হিল ভয়েস, ২৪ আগস্ট ২০২৪, ঢাকা: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্মসূচীতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন অগ্রাধিকার তালিকায় রাখার জন্য জরুরি আহ্বানে সংবাদ সম্মেলন করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন। সেই সাথে এই লক্ষে অন্তর্বর্তী সরকারকে ৭ দফা দাবি তুলে ধরে অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণ এবং উক্ত দাবিসমূহ বাস্তবায়ন শুরু করার লক্ষে সরকারের কর্মসূচিতে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন অগ্রাধিকার তালিকায় রাখার জন্য ৫টি বিষয় অবিলম্বে বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়।
আজ (২৪ আগস্ট) সকাল ১১ টায় প্লাটফর্মটির উদ্যোগে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে এই সংবাদ সম্মেলনটি আয়োজিত হয়।
আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন এর সঞ্চালনায় মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী। এছাড়া বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, মানবাধিকার কর্মী মেইন থিন প্রমীলা, দীপায়ন খীসা প্রমুখ।
অধ্যাপক ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী মূল বক্তব্যে বলেন, নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে নতুন সরকারের অভিযাত্রায় আমরা ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনার নতুন বাঁকে দাঁড়িয়ে আছি। ২৬ বছর ধরে এই চুক্তির মূল উপাদানগুলি অনেকাংশে অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে, যা পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি আদিবাসী জনগণ এবং সারাদেশের নাগরিকদের এক অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছে। এই চুক্তির পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ বাস্তবায়ন শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্যই নয়, বাংলাদেশের সকল আদিবাসীদের মর্যাদা ও অধিকার সমুন্নত রাখা এবং একই সাথে দেশের জাতীয় ঐক্যের জন্য অপরিহার্য।
তিনি আরো বলেন, এক বছরের অধিক সময় ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন দেশবাসীকে সাথে নিয়ে অক্লান্তভাবে চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের পক্ষে কথা বলে চলেছে। পাহাড়ি জনগণ এবং বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর যাতে একই সাথে উচ্চস্বরে এবং স্পষ্টভাবে শোনা যায়, তা নিশ্চিত করার জন্য আমরা কাজ করেছি। আমাদের আন্দোলন গতানুগতিক সীমানা অতিক্রম করে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সারাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ছাত্র-যুব ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ করেছে।
সংবাদ সম্মেলন থেকে সরকারের কাছে সাত দফা দাবিনামা উত্থাপন করা হয়। সংক্ষেপে দাবিগুলি হল- ১. চুক্তি বাস্তবায়নে একটি সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ, ২. পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক তত্ত্বাবধান বন্ধ, ৩. আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদের ক্ষমতায়ন, ৪. ভূমি অধিকার এবং পুনর্বাসন, ৫. অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি ও উন্নয়ন, ৬. সমতলের আদিবাসীদের জন্য প্রতিনিধিত্বশীল শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ ও ৭. সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন প্রতিষ্ঠা।
মূল বক্তব্যে অধ্যাপক খায়রুল ইসলাম চৌধুরী পার্বত্য চট্টগাম চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগ ত্বরান্বিত করার জন্য সরকারকে ৪ টি বিষয়ে এবং সমতলের আদিবাসীদেও জন্য ১টি জরুরী উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান। উক্ত ৫টি বিষয় হল: ১. পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ কমিটির পুনর্গঠন, ২. পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন সক্রিয় করা, ৩. আঞ্চলিক পরিষদের সাথে সংলাপ, ৪. পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা পরিষদের পুর্নগঠন করা এবং ৫. সমতল ভূমির আদিবাসীদের রক্ষায় উদ্যোগ গ্রহণ।
এছাড়া সংবাদ সম্মেলনে জাকির হোসেন বলেন, নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে অনেকেই নিজেদের দাবি নিয়ে হাজির হচ্ছেন। আমরাও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের পক্ষ থেকে এই সরকারকে আহ্বান জানাচ্ছি তারা যেন অগ্রাধিকার তালিকায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নকে রাখে। তার জন্য আমরা আমাদের দাবিগুলো উত্থাপন করছি।
অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ২০২৪ এর গণঅভ্যূথানে আমাদের আদিবাসী শিক্ষার্থীদের অভূতপূর্ব অংশগ্রহণ দেখেছি আমি। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে লেখা দেখছি- কল্পনা চাকমা কোথায়? বুটের তলায় পাহাড় কেন? আমাদের বাঙালি শিক্ষার্থীরা দুই মাস আমাদের সেনাবাহিনীকে সহ্য করতে পারছে না। কিন্তু বিগত ৫০ বছর ধরে পাহাড়ি মানুষ সেই নির্মম সেনাশাসন সহ্য করছে। বাংলাদেশের ৬০ জেলায় গণতান্ত্রিক শাসন থাকবে আর বাকী তিন জেলায় সামরিক শাসন থাকবে কেন? আমি সবসময় বলে থাকি, আমরা সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে নয় কিন্তু সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে।
তিনি আরো বলেন, অনেকেই বলছেন স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের বিদায় হয়েছে। কিন্তু আমরা কেন পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন কিংবা সামরিকায়নের বিরুদ্ধে কথা তুলে ধরছি। তাহলে কী আদিবাসীদেরকে যখন প্রয়োজন হয় তখন আমরা আদিবাসীদের নিচ্ছি কিন্তু প্রয়োজন না হলে তাদেরকে বাদ দিচ্ছি? আমাদেরকে সমস্ত নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। ক্ষুদ্রদের মধ্যেও যারা আরো ক্ষুদ্র তাদের কথা আমাদের বলতে হবে। আমরা দেখেছি বম জনগোষ্ঠীর নারী শিশু থেকে কীভাবে পুরো জনগোষ্ঠীর উপর নিপীড়ন পরিচালনা করা হয়েছে। পাহাড়ের আদিবাসী নারীদের উপর যে নিপীড়ন সেটা নিয়ে আমাদেরকে বিশেষভাবে প্রশ্ন করতে হবে। কারণ একটা জনগোষ্ঠীর মধ্যে যখন নিপীড়ন চালু থাকে তখন সে জনগোষ্ঠীর নারীদের উপর নিপীড়নটা আরো বেশী প্রকট হয়।
মেইন থিন প্রমীলা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি সমস্যার সাথে সমতলের আদিবাসীদের ভূমি সমস্যাটা আরো বেশী প্রকট। আমি রাখাইন আদিবাসীদের একজন সদস্য। সেই বরগুনা, পটুয়াখালী অঞ্চলে আদিবাসীদের ভূমি এখনও দখল করা হচ্ছে। তাদের শ্মশান, মন্দির দখল করা হচ্ছে। নতুন বাংলাদেশে তাদের এ নিপীড়নের কথা বলতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন মানবাধিকার কর্মী দীপায়ন খীসা, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের সদস্য মুর্শিদা আক্তার ডেইজী, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের সভাপতি খান আসাদুজ্জামান মাসুম, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন শুভ, কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা, ঢাকাস্থ জুম্ম নাগরিক সমাজের নেতা ডা: অজয় প্রকাশ চাকমা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় তথ্য ও প্রচার সম্পাদক হিরণ মিত্র চাকমা।