হিল ভয়েস, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, বিশেষ প্রতিবেদক: একদিন আগে খাগড়াছড়ি জেলা সদরে মোটরবাইক চোর এক বাঙালি যুবক গণপিটুনি পরবর্তী হাসপাতালে মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে তার পরদিনই সেটেলার বাঙালিদের কর্তৃক খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় জুম্মদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা, খাগড়াছড়ি সদরে সেনাবাহিনী কর্তৃক জুম্মদের উপর গুলিবর্ষণ এবং আজ দীঘিনালা-খাগড়াছড়ি হামলার প্রতিবাদে রাঙ্গামাটিতে মিছিল আয়োজনকারী জুম্ম ছাত্রদের উপর সেটেলারদের হামলা সংঘটিত হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
হামলার শিকার হয়ে গতকাল (১৯ সেপ্টেম্বর) খাগড়াছড়িতে ৩ জন, দীঘিনালায় ২ জন এবং আজ (২০ সেপ্টেম্বর) সকালে রাঙ্গামাটিতে ১ জন জুম্ম ছাত্র নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। খাগড়াছড়িতে নিহতরা সেনাবাহিনীর গুলিতে বিদ্ধ হন বলে জানা গেছে। গতকাল দীঘিনালায় সেনাবাহিনীর সামনেই সেটেলার বাঙালিরা অন্তত ৪০টি জুম্ম আদিবাসীর দোকানপাট ও বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। এছাড়া, গতকাল দীঘিনালায় সেটেলারদের হামলায় এবং খাগড়াছড়ি সদরে সেনাবাহিনীর গুলিতে ১৫-২০ জুম্ম আহত হয়েছে বলে জানা গেছে।
অপরদিকে, আজ সকালে রাঙ্গামাটিতে সেটেলারদের হামলায় আরো অনেকেই আহত এবং সেভরন ক্লিনিক, জনসংহতি সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কার্যালয় ও আঞ্চলিক পরিষদ কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, কাঠালতলীস্থ বহু ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধ বিহার মৈত্রী বিহারেও হামলা চালিয়ে ভাঙচুর চালায় সেটেলার বাঙালিরা।
ঘটনার সূত্রপাত:
স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা যায়, গত ১৮ সেপ্টেম্বর, মামুন (৪০) নামের এক ব্যক্তি খাগড়াছড়ি সদরের মধুপুর এলাকা থেকে গোল্ডি চাকমা (৪৫) নামে এক ব্যক্তির মোটরবাইকটি চুরি করে দ্রুত চালিয়ে যাচ্ছিল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে রাস্তার পাশের একটি বৈদ্যুতিক খুঁটির সাথে ধাক্কা খেয়ে ওই চোর মামুন বাইক থেকে পড়ে যায়। তখনই আশেপাশের চাকমা ও বাঙালি জনতা এসে মামুনকে মারধর করে। মারধরের ফলে মামুন বেহুঁচ হয়ে যায়। পরে মামুনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তাকে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।
পুলিশ ও একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, নিহত বাইকচোর মামুন একজন মূলত পেশাধার চোর। তার বিরুদ্ধে ১৭টি মামলা চলমান রয়েছে। তন্মধ্যে ১৪টি হচ্ছে চুরির মামলা, ৩টি মাদক সংক্রান্ত মামলা।
মামুনের মৃত্যুর পরপরই সেটেলার বাঙালিরা সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে প্রচার করতে থাকে যে জুম্মরাই পরিকল্পিতভাবে মামুনকে মেরে ফেলেছে।
দীঘিনালায় হামলা:
গতকাল (১৯ সেপ্টেম্বর) বিকাল ৪টার দিকে সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে দীঘিনালা উপজেলা সদরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করে সেটেলার বাঙালিরা। অনুষ্ঠানের শেষদিকে সেটেলার বাঙালিরা দীঘিনালা সদরে থাকা জুম্মদের উপর লাঠিসোটা ও ইটপাটকেল দিয়ে হামলা করে। হামলায় ধর্মজয় চাকমা, গ্রাম-উদোলবাগান, দীঘিনালা সদর নামে এক জুম্ম এবং আরও অজ্ঞাতনামা এক বাঙালি গুরুতর আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন বলে জানা গেছে।
এসময় আরও ২ জুম্ম আদিবাসী হামলার শিকার হয়ে গুরুতর আহত হন। আহত ব্যক্তিরা হলেন- ১. লেনিন চাকমা (৪০), পীং-অজ্ঞাত, গ্রাম-কামুকোছড়া, বোয়ালখালি সদর; তার অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে; ২. নিপুয়ে চাকমা (৫৫), পীং-অজ্ঞাত, গ্রাম-কলেজটিলা, বোয়ালখালি সদর এবং ৩. ধনজয় চাকমা, দীঘিনালা সদর।
এসময় আশেপাশের জুম্ম আদিবাসীরা আক্রান্তদের বাঁচাতে এগিয়ে আসলে সেটেলার বাঙালিরা পিছু হটে। সেটেলার বাঙালিরা যখন পিছু হটতে থাকে তখনি সেনাবাহিনীর একটি দল সেখানে আসে এবং জুম্মদের ধাওয়া করে তাড়িয়ে দেয়।
এর কয়েক মিনিট পরেই সেটেলার বাঙালিরা আবার অস্ত্রেশস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে দীঘিনালা সদরে হামলা চালাতে আসে। এসময় বিকাল আনুমানিক ৫টার দিকে সেটেলার বাঙালিরা সেনাবাহিনীর চোখের সামনেই বটতলার লারমা স্কোয়ার স্টেশন বাজারে অগ্নিসংযোগ করে। এতে জুম্ম আদিবাসীর অন্তত ৪৫টি দোকান ও বাড়ি ভস্মীভূত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। এসময় সেনাবাহিনীকে নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। প্রায় রাত ৯টা পর্যন্ত সেটেলার বাঙালি ও স্থানীয় পাহাড়ির মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করে বলে জানা যায়।
খাগড়াছড়িতে সেনাবাহিনীর গুলি:
একইদিন (১৯ সেপ্টেম্বর) রাত ৯টার দিকে, দীঘিনালা হামলার প্রতিবাদে খাগড়াছড়ি সদরের স্বনির্ভর, নারানখেয়্যা এলাকায় একদল জুম্ম আদিবাসী ছাত্র-যুবক সড়ক অবরোধ করে বলে জানা যায়। এসময় সেখানে সেনবাহিনীর একাধিক দল উপস্থিত হয়। এতে সামান্য দূর থেকে উভয়ের মধ্যে বাকবিতন্ডা ও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে সেনাবাহিনী সেখানে গুলিবর্ষণ করে বলে জানা যায়। অপরদিকে, জুম্ম ছাত্ররা কান্তা-গুলতি ব্যবহার করে। এসময় সেনাবাহিনীর তাজা গুলিতে অনেক জুম্ম ছাত্র-যুবক আহত হয়। ছাত্রদের কারো কারো পেটে, হাটুতে, পায়ে গুলি লেগে গুরুতর আহত হয় বলে জানা যায়।
এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সেনাবাহিনীর গুলিতে ৩ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এই সংখ্যা আরও অধিক হতে পারে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
গুলিতে নিহত ৩ ব্যক্তি হলেন- ১. জুনান চাকমা (২০), পীং-অজ্ঞাত, ঠিকানা-খাগড়াছড়ি সদর, তিনি কলেজ ছাত্র; ২. দীপ্ত চাকমা (২২), পীং-অজ্ঞাত, ঠিকানা-জামতলি, পেরাছড়া ইউনিয়ন এবং রুবেল ত্রিপুরা, ঠিকানা-খাগড়াছড়ি সদর।
জানা গেছে, সেনাবাহিনীর গুলিতে অন্তত ১৫-২০ জন জুম্ম ছাত্র-যুবক আহত হন। যদিও একাধিক সূত্র জানায়, এই সংখ্যা আরো অধিক হতে পারে।
গুলিতে আহত এবং খাগড়াছড়ি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন চিহ্নিত কয়েকজন জুম্মর পরিচয় হল- ১. সোহেল চাকমা (২০), পীং-সুমঙ্গল চাকমা, এইচএসসি, খাগড়াছড়ি টেকনিকেল স্কুল এন্ড কলেজ, ঠিকানা-ধর্মপুর; ২. মানব ত্রিপুরা (১০), পীং-দিশাময় ত্রিপুরা, অষ্টম শ্রেণি, খাগড়াছড়ি টেকনিকেল স্কুল এন্ড কলেজ, ঠিকানা-গাছবান; ৩. বিজয় চাকমা, পীং-কান্তি চাকমা, পেশায় রাজমিস্ত্রি, ঠিকানা-গিরিফুল; ৪. নলেজ চাকমা, পীং-নিকুঞ্জয় চাকমা, পেশায় রাজমিস্ত্রি, ঠিকানা-ধর্মপুর, ৫. আশীষ চাকমা, তিনি খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের একজন কর্মচারি।
এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আরও অনেকের নাম পাওয়া যায়নি। আহত আরও ২ থেকে ৬ জন চট্টগ্রামে স্থানান্তর করা হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
রাঙ্গামাটিতে হামলা:
আজ (২০ সেপ্টেম্বর) সকাল ১০টার দিকে, রাঙ্গামাটি জেলা সদরে একদল জুম্ম আদিবাসী ছাত্র-যুবকের উদ্যোগে গতকালকের দীঘিনালা-খাগড়াছড়িতে জুম্মদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে একটি মিছিল বের করা হলে সেখানেও সেটেলার বাঙালিরা সাম্প্রদায়িক হামলা চালায় বলে খবর পাওয়া গেছে। হামলায় এক চাকমা যুবক নিহত এবং ৫৪ জন জুম্ম আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়।
নিহত ব্যক্তির পরিচয়- কালামানি চাকমা (১৮), পীং-আদর সেন চাকমা, গ্রাম-নোয়াপাড়া, মগবান ইউনিয়ন, রাঙ্গামাটি সদর উপজেলা। তিনি রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজের ১ম বর্ষের ছাত্র। তিনি বনরূপা এলাকায় সেটেলার বাঙালিদের হামলায় নিহত হন বলে জানা গেছে।
এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত রাঙ্গামাটিতেও অনেক ছাত্র-ছাত্রী আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে, তবে, তাদের সুনির্দিষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়নি। একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায় হামলায় অন্তত ৫৪ জন জুম্ম ছাত্র ছাত্রী আহত হয়।
হামলায় সেটেলার বাঙালিরা পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ কার্যালয়ে ও বিশ্রামাগারে হামলা চালিয়ে সরকারি সম্পত্তি ক্ষতিসাধন করে বলে জানা গেছে। এসময় হামলাকারীরা আঞ্চলিক পরিষদের ১টি পিকআপ, ৫টি পাজেরো, ১টি মাইক্রো; ব্যক্তিগত ২টি গাড়ি এবং উন্নয়ন বোর্ডের ১টি পাজেরো ও ১টি পিকআপে অগ্নিসংযোগ করে।
শুধু তাই নয়, সেটেলার বাঙালিরা কাঠালতলীস্থ বহু ঐতিহ্যবাহী মৈত্রী বিহারে হামলা ও ভাঙচুর এবং সেভরন ক্লিনিকে, বিজন সরণী এলাকায় জুম্মদের বিভিন্ন দোকানপাটে, জনসংহতি সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কার্যালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে বলে জানা যায়।
এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত রাঙ্গামাটিতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে এবং পরিস্থিতি থমথমে অবস্থায় বিরাজ করছে বলে জানা গেছে। সাধারণ জুম্মদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ ও আতঙ্ক বিরাজ করছে।
এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হামলাকারী কাউকে গ্রেপ্তার করেছে বলে জানা যায়নি।
+ There are no comments
Add yours