহিত পরে পৌনে চার বছর ধরে ক্ষমতায় থাকলেও শেখ হাসিনা সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন প্রণয়নে টালবাহানা করতে থাকে। অবশেষে সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার প্রাক-মুহুর্তে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রাক্কালে তড়িঘড়ি করে ২০০১ সালের ১৭ জুলাই জনসংহতি সমিতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সাথে কোনরূপ আলোচনা না করে শেখ হাসিনা সরকার ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১’ জাতীয় সংসদে পাশ করে। ফলে চুক্তিতে স্বীকৃত অধিকার ও এখতিয়ারকে খর্ব করে উক্ত আইনে কমপক্ষে ১৪টি ধারা চুক্তির সাথে বিরোধাত্মকভাবে প্রণীত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে শেখ হাসিনা সরকারের এটা ছিল সবচেয়ে বড় প্রতারনা ও উদ্দেশ্য-প্রণোদিতভাবে সৃষ্টি করা মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা। আইনটি যথাযথভাবে প্রণীত না হওয়ায় কার্যত পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার অন্যতম প্রধান ইস্যু ‘ভূমি সমস্যা’ নিরসনের কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ে। ২০০৯ সালে পুনরায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ফিরে আসার পর শেখ হাসিনা সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১-এর বিরোধাত্মক ধারা সংশোধন করতে আবার নানা টালবাহানা করতে থাকে। টালবাহানা করে শেখ হাসিনা সরকার ৮ বছর ধরে সময়ক্ষেপণ করে। অবশেষে ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে আইনটি সংশোধন করা হয়।
কিন্তু এরপর শেখ হাসিনা সরকার আবার ভূমি কমিশনের বিধিমালা প্রণয়নে বিগত ৪ বছর ধরে টালবাহানা করে চলেছে। ভূমি কমিশনের বিধিমালার খসড়া তৈরি করে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের তরফ থেকে ০১ জানুয়ারি ২০১৭ ভূমি মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকার এখনো সেই বিধিমালা চূড়ান্ত করেনি। ভূমি কমিশনের এই বিধিমালা এখনো পর্যন্ত প্রণীত না হওয়ায় ভূমি কমিশন ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির বিচারিক কাজ শুরু করতে পারেনি। এভাবে পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কেবল আইন ও বিধিমালা প্রণয়নে শেখ হাসিনা সরকার বিশ বছর পার করে দিচ্ছে। বিগত ২০ বছরেও ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়ার একদিকে জুম্মদের মধ্যে সরকারের উপর চরম ক্ষোভ ও হতাশা দেখা দিয়েছে, অন্যদিকে ভূমি বিরোধকে কেন্দ্র করে সরকার ও জুম্ম জনগণ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি-বাঙালির মধ্যে প্রতিনিয়ত দ্বন্দ্ব-সংঘাত দেখা দিতে থাকে। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে এভাবে শেখ হাসিনা সরকারের প্রতিবন্ধকতার ফলে ভূমি সমস্যা সমাধান বর্তমানে কার্যত সম্পূর্ণভাবে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি-বাঙালি (উপজাতীয় ও অউপজাতীয়) স্থায়ী বাসিন্দাদেরকে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভার সুপারিশের ভিত্তিতে স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র প্রদানের ক্ষমতা অর্পণ করা হয় তিন সার্কেল চীফের উপর।তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনে উক্ত বিধান যথাযথভাবে সন্নিবেশও করা হয়। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকার পার্বত্য চুক্তি ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনকে সম্পূর্ণভাবে লঙ্ঘন করে ২১ ডিসেম্বর ২০০০ তারিখে একটি অফিস আদেশের মাধ্যমে তিন সার্কেল চীফ ছাড়াও তিন পার্বত্য জেলার ডেপুটি কমিশনারদের স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র প্রদানের ক্ষমতা অর্পণ করে। জাতীয় সংসদে প্রণীত একটি সংসদীয় আইনকে লঙ্ঘন করে এধরনের অফিস আদেশ জারি করা অবৈধ ও আইনের বরখেলাপ হলেও শেখ হাসিনা সরকার নির্লজ্জভাবে সেই কাজ সম্পন্ন করে। বার বার দাবি করা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা সরকার এই অবৈধ ও চুক্তি বিরোধী আদেশ বাতিল করেনি। এই আদেশের ফলে ডেপুটি কমিশনাররা রোহিঙ্গাসহ বহিরাগত লোকদেরকে পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র দিয়ে চলেছেন এবং এই সনদপত্রের বদৌলতে বহিরাগতরা পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকরি, ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি, ভূমি মালিকানাসহ নানাবিধ সুবিধা লাভ করে চলেছে, যা পার্বত্য চুক্তির সাথে সম্পূর্ণ বিরোধাত্মক।
প্রসঙ্গত ইহাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে স্থানীয় পর্যটন অর্থাৎ পার্বত্য জেলার পর্যটন বিষয়টি ২০১৪ সালে শেখ হাসিনা সরকার তিন পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহের নিকট হস্তান্তরিত করে নামমাত্র এখতিয়ার দিয়ে। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের বাঅন্য কোন সংস্থার দ্বারা পরিচালিত কোন দপ্তর ও পর্যটন কেন্দ্র পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহের নিকট হস্তান্তরিত হয়নি। কেবল পার্বত্য জেলা পরিষদের নিজস্ব অর্থায়নে গৃহীত পর্যটন প্রকল্প ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের এখতিয়ার রাখা হয়নি, যা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সাথে সম্পূর্ণভাবে বিরোধাত্মক। জনসংহতি সমিতি ও আঞ্চলিক পরিষদের তরফ থেকেবার বার আপত্তি করা সত্ত্বেও সরকার পর্যটন বিষয়টি যথাযথভাবে হস্তান্তরের কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। পক্ষান্তরে পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ও আঞ্চলিক পরিষদ আইন লঙ্ঘন করে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা ও কর্তৃপক্ষ, সেনাবাহিনী ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান জুম্মদের জায়গা-জমি জবরদখল করে তিন পার্বত্য জেলায় পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনা করে চলেছে। যার ফলে স্থানীয় জুম্মদের জীবন জীবিকা বিপন্ন হয়ে পড়ছে এবং নানাভাবে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সমস্যা উদ্ভব হচ্ছে।
তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকারের সাথে আনুষ্ঠানিক বৈঠক চলাকালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে পার্বত্য চুক্তির সাংবিধানিক গ্যারান্টি প্রদানের দাবি করা হয়েছিল। তখন সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছিল যে, আওয়ামীলীগ সরকারের জাতীয় সংসদে সংবিধান সংশোধনের মতো দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। তাই তাদের পক্ষে তৎসময়ে পার্বত্য চুক্তিকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা সম্ভব হবে না। তবে ভবিষ্যতে সংবিধান সংশোধনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে সরকার সেই সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে শেখ হাসিনা সরকার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর শেখ হাসিনা সরকারের নিকট যথারীতি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে সাংবিধানিক গ্যারান্টির দাবি উত্থাপন করে জনসংহতি সমিতি। বিশেষ করে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীকালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আলোকে প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনগুলোর ‘আইনী হেফাজত’ প্রদানের জন্য সংবিধানের প্রথম তফসিলে ‘কার্যকর আইন’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি করা হয়। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকার সেই দাবির প্রতি বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেনি। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ‘২৩ক’ নামে “উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়” সংক্রান্ত একটি নতুন অনুচ্ছেদ সংযোজন করা হয়েছিল বটে, তবে তার দ্বারা পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক প্রণীত আইনগুলোর সাংবিধানিক রক্ষাকবচ নিশ্চিত হয়নি।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা অধিকতর জটিল আকার ধারণ করে যখন জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদের আমলে চার লক্ষাধিক বাঙালি মুসলিমকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি প্রদান করা হয়। শেখ হাসিনা সরকারের সাথে আনুষ্ঠানিক সংলাপ চলাকালে সেটেলারদের অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার দাবি করা হলে সরকারের তরফ থেকে জনসংহতি সমিতিকে বলা হয় যে, সরকার সেটেলার বাঙালিদের অন্যত্র সরিয়ে নিতে নীতিগতভাবে সম্মত। তবে চুক্তিতে সরাসরি সেটেলারদের প্রত্যাহারের বিষয়টি লেখা হলে তা দেশে চরম প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। তাই চুক্তিতে লিপিবদ্ধ না করলেও সরকার সেটেলারদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনকভাবে পুনর্বাসন প্রদান করবে বলে শেখ হাসিনা সরকার সমঝোতা করে। কিন্তু সরকার অলিখিত চুক্তি অনুযায়ী সেটেলারদের সমতলে পুনর্বাসনের ব্যাপারে এযাবৎ কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বরঞ্চ বহিরাগত সেটেলারদের অবস্থান আরও সুদৃঢ় ও সম্প্রসারণ করতে থাকে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সেটেলার মুসলমানদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনক পুনর্বাসনের জন্য দুই পক্ষের মধ্যে অলিখিত চুক্তি/সমঝোতা ছিল। শেখ হাসিনা সরকার এ বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করবে বলে জনসংহতি সমিতিকে বার বার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। উল্লেখ্য যে, ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ ঢাকায় পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধিদলের সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাতের সময়ও শেখ হাসিনা এ বিষয়ে পূর্ণ প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সেটেলার বাঙালিদের পুনর্বাসনের বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বরাদ্দকৃত অর্থ সাহায্যের কথা উঠলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, এক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থ সাহায্যের দরকার হবে না। সরকারি অর্থেই অনায়াসে বহিরাগত সেটেলারদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনকভাবে পুনর্বাসন করা সম্ভব হবে বলে তিনি দৃঢ়মত ব্যক্ত করেন। এছাড়া জুম্ম শরণার্থীদের সাথে স্বাক্ষরিত ২০-দফা প্যাকেজ চুক্তিতেও বলা হয় যে, সকল জায়গা-জমি প্রত্যর্পণ করে জুম্ম শরণার্থীদের পুনর্বাসন করা হবে।তদুদ্দেশ্যে প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থীদের জায়গা-জমি ও গ্রাম থেকে সেটেলার বাঙালিদের অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু চুক্তির পর শেখ হাসিনা সরকার এ বিষয়ে কোন উদ্যোগই গ্রহণ করেনি। উপরন্তু এ ধরনের অলিখিত চুক্তির কথা শেখ হাসিনা সরকার বেমালুম অস্বীকার করতে থাকে, যা ছিল পারষ্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে একটা বড় ধরনের প্রতারণা ও বেঈমানীর সামিল। ফলে প্রত্যাগত শরণার্থীদের ৪০টি গ্রাম এখনো সেটেলারদের দখলে রয়ে যায় এবং ১২ হাজারের অধিক প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী পরিবারের মধ্যে ৯ হাজারের অধিক পরিবারের ভূমি হস্তান্তর করা হয়নি।
জুম্ম শরণার্থীদের সাথে শেখ হাসিনা সরকারের স্বাক্ষরিত ২০-দফা প্যাকেজ চুক্তি মোতাবেক প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থীদের জায়গা-জমি থেকে সেটেলার বাঙালিদের অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার পরিবর্তে শেখ হাসিনা সরকারের আমলেই ২০০০ সালে নিরাপত্তা বাহিনীর সহায়তায় পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় খাগড়াছড়ি জেলার সদর ও মহালছড়ি উপজেলার গামারীঢালা, বিজিতলা, নুনছড়ি, পাগুজ্যাছড়ি, কাটিং টিলা, লেমুছড়ি, জয়সেন কার্বারী পাড়া ইত্যাদি জায়গায় জুম্মদের রেকর্ডীয় ও ভোগদখলীয় জায়াগা-জমি জবরদখল করে সেটেলারদের গুচ্ছগ্রাম সম্প্রসারণ করা হয়েছিল। পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক পার্বত্যাঞ্চলের ভূমি সমস্যার সমাধানের পরিবর্তে চুক্তি-উত্তর সময়ে শেখ হাসিনা সরকারই এভাবে ভূমি সমস্যা আরো জটিল করে তুলে। পার্বত্য চুক্তি ও ২০-দফা প্যাকেজ চুক্তি লঙ্ঘন করে সেটেলারদের গুচ্ছগ্রাম সম্প্রসারণ বন্ধ করার জন্য জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট তুলে ধরলেও তিনি কোন পদক্ষেপই গ্রহণ করেননি।
শেখ হাসিনা সরকারের প্রহসন ও প্রতারণার অন্যতম নজীর হলো স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে তিন পার্বত্য জেলার ভোটার তালিকা প্রণয়নে সম্পূর্ণ বিরত থাকা। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য শেখ হাসিনা সরকার বিগত ১৬ বছরে নির্বাচন বিধিমালা ও ভোটার তালিকা বিধিমালা প্রণয়নের কোন উদ্যোগই গ্রহণ করেনি। ১৯৯৯ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের পক্ষ থেকে পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন বিধিমালা ও ভোটার তালিকা বিধিমালার খসড়া প্রস্তুত করে শেখ হাসিনা সরকারের কাছে পেশ করা হয়েছিল। জনসংহতি সমিতি ও আঞ্চলিক পরিষদের পক্ষ থেকে বিধিমালা চূড়ান্তকরণের বিষয়টি বার বার তুলে ধরা হলেও চুক্তির অব্যবহিত পরে পৌণে চার বছরে শেখ হাসিনা সরকার উক্ত বিধিমালা প্রণয়নে কোন কার্যকর উদ্যোগ তো গ্রহণই করেনি, ২০০৯ সালে পুনরায় ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পরও বিগত ১২ বছরে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ফলে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর ২৩ বছর ধরে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। পক্ষান্তরে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত পূর্ণাঙ্গ পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠনের পরিবর্তে শেখ হাসিনা সরকার দলীয় সদস্যদের দিয়ে অন্তর্বর্তী পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠন করে চলেছে। উপরন্তু জনসংহতি সমিতি তথা পার্বত্যবাসীর বিরোধিতা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা সরকার অন্তর্বর্তী পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য-সংখ্যা পাঁচ থেকে ১৫ জনে বৃদ্ধি করে একতরফাভাবে ২০১৪ সালে ৬ মাসের মধ্যে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন সংশোধন করেছে। এছাড়া সব চেয়ে প্রণিধানযোগ্য যে এর ফলে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত পরিষদ গঠন ও কার্যকর করা এবং তার মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিত্বশীল পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা বর্তমানে সুদূর পরাহত হয়ে পড়েছে। এভাবেই আজ শেখ হাসিনা সরকার আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদকে কার্যত অচল ও অথর্ব করে রেখে দিয়েছে, যা পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বশাসিত বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনে শেখ হাসিনা সরকারের অসদিচ্ছারই প্রতিফলন ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হয়।
অন্তর্বন্তী পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান-সদস্য হিসেবে অধিক সংখ্যক দলীয় সদস্য নিয়োগ প্রদানের স্বার্থে শেখ হাসিনা সরকার পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ৬ মাসের মাসের মধ্যে অতি দ্রুততার সাথে সংশোধন করলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিকপরিষদের “পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ প্রধান কার্যালয়, বাসভবন ও এতদসংশ্লিষ্ট কমপ্লেক্স নির্মাণ শীর্ষক” প্রকল্পের অনুমোদন ও বাস্তবায়নের কাজ বিগত দুই দশক ধরে ঝুলে রেখে দিয়েছে। দুই দশক পর অতি সম্প্রতি প্রকল্পটি এটনেকে অনুমোদিত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের অবকাঠামো এখনো গড়ে উঠেনি। এভাবে শেখ হাসিনা সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান আঞ্চলিক পরিষদকে অচল ও অথর্ব অবস্থায় রেখে দিয়েছে।
প্রসঙ্গত ইহাও বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসন ব্যবস্থার সর্বোচ্চ সংস্থা হচ্ছে আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ। এই পরিষদ সমূহে সাধারণ প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলার দায়িত্ব ও ক্ষমতা ন্যস্ত রয়েছে। বলাবাহুল্য, পরিষদসমূহ সক্রিয় ও কার্যকর করতে হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য বিভিন্ন আইন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই সংশোধন করতে হবে, অন্যথায় পরিষদসমূহ অকার্যকর অবস্থায় থেকে যাবে। তাই পার্বত্য অঞ্চলের সাধারণ প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলার দায়িত্ব ও ক্ষমতা যাতে আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ প্রয়োগ করতে না পারে সেজন্য শেখ হাসিনা সরকার ১৯০০ সালের শাসনবিধি, ১৮৬১ সালের পুলিশ এ্যাক্ট, ১৯২৭ সালের বন আইনসহ পার্বত্য অঞ্চলে প্রযোজ্য আইনসমূহ সংশোধন করতে কোন উদ্যোগ নেয়নি। বরঞ্চ তিন পার্বত্য জেলার ডেপুটি কমিশনার ও পুলিশ সুপারকে সরকার সুরক্ষিত রেখে তাদের মাধ্যমে জেলার সাধারণ প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা সেনা কর্তৃত্বের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় জুম্ম জনগণের বিরুদ্ধে অপপ্রয়োগ করে চলেছে, যা পার্বত্য চুক্তির সাথে বিরোধাত্মক।
পার্বত্য চুক্তির প্রতি শেখ হাসিনা সরকারের আরেক বড় চুক্তি-পরিপন্থী কার্যক্রম হলো চুক্তি লঙ্ঘন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ১১ নির্দেশনা জারি করা। ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কোন দেশী-বিদেশী ব্যক্তি/সংস্থা কর্তৃক পার্বত্য অঞ্চলে আদিবাসী জুম্মদের (সরকারি ভাষায় উপজাতীয়দের) সাথে সাক্ষাতের সময় স্থানীয় প্রশাসন এবং সেনাবাহিনী/বিজিবি’র উপস্থিতি নিশ্চিত করা, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভ্রমণে ইচ্ছুক বিদেশী নাগরিকদের ভ্রমণের একমাস আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নেয়া, তিন পার্বত্য জেলায় কর্মরত জুম্ম পুলিশ সদস্যদের অন্য জেলায় বদলি করাসহ ১১টি নির্দেশনা জারি করে। অথচ পার্বত্য চুক্তিতে ‘পুলিশ (স্থানীয়)’ বিষয়টি তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তর করা এবং পরিষদ কর্তৃক কনষ্টেবল থেকে সাব-ইন্সপেক্টর নিয়োগ দিয়ে পার্বত্য পুলিশ বাহিনী গঠনের বিধান রয়েছে। কিন্তু পুলিশ বিষয়টি হস্তান্তর এবং কনষ্টেবল থেকে সাব-ইন্সপেক্টর পদে জুম্মদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়োগ তো দূরের কথা, বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত জুম্ম পুলিশসদস্যদের মধ্যে যাদেরকে তিন পার্বত্য জেলায় পোষ্টিং দেয়া হয়েছিল, তাদেরকেও অন্য জেলায় বদলি করার চুক্তি বিরোধী নির্দেশ দেয় শেখ হাসিনা সরকার। আর সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের প্রতিনিধির উপস্থিতি ছাড়া কোন কূটনৈতিক ও বিদেশী ব্যক্তি, সার্কেল চীফ ও জনপ্রতিনিধিসহ জুম্মদের সাথে দেখা-সাক্ষাতে বিধিনিষেধ আরোপের মূল উদ্দেশ্যই হলো জুম্ম জনগণকে বাইরের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন করা, যা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মূল চেতনার সম্পূর্ণ বিরোধী। এটা শেখ হাসিনা সরকারের দেশবাসী ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অন্ধকারে রেখে জুম্ম জনগণের উপর নির্বিচারে দমন-পীড়ন চালানোর অপচেষ্টা বৈ কিছু নয়। এভাবেই শেখ হাসিনা সরকার একের পর এক চুক্তি বিরোধী কার্যক্রম হাতে নিয়ে জুম্ম জনগণের সাথে চরম প্রতারণা করে থাকে।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার ১৬ বছর মেয়াদকালে শেখ হাসিনার সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে সন্তু লারমার বহু বার বৈঠক ও সাক্ষাৎ হয়েছে। সর্বোচ্চ পর্যায়ে এসব বৈঠকে চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু এসব সিদ্ধান্তবলী কখনোই বাস্তবমুখ দেখেনি। কার্যত স্রেফ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতির মধ্যেই সেসবের বাস্তবায়ন শেষ হয়েছিল। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমা চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়গুলো পরিচিহ্নিত করে সহায়ক দলিলের ১৬টি পরিশিষ্ট সংযুক্ত করে “পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যেসব বিষয় বাস্তবায়িত হয়নি তার বিবরণ” শীর্ষক ১৮ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন ১ এপ্রিল ২০১৫ প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করেছিলেন। কিন্তু এসব অবাস্তবায়িত বিষয়সমূহ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কাজের কাজ কোন কিছুই অগ্রগতি হয়নি। বস্তুত সেই প্রতিবেদনটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গুরুত্বহীনভাবে ফেলে রেখে দিয়েছিলেন বলে প্রতীয়মান হয়। এমনিতর অবস্থায় শেখ হাসিনা সরকার কর্তৃক জুম্ম জনগণকে প্রতারনা করা হয়েছে বলে জনসংহতি সমিতির অভিযোগ কখনোই অযৌক্তিক হতে পারে না।
বস্তুত দেশে-বিদেশে প্রবল চাপে পড়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের ঘোষণা দিয়ে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি-বাঙালি স্থায়ী অধিবাসীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভূমি অধিকার স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছিল বটে, কিন্তু কার্যত মনেপ্রাণে তা তিনি গ্রহণ করেননি। ফলে শেখ হাসিনা ও তার সরকারের উগ্র জাতীয়তাবাদী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক খোলস উন্মোচিত হতে বেশি দিন লাগেনি। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের যে মূল উদ্দেশ্য নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেই রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানে শেখ হাসিনা সরকার তো এগিয়েই আসেননি, উপরন্তু সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনী দিয়ে দমন-পীড়ন চালিয়ে পূর্বের স্বৈরশাসকদের মতো শেখ হাসিনা সরকার ও তাঁর দল পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে সোচ্চার জুম্ম জনগণের কণ্ঠকে চিরতরে রোধ করার নীতি গ্রহণ করে। শুধু তাই নয়, শেখ হাসিনা সরকার পূর্বের স্বৈরশাসকদের মতো জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও সংস্কৃতি বিধ্বংসী তথাকথিত উন্নয়ন কার্যক্রম (ডেভেলাপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং) গ্রহণের মাধ্যমে একদিকে জুম্ম জনগণকে জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে থাকে, অন্যদিকে অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার পাকিস্তানী শাসকদের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার নীলনকশা বাস্তবায়ন করে চলেছে। তদুদ্দেশ্যে অপারেশন উত্তরণ নামক সেনা শাসন বলবৎ রাখা, জনসংহতি সমিতির অস্তিত্ব ধ্বংস করা; জুম্মদের দুই লক্ষাধিক একর ভোগদলীয় জুমভূমি ও মৌজাভূমিকে একতরফাভাবে রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা, বহিরাগতদের নিকট হাজার হাজার একর ভূমি ইজারা প্রদান, সেনা ছাউনি স্থাপন ও সম্প্রসারণের নামে হাজার হাজার একর ভূমি অধিগ্রহণ, সেনাবাহিনীর পর্যটন শিল্পের জন্য শত শত একর পাহাড় বেদখল, সেটেলারদের গুচ্ছগ্রাম সম্প্রসারণ ও বহিরাগতদের অব্যাহত বসতিপ্রদান, জুম্ম জনগণের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা ও গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া, জুম্ম নারী ও শিশুদের উপর সহিংসতা ইত্যাদি কার্যক্রমের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকার জুম্ম জনগণকে তাদের চিরায়ত ভূমি ও বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ করে চলেছে।
রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের পরিবর্তে শেখ হাসিনা সরকার পূর্বের স্বৈরশাসকদের মতো বর্তমানে কার্যত সামরিক সমাধানের পথ বেছে নিয়েছে এবং তদুদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিকায়ন জোরদার করেছে। তারই অংশ হিসেবে সম্প্রতি শেখ হাসিনা সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় নতুন নতুন ক্যাম্প স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। জনসংহতি সমিতিসহ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে সোচ্চার ব্যক্তি ও সংগঠনকে ‘সন্ত্রাসী’, ‘চাঁদাবাজ’, অস্ত্রধারী দুর্বৃত্ত’ হিসেবে পরিচিহ্নিত করার জন্য শেখ হাসিনা সরকার ব্যাপক অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রম জোরদার করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে সেনা অভিযান, ঘরবাড়ি তল্লাসী, গ্রেফতার, ক্রশফায়ারের নামে বিচার-বহির্ভুত হত্যা, ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দায়ের ইত্যাদি জোরদার করা হয়েছে। একদিকে ভাড়াটে হলুদ সাংবাদিকদের মাধ্যমে জনসংহতি সমিতি তথা জুম্ম জনগণ সম্পর্কে অপপ্রচার করা, অন্যদিকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সভা-সমিতির স্বাধীনতা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংবাদ প্রকাশের বিধি-নিষেধ আরোপের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামকে কার্যত অবরুদ্ধ অঞ্চলে পরিণত করা হয়েছে। ফলে সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর নিপীড়ন-নির্যাতনের খবর সম্পূর্ণভাবে দেশের সংবাদ মাধ্যমের অন্তরালে থেকে যাচ্ছে। এভাবেই আজ পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি চুক্তি-পূর্ব পরিস্থিতির মতো অস্থিতিশীল ও সংঘাতময় হয়ে উঠছে।
শেখ হাসিনা সরকার কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামের ইস্যুতে বেঈমানী করেছে তাই নয়, দেশের সংখ্যালঘু ও আদিবাসী জাতিসমূহের সাথেও চরম প্রতারনা করেছে। শেখ হাসিনা সরকার সমতল অঞ্চলের আদিবাসী জাতিসমূহের ভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য ভূমি কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছিল। কিন্তু বিগত ১২ বছরে তার ধারেকাছেও ঘেঁষেনি শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। অপরদিকে অর্পিত সম্পত্তির নামে আদিবাসীসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া জায়গা-জমি ফেরত দানের প্রতিশ্রুতি প্রদান করলেও বিগত একযুগ ধরে কেবল আইনটির সংশোধনে সময় ক্ষেপণ করেছে। অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণে কাজের কাজ কোন কিছুই অগ্রগতি লাভ করেনি। সম্প্রতি গত এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদ অভিযোগ করেছে যে, বিশ্ববাপী প্রাণঘাতি করোনা মহামারীর দুর্যোগেও হিন্দুদের উপর হামলা, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভূমি বেদখল বন্ধ হয়নি।শেখ হাসিনা সরকারের আমলেও হামলাকারীদের দায়মুক্তির ব্যাঘাত ঘটেনি বলেই করোনা সংকটেও ধারাবাহিক হামলা অব্যাহত রয়েছে। অথচ সংখ্যালঘু হিন্দুদের পরাকাষ্ঠা সেজে মধুমাখা অমৃত বাণী ঝরাতে শেখ হাসিনার সত্যিই জুড়ি মেলা ভার।
শেখ হাসিনা নিজেকে ও তার সরকারকে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক হিসেবে দাবি করলেও তার সরকারকে দেখা গেছে সৌদি আরবের মতো মৌলবাদী ইসলামী সামরিক জোটের সাথে জোটবদ্ধ হতে, হেফাজতে ইসলামীর মতো জঙ্গীবাদী ইসলামী সংগঠনের সাথে আঁতাত করতে, হেফাজতে ইসলামীর মদদে পাঠ্য-পুস্তক থেকে অমুসলিম লেখকদের লেখা বাদ দেয়ার ও ইসলামী ধারার পাঠ্যক্রম চালু করার উদ্যোগ নিতে। দক্ষিণপন্থী ও মৌলবাদী রাজনৈতিক দল ও সংগঠনসমূহের চরিত্র সহজে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু শেখ হাসিনার মতো শাসককূলের উগ্র জাতীয়তাবাদী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক কদর্য ও প্রবঞ্চক চরিত্র সহজেচিহ্নিত করা যায় না। কারণ তারা জনগণকে বিভ্রান্ত করতে ছলনা ও ভন্ডামীর আশ্রয় নেয়। তাদের বর্ণচোরা ভূমিকার কারণে মানুষ সহজেই বিভ্রান্ত হয় এবং ভন্ডামীর ফাঁদে পড়ে মানুষ সহজে প্রতারণার শিকার হয়। তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যুতে, আদিবাসী ইস্যুতে, সংখ্যালঘু ইস্যুতে দক্ষিণপন্থী ও মৌলবাদী রাজনৈতিক দলসমূহ থেকে শেখ হাসিনা সরকার ও তাঁর দলের নীতির কোনতফাৎ নেই, বরঞ্চ আরো বেশি ভয়ঙ্কর ও ধ্বংসাত্মক।
ক্ষমতাসীন দল ও সরকারি ব্যক্তিবর্গ শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সফলতার অন্যতম উদাহরণ হিসেবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রায়ই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদনকেই উল্লেখ করে থাকেন। পার্বত্য সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের উদ্যোগের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৯৯৮ সালে ইউনেস্কোর হুপে-বোয়ানি শান্তি পুরস্কার এবং ২০০৯ সালে ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পুরস্কার প্রাপ্তির কথা বড়াইকরে ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা বলে থাকেন। কিন্তু প্রতিশ্রুতি প্রদান করে সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করা যেমন কোন জননেত্রী বা জনদরদী রাজনীতিকের চরিত্র হতে পারে না, তেমনি তা সাফল্য হিসেবে বড়াই করারও কোন বাস্তবতা আছে বলে গণ্য করা যায় না। বরঞ্চ এটাকে চরম প্রতারণা, বেঈমানী ও ভন্ডামীর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে ইতিহাসের উপজীব্য বলে বলা যেতে পারে।আন্তরিকতা ও সদিচ্ছার ঢালি মেলে ধরে, রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লোভনীয় প্রতিশ্রুতি দিয়ে শেখ হাসিনা সরকার ও তাঁর দল যে পার্বত্য চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন, বস্তুত তা পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের জন্য নয়, তার পেছনে মূল উদ্দেশ্যই হলো প্রতারণার ফাঁদ পেতে জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র শাখা শান্তিবাহিনীর অস্ত্র ও গোলাবারূদ কেড়ে নিয়ে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা এবং জনসংহতি সমিতির কার্যক্ষমতাকে ধ্বংস করে দেয়া। বলাবাহুল্য তার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকার হয়তো সাময়িক সাফল্য অর্জন করতে পারে কিন্তু ইতিহাসে ইহা রাজনৈতিক প্রতারণা, প্রহসন ও ভন্ডামি হিসেবে অমোচনীয় হয়ে থাকবে। পক্ষান্তরে অধিকারকামী জুম্ম জনগণকে একটা মরণপণ আন্দোলনে ঠেলে দেওয়া হলো বলে বলা যেতে পারে, যা দেশের বৃহত্তর স্বার্থে কখনোই কাম্য হতে পারে না।
তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ইতিহাসে নিপীড়িত শোষিত ও প্রতারিত জুম্ম জনগণের ক্ষুব্ধ মননে শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকার একজন প্রতারক ও বেঈমান হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকবেন।
প্রীতিবিন্দু চাকমা: সহ সম্পাদক, হিল ভয়েস।