হিল ভয়েস, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ঢাকা: গতকাল (২২ সেপ্টেম্বর) ঢাকার শাহবাগে সম্প্রতি খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে পাহাড়িদের উপর গুলিবর্ষণ, হত্যা, ঘরবাড়ি, দোকানপাট, ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগের প্রতিবাদে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এই প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে নিয়োজিত দেশের নাগরিক সমাজের একটি প্লাটফর্ম ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন’।
মানবাধিকার কর্মী দীপায়ন খীসার সঞ্চালনায় এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন এর সভাপতিত্বে এই সমাবেশে লিখিত বক্তব্য পেশ করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী। সমাবেশে সংহতি বক্তব্য রাখেন সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের কার্যকরী সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, বাংলাদেশ জাসদ এর সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সাংসদ নাজমুল হক প্রধান, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) এর সহকারী সাধারণ সম্পাদক খায়রুজ্জামান লিপন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম প্রমুখ।
অধ্যাপক খায়রুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, পার্বত্য সমস্যার সমাধান না হলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের সমস্যার সমাধান হবে না। পাহাড়িরা নিরাপদ না থাকলে বাংলাদেশও নিরাপদ থাকবে না। সেই ১৯৭৬ সাল থেকেই পাহাড়ে যেভাবে সমস্যাগুলো বাড়িয়ে তোলা হয়েছে তাতে ক্রমশ পাহাড়িদের অধিকারকে সংকুচিত করা হয়েছে। ১৯৯৭ সালে রাষ্ট্রের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি স্বাক্ষরের পর আমরা আশা করেছিলাম পার্বত্য সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু এই চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় সেই সমস্যার সমাধান হয়নি। কাজেই এই চুক্তি অবিলম্বে বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতেই হবে।
অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, অনেকেই বলে থাকেন পাহাড়ের আদিবাসীরা বিচ্ছিন্নতাবাদী। কিন্তু আমি এক্ষেত্রে একটা কথা বলি। আপনারা অনেকেই দেখেছেন পাহাড়ে গত দশ বছর আগেও সেভাবে নেটওয়ার্ক ছিল না। কিন্তু নেটওয়ার্ক কোম্পানিগুলো বিজ্ঞাপন দিতো- বাংলাদেশের ৬১ জেলায় নেটওয়ার্ক। কিন্তু বাংলাদেশের জেলা কি ৬১টি? পাহাড়ি মানুষজন সবসময় নেটওয়ার্কের মধ্যে আসতে চেয়েছিল। কাজেই যারা নেটওয়ার্কের মধ্যে আসতে চায় তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী নাকী যারা বিচ্ছিন্ন রাখতে চায় তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী? এ প্রশ্নগুলো থেকে যায়। পাহাড়ের সমস্যাকে নিরাপত্তার চশমায় না দেখে পাহাড়িদের চশমা দিয়ে দেখতে হবে। পাহাড়ের সমস্যা সমাধানের জন্য পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।
নাজমুল হক প্রধান বলেন, আমাদের একটা সংসদীয় ককাস ছিল। উক্ত সংসদীয় ককাসে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য বার বার বলা হয়েছিলো। কিন্তু পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করা হয়নি। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীদের বিচ্ছিন্নতাবাদী, সন্ত্রাসী বানিয়ে তাদের উপর দমন পীড়ন করা হয়েছে। দমন পীড়ন করে সমস্যার সমাধান হবে না। কখনই এভাবে দমন-পীড়নের মধ্য দিয়ে এসব জাতিগোষ্ঠীকে নিঃশেষ করা যাবে না। তাদের সাথে আলোচনা করতে হবে। যে চুক্তিটা হয়েছে সে চুক্তি বাস্তবায়ন করতেই হবে। এ সরকারের সময়েই চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। সরকারকে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সকল ধরনের উদ্যোগ নিয়ে পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে নিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। তা না হলে, দেশের জনসাধারণ যে আকাঙ্খায় ক্ষমতায় এনেছে তা পূরণ হবে না।
বাসদের কেন্দ্রীয় নেতা খালেকুজ্জামান লিপন বলেন, দেশে আর মৃত্যুর মিছিল দেখতে চাই না। মব জাস্টিসের নামে আইনের লঙ্ঘন করা বন্ধ করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিকভাবে ফিরিয়ে আনতে হবে। খাগড়াছড়ি এবং রাঙ্গামাটিতে সংঘটিত ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু বিচার করতে হবে। পাহাড়ের সমস্যাকে রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে। ঘটনায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদেরকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সংবিধানে পাহাড়ি মানুষদের অন্তর্ভুক্তি করে একটি সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
বাংলাদেশ কমিউনিষ্ট পার্টির সভাপতি শাহ আলম বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম দীর্ঘদিন অশান্ত ছিলো। আবার অশান্তি শুরু হয়েছে। একটি মোটর সাইকেল চোরের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা তৈরী করা হয়েছে। স্বাধীনতার পর যখন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীদের মূল্যায়ন করা হয়নি তখন থেকে পাহাড়ে অশান্তির শুরু হয়েছে। তিনি আরো বলেন, আমাদের বুঝা উচিত একজন বাঙালী যেমন চাকমা না তেমনি একজন চাকমাও বাঙালী হতে পারে না। কিন্তু একজন চাকমা, একজন মারমা একজন বাঙালি সবাই মিলে বাংলাদেশী হতে পারি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়ন না হওয়া, ভূমি সমস্যার সমাধান না হওয়ার কারণে সেখানে আজকে সমস্যাগুলো সৃষ্টি হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের চারপাশে যে ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েন হচ্ছে, সে বিষয়টি বিবেচনায় চুক্তির বাস্তবায়ন করা সময়ের দাবি। একটি আধিপত্যবাদীর নিয়ন্ত্রণ থেকে আরেক আধিপত্যবাদীর নিয়ন্ত্রণে পর্যবসিত হয়েছি। এখনো আমরা প্রকৃত স্বাধীনতা পাই নি।
তিনি বলেন, নেপালে যেমন সকল সম্প্রদায়কে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, এদেশেও সকল জনগোষ্ঠীকে জায়গা করে দিতে হবে। তিনি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সকল ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার আহ্বান জানান।
পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন বলেন, বাংলাদেশে যে বিশাল পরিবর্তন হয়েছে তার মাধ্যমে দেশ নতুন করে গঠন হতে হবে। নতুন বাংলাদেশের সূচনায় স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রভৃতি বিষয়গুলো দ্রুত ঠিক করতে হবে। তিনি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কারীদের মৌলিক বিষয়গুলো সংস্কারের জন্য সময়সীমাভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণের আহ্বান জানান।
সমাবেশ থেকে নিম্নোক্ত দাবি জানানো হয়-
১। অনতিবিলম্বে সংঘটিত ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং অতি দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে;
২। মানবাধিকার কর্মী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও দীঘিনালা হামলার জন্য একটা স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে।
৩। খাগড়াছড়ি সদর, দীঘিনালা ও রাঙ্গামাটিতে সহিংসতার শিকার পাহাড়ি অধিবাসীসহ তিন পার্বত্যজেলার জুম্ম জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
৪। গুলিতে নিহত হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারবর্গকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ এবং আহতদের সুচিকিৎসা প্রদানের অতি দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৫। জুম্ম জনগোষ্ঠীর ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধ বিহার পুনঃনির্মাণ ও দোকানপাট ও বাড়িঘরের মালিকদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৬। দায়িত্বরত বিভিন্ন সংস্থা ও মহলের যথাযথ দায়িত্ব পালন না করার জন্য সুষ্ঠ তদন্ত সাপেক্ষে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ ও প্রয়োজনীয় বিভাগীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
৭। পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি স্থিতিশীল করার লক্ষ্যে যত দ্রুত সম্ভব পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সাথে সরকারের নীতিনির্ধারকদের সংলাপ শুরু করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এবং
৮। পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে অন্তবর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রমের অগ্রাধিকার তালিকায় রাখতে হবে।