হিল ভয়েস, ১৪ জুলাই ২০২৪, ঢাকা: প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে আদিবাসীদের ৫% কোটা পুনর্বহালের দাবি সহ তিন দফা দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে আদিবাসী কোটা সংরক্ষণ পরিষদ।
আজ ১৪ জুলাই (রোববার) সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কোটা সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক অলিক মৃ কর্তৃক উপস্থাপিত এক লিখিত বক্তব্যে এ দাবিগুলো তুলে ধরা হয়।
অলিক মৃ তাঁর লিখিত বক্তব্যে বলেন, আদিবাসীরা এখনও নাগরিক হিসেবে যথাযথ সুযোগ সুবিধা পায় না। অনগ্রসর জাতি হিসেবে কাদের বুঝানো হবে সেটি নিয়ে অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। কোটা বাতিল হওয়ার পরও সমপর্যায়ে না আসা পর্যন্ত আদিবাসীদের জন্য সরকারি চাকরিতে বিশেষ ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছিল। তার ফলাফল আমরা এখনো পাইনি।
তিনি বলেন, কোটা বাতিল হওয়ার আগ পর্যন্ত ১৫৭ জন আদিবাসী সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছিল। আর ২০১৮ সালে কোটা আন্দোলনের পর যখন কোটা বাতিল করা হলো, তখন থেকে এখন পর্যন্ত ৯৯ জন আদিবাসী উত্তীর্ণ হলেও মাত্র চার জন সুপারিশপ্রাপ্ত হয়। এ ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে আদিবাসীদের অস্তিত্ব থাকবে না।
অলিক মৃ বলেন, বর্তমান সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য ও অসমতা রাষ্ট্রে প্রান্তিক ও অনগ্রসরগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নত পরিকল্পনায় যদি আদিবাসীদের জন্য ৫% কোটা না রাখা হয় তাহলে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন সম্ভব হবে না। আদিবাসীরা আরও পিছিয়ে যাবে। এতে অসমতা তৈরি হবে।
তিনি বলেন, সংবিধানে দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ সুযোগের কথা বলা হয়েছে, সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালে কোটা ব্যবস্থা বাতিলের সময় “সম্পূর্ণভাবে কোটা তুলে দেয়া হলেও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারি চাকরিতে বিশেষ ব্যবস্থা করা হবে” বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমরা সে কথার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাইনি।
তিনি বলেন, আপনারা আরো জানেন যে, আমাদের আদিবাসী সমাজের বিকাশও অসম। আমাদের মধ্যে অনগ্রসরদের মধ্যেও আরো অধিকতর অনগ্রসর জাতি রয়েছে। ২০১৮ পূর্ববর্তী চালু থাকা ৫% কোটা রাখার ফলে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর যারা সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সুযাগ পেয়েছিল তাঁদের অধিকাংশই অপেক্ষাকৃত অগ্রসর আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সদস্য। দেশে ৫৪টির অধিক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে এমনও সুবিধাবঞ্চিত/অবহেলিত অনেক জাতি রয়েছে যাদের থেকে এখনো পর্যন্ত একজনও বিসিএস কিংবা ভালো কোন প্রতিষ্ঠানে প্রবেশের সুযোগ পায়নি। এসব বিবেচনা না করে যদি এখনই এই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দকৃত কোটা তুলে দেয়া হয় তাহলে আদিবাসীদের আর সরকারি চাকরিতে হয়তো খুঁজে পাওয়াই যাবে না। অন্যদিকে দেশের গুটিকয়েক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর কিছু সংখ্যক পরিবার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে কিছুটা অগ্রসর হলেও অধিকাংশই এখনো প্রাপ্তিকতার তলানিতে অবস্থান করছে। আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত বানাই, ডালু, পাত্র, কোচ, কড়া, কোল, খেয়াং, ঘুমী, গন্ড, চাক, তুরী, তেলী, পাংখোয়া, বম, বড়াইক, ভূমিজ, মাহালি, স্রো, লুসাই, হদি, হাজং এসব জাতিগোষ্ঠী থেকে কোনও প্রতিনিধি বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস (বিসিএস)-এ প্রবেশ করতে পারেনি। বলতে গেলে হাতেগোনা দু-একজনই মাত্র বিসিএসের মতো বড় পরীক্ষাগুলোতে অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছে।
তিনি বলেন, ২০২২ সালে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বরকত এর তথ্যমতে কভিড-১৯ এর আগে দেশে জাতীয় দারিদ্রের হার ছিল ২১.৮ এবং তখন আদিবাসী অধ্যুষিত জেলাগুলোর দারিদ্রতার হার ছিল ৬০ শতাংশ। অন্যদিকে সমতলের দুই-তৃতীয়াংশ আদিবাসী কার্যত ভূমিহীন। তারপর কোভিড-১৯ এর প্রভার, কর্মহীনতা, মজুরিস্বল্পতা, উৎপাদিত পণ্যেও মূল্য না পাওয়া, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা আদিবাসী জনগণের দারিদ্র পরিস্থিতিকে তীব্রতর করেছে এবং এ হার ৮০ শতাংশ ছাড়িয়েছে বলে অধ্যাপক বারাকাত উল্লেখ করেন (দেখুন: দেশ রূপান্তর ১৬ মে, ২০২২)। কাজেই কেবল মাত্র ৫% কোটা ব্যবস্থা করলেই হবে না। আদিবাসীদের মধ্যেও যারা আরও বেশি প্রান্তিক এবং যারা আসলেই সুবিধাবঞ্চিত তাদেরকেই অগ্রাধিকারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
তিনি বলেন, ৫% কোটা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার, তাই এটা পুনর্বহালের দাবি জানাই। আমরা কোটা আন্দোলনের বিপক্ষে না, তবে সামগ্রিক ৫% কোটায় আদিবাসীরা বৈষম্যের শিকার। তাই আমরা আদিবাসীদের জন্য নূন্যতম ৫% কোটা বহাল রাখার দাবি জানাচ্ছি।
এসময় সরকারের নিকট তিন দফা দাবি পেশ করে অলিক মৃ বলেন, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কোটা বিলুপ্তির এখনই উপযুক্ত সময় নয়। বরং আদিবাসীদের জন্য সমতা বজায় রাখতে ৫ শতাংশ কোটা বহাল রাখা যৌক্তিক বিবেচনায় সরকারের নিকট ৩ দফা দাবি পেশ করলাম।
১) প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে আদিবাসীদের ৫ শতাংশ কোটা পুনর্বহাল করতে হবে।
২) পুনর্বহালকৃত ৫ শতাংশ কোটা পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে অনগ্রসর ও অধিকতর অনগ্রসর জাতিসমূহকে চিহ্নিত করতে হবে। এবং ৫ শতাংশ কোটা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এ সুবিধার আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
৩) আদিবাসী এলাকায় মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত ও শিক্ষা অবকাঠামো নির্মাণ এবং শিক্ষক সংকট নির্মূল করতে হবে।
এ সময় ৩ দফা দাবি পেশ করে আগামী ১৬ জুলাই বিকেল ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে সমাবেশ ও মিছিল করা হবে বলেও জানান আদিবাসী কোটা সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক অলিক মৃ।