হিল ভয়েস, ৮ জুন ২০২৪, ঢাকা: গতকাল (৭ জুন) বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের উদ্যোগে ঢাকার মোহাম্মদপুর আসাদ এভিনিউর সিবিসিবি অডিটরিয়মে “আদিবাসী নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন জোরদার করুন” শ্লোগানকে সামনে রেখে ৫ম জাতীয় আদিবাসী নারী সম্মেলনের প্রথমদিন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সম্মেলনে উদ্বোধনী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক মিনু মারিয়া ম্রং। দুইদিনব্যাপী সম্মেলনের উদ্বোধন ঘোষণা করেন বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী খুশি কবির।
উদ্বোধনী অধিবেশনে সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার সাবেক সাংসদ ঊষাতন তালুকদার, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আইনগত সহায়তা বিষয়ক সম্পাদক রেখা সাহা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক স্নিগ্ধা রেজোয়ানা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ-সভাপতি অজয় এ মৃ, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের পরিচালক শাহনাজ সুমি, কাপেং ফাউন্ডেশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন গৌরাঙ্গ পাত্র, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি বিচিত্রা তিরকি, রাঙ্গামাটি সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান রিতা চাকমা ও এআইপিপির কার্যনির্বাহী সদস্য চন্দ্রা ত্রিপুরা প্রমুখ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী ফাল্গুনী ত্রিপুরা।
উক্ত দুইদিনব্যাপী সম্মেলনে দেশব্যাপী বিভিন্ন জেলা থেকে ১০০জনের অধিক প্রতিনিধি ও পর্যবেক্ষকবৃন্দ অংশগ্রহণ করছেন। সম্মেলনে বিভিন্ন অধিবেশনে অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন, লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ফারহা তানজীম তিতিল, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ-সাধারণ সম্পাদক ডা. গজেন্দ্রনাথ মাহাতো প্রমুখ।
উদ্বোধনী অধিবেশনে উদ্বোধক ও বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী খুশি কবির বলেন, আদিবাসী নারীরা বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। এসব সমস্যা আমাদের সবাইকে মোকাবেলা করতে হবে। আদিবাসী নারীদের প্লাটফর্ম “বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক” যেন নারীদের উন্নয়নে কাজ করতে পারে তিনি এই আশা ব্যক্ত করেছেন। একসাথে আওয়াজ তোলার আহ্বান জানান।
তিনি আরো বলেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সবাই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। যেখানে আদিবাসীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ইলা মিত্র, কল্পনা চাকমার কথা স্মরণ করে আদিবাসীদের আন্দোলনে আদিবাসী নারীদের ভূমিকা তুলে ধরেন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা, আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির সমস্যার কথা তুলে ধরে সবাইকে একসাথে আন্দোলনে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান।
সাবেক সাংসদ ঊষাতন তালুকদার বলেন, বাংলাদেশের আদিবাসীদের বহুবিধ সমস্যা রয়েছে। তারপরেও আদিবাসী নারীদের আরও অনেক সমস্যা রয়েছে। আমরা কার কাছে যাবো, কার কাছে বিচার পাবো। আদিবাসী নারী নির্যাতনের একটাও দৃষ্টান্তমূলক বিচার দেখা যায় না। এজন্য আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের যোগাযোগটা আরো নিবিড় করা উচিত। আমাদের নিজেদের আগে সংগঠিত হতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৬ বছর অতিবাহিত হয়েছে অথচ চুক্তির মূল বিষয়গুলো এখনো অবাস্তবায়িত। পার্বত্য চুক্তি এখন মুখ থুবরে পড়ে আছে। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯০০ সালের শাসনবিধি আইন চক্রান্ত করে বাদ দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। এই আইন আমাদের অধিকারের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। আমাদের অধিকার আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করে আদায় করে নিতে হবে।
অধ্যাপক স্নিগ্ধা রেজোয়ানা বলেন, আদিবাসী নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় পৃথক আইন দরকার। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি নারীরা যেভাবে পাক-বাহিনী দ্বারা নির্যাতনের স্বীকার হয়েছিল, ঠিক তেমনি বর্তমানে আদিবাসী নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সমাজে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কথা তিনি তুলে ধরেন।
রেখা সাহা বলেন, মূল ধারার আন্দোলনের সাথে আদিবাসী নারী আন্দোলন যুক্ত হওয়া এটাও একটা অর্জন। মূলধারার নারী আন্দোলনের সাথে আদিবাসী নারী আন্দোলন বর্তমানে একসাথে চলার জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সকলের অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরী। সবার উপর মানুষ সত্য, আসুন সবাই মিলে মানবতার মানবিক আন্দোলন গড়ে তুলি।
অজয় এ মৃ বলেন, আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ককে রক্ষা করার জন্য সবাইকে এগিয়ে থাকতে হবে। তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে। আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ককে সারা বাংলাদেশের আদিবাসী নারীদের জন্য ছাতা হিসেবে তৈরী করা দরকার।
গৌরাঙ্গ পাত্র বলেন, আদিবাসী নারীদের জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন সংরক্ষণের জন্য আমাদের সংলাপ করা প্রয়োজন। আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ককে শক্তিশালী করার জন্য সারা বাংলাদেশের আদিবাসী নারীদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আদিবাসী নারীদের অধিকারহীনতার বিষয়গুলো জাতীয় পর্যায়ে তুলে ধরতে হবে।
উদ্বোধনী অধিবেশনে নিম্নলিখিত সুপারিশসমূহ উপস্থাপন করা হয়-
১. আদিবাসী নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধে দ্রুত ও কার্যকর হস্তক্ষেপ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা, জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা এবং আদিবাসী নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা;
২. সহিংসতার শিকার আদিবাসী নারী ও শিশুদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ, চিকিৎসা ও আইনি সহায়তা প্রদান করা;
৩. জাতীয় সংসদসহ স্থানীয় ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে আদিবাসী নারীদের প্রতিনিধিত্ব ও অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করার জন্যে আসন সংরক্ষণের দাবি জানানো;
৪. নারী নেতৃত্বমূলক বিষয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং সেই প্রশিক্ষণে বাস্তবভিত্তিক বিষয়াবলী সংযোজন করা। যেমন: এফআইআর লেখা, থানায় সাধারণ ডায়েরি করা;
৫. বাংলাদেশের আদিবাসী নারীদের সহিংসতার মাত্রা পর্যবেক্ষণ করার জন্য একটি পর্যবেক্ষক কমিটি গঠনের সুপারিশ করা, যেন এই কমিটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পরপর আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাস এবং সরকারের কাছে প্রতিবেদন ও সুপারিশমালা পেশ করবে;
৬. জাতীয় নারী নীতিমালাসহ অন্যান্য নীতিমালা গ্রহণের সময় নারী নেতৃবৃন্দের প্রতিনিধিত্বের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা;
৭. স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় আদিবাসী নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা;
৮. পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের দাবি জানানো;
৯. আদিবাসী নারীসহ নারীর প্রতি সকল ধরনের নির্যাতন বন্ধে প্রশাসনের কার্যকর ভূমিকা রাখা;
১০. শিক্ষা, চাকুরীক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবি জানানো;
১১. আদিবাসী নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন জোরদার করা।