বিপ্লবী এম এন লারমার ৮৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে নানা কর্মসূচি

হিল ভয়েস, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, বিশেষ প্রতিবেদক: পার্বত্য চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণকারী অবিসংবাদিত মহান নেতা, সাবেক সংসদ সদস্য বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার (এম এন লারমা) ৮৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থানে আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কবিতা পাঠানুষ্ঠান ইত্যাদি কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠানগুলি নিম্নরূপ:

ঢাকা: আলোচনা সভা

বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৮৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন কমিটি’র উদ্যোগে আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, রবিবার, বিকাল ৪:০০ টায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচার থিয়েটার ভবন এর আর সি মজুমদার মিলনায়তনে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।

বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট আবু সাঈদ খান এর সভাপতিত্বে উক্ত আলোচনা সভায় প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ। প্রবন্ধের বিষয়বস্তু: গণঅভ্যুত্থান, রাষ্ট্র সংস্কার ও সংবিধান বিতর্ক: মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার জরুরি জিজ্ঞাসা।

এতে আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান, লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক স্নিগ্ধা রেজওয়ানা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের ছাত্র ও যুব বিষয়ক সম্পাদক হরেন্দ্র নাথ সিং এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রূপাইয়্যা শ্রেষ্ঠা তঞ্চঙ্গ্যা।

চট্টগ্রাম: আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান

 

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, চট্টগ্রাম অঞ্চল এর উদ্যোগে আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, রবিবার, বিকাল ৪:৩০ টায়, চট্টগ্রামের স্টেশন রোডের এশিয়ান এস আর হোটেলে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার জন্ম জয়ন্তী উপলক্ষে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা অনুষ্ঠিত হবে।

আলোচনা সভায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য সাধুরাম ত্রিপুরা মিল্টন, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক রনজিৎ কুমার দে, ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউশন, চট্টগ্রাম এর সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা এর সভাপতি তাপস হোড়, ঐক্য ন্যাপ, চট্টগ্রাম এর যুগ্ম সম্পাদক পাহাড়ী ভট্টাচার্য, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, চট্টগ্রাম মহানগর এর সভাপতি হ্লামিউ মারমা প্রমুখ।

 

বিপ্লবী মহান নেতা এম এন লারমার জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকায় আলোচনা সভা

রাঙ্গামাটি: কবিতা পাঠ অনুষ্ঠান

“জুম্ম তারুণ্যের চেতনায় জাগ্রত থাকুক এম এন লারমার প্রদর্শিত আদর্শ”-এই শ্লোগান নিয়ে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের উদ্যোগে আগামী ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, শনিবার, সকাল ১০ টায়, রাঙ্গামাটির রাজবাড়িস্থ জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হবে কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে প্রগতিশীল কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তি, মানবাধিকার কর্মী, ছাত্র-যুব ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন বলে আয়োজকদের সূত্রে জানা গেছে।

এম এন লারমার সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত

এম এন লারমার জন্ম ১৯৩৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাধীন নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাট মৌজার স্বনামখ্যাত মহাপুরম বা মাওরুম গ্রামে। ১৯৬০ দশকে কাপ্তাই বাঁধের ফলে সৃষ্ট কাপ্তাই হ্রদের নীচে অন্যান্য বহু গ্রামের সাথে এই গ্রামটিও ডুবে যায়। তাঁর পিতা চিত্ত কিশোর চাকমা ছিলেন একজন গুণী শিক্ষক, সমাজহিতৈষী ও দেশপ্রেমী এবং মাতা সুভাষিণী দেওয়ান ছিলেন ধৈর্য্যশীলা ও ধর্মপ্রাণা এক নারী। তাঁর আপন জ্যেঠা কৃষ্ণ কিশোর চাকমা ছিলেন একজন অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থী এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষা প্রসারের আন্দোলনে সর্বজনশ্রদ্ধেয় এক ব্যক্তিত্ব। বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রামে আধুনিক শিক্ষার প্রসার, জুম্ম জাতীয় চেতনা বিকাশ ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে এম এন লারমাদের পরিবারটির বৈপ্লবিক ও নেতৃত্বের ভূমিকা ছিল অবিসংবাদিত।

আমার চোখে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা একজন বিপ্লবী: কবিতা পাঠ অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ শিশির চাকমা

তাঁর দুই ভাই ও সবার বড় একমাত্র বোন, সবাই পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্মদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং অতুলনীয় ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তাঁর বড় ভাই শুভেন্দু প্রভাস লারমা ১৯৮৩ সালে তাঁরই সাথে একই ঘটনায় শহীদ হন। অপরদিকে তাঁর ছোটভাই জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) তাঁর মৃত্যুর তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে আবির্ভূত হন। জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম এর সভাপতি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর একমাত্র বড় বোন জ্যোতিপ্রভা লারমা মিনু জনসংহতি সমিতির নারী সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি ১৯৫৮ সালে রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক, ১৯৬০ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে আই এ এবং ১৯৬৫ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। এরপর ১৯৬৮ সালে বিএড এবং ১৯৬৯ সালে এলএলবি সম্পন্ন করেন। এছাড়া তিনি ১৯৬৬ সাল হতে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত হাই স্কুলে শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বার এসোসিয়েশনে আইনজীবী হিসেবে যোগদান করেন।

এছাড়া তিনি ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৬৩ সালের শুরু পর্যন্ত পাহাড়ি ছাত্রদের সম্মেলনে ও সংগঠনে এবং বিভিন্ন আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬১ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও আন্দোলনের উদ্যোগ নেন। ১৯৬৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি নিবর্তনমূলক আইনে পুলিশ কর্তৃক চট্টগ্রামের পাথরঘাটাস্থ পাহাড়ি ছাত্রাবাস হতে গ্রেপ্তার হন। দুই বছরের অধিক সময় কারাগারে থাকার পর ১৯৬৫ সালের ৮ মার্চ চট্টগ্রাম কারাগার থেকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি লাভ করেন।

পরবর্তীতে ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তাঁরই নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট ৪ দফা সম্বলিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিনামা পেশ করা হয়। ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে জুম্মদেরকে ‘বাঙালি’ হিসেবে আখ্যায়িত করার প্রতিবাদে তিনি গণপরিষদ অধিবেশন বর্জন করেন। ১৯৭২ সালে তাঁরই নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি গঠিত হয় এবং তিনি এর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং একই বছর জনসংহতি সমিতির সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি বাকশালে যোগদান করেন।

১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট থেকে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। এরপর তাঁর ও তাঁর ভাই সন্তু লারমার নেতৃত্বে জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র শাখা ‘শান্তিবাহিনী’ দিয়ে শুরু হয় সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় তিনি ১৯৭৭ সালে জনসংহতি সমিতির প্রথম জাতীয় সম্মেলনে এবং ১৯৮২ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সম্মেলনে পরপর সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন।

১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর ভোর রাতে বিভেদপন্থী গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্রের বিশ্বাসঘাতকতামূলক অতর্কিত এক আক্রমণে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলাধীন পানছড়ি উপজেলার খেদারছড়া থুমে আট সহযোদ্ধাসহ নির্মমভাবে নিহত হন তিনি।

More From Author