হিল ভয়েস, ২৫ এপ্রিল ২০২০, রাঙ্গামাটি: জুরাছড়ি উপজেলা থেকে রাঙ্গামাটি জেলা সদর হাসপাতালে নেয়ার পথে তল্লাসীর নামে সুবলং ক্যাম্পের সেনাবাহিনী কর্তৃক পৌনে একঘন্টা আটকে রাখার কারণে হাসপাতালে পৌঁছার আগেই এক গর্ভবর্তী জুম্ম নারীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ভুক্তভোগী নারীর নাম মিসেস রনিকা চাকমা (২২)। তার শশুর বাড়ি বরকল হলেও গর্ভবর্তী হয়ে তার পিতার বাড়ি জুরাছড়ি উপজেলাধীন বনযোগীছড়া ইউনিয়নের বহেরাছড়ি গ্রামে আসেন। ঐ নারীর প্রসব বেদনা শুরু হলে গত ২৪ এপ্রিল ২০২০ ভোর রাত ৩:১৫ টার দিকে পরিবারের লোকজন তাকে নিয়ে রাঙ্গামাটির উদ্দেশে রওনা দেন।
অভিযোগটি উঠে এসেছে গত ২৪ এপ্রিল ২০২০ অমর সিদ্ধু চাকমা নামে একজন ব্যক্তির ফেসবুক ওয়ালে দেয়া স্টাটাসে। অভিযোগটি অচিরেই ভাইরাল হয়েছে এবং অনেককে দুঃখ ও ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। পরে ভিকটিমের স্বজনের সাথে যোগাযোগ করে ঘটনার সত্যতার প্রমাণও পাওয়া গেছে।
অমরসিন্ধু চাকমা ঐ গর্ভবর্তী নারীর মৃত্যুর জন্য সরাসরি সুবলং ক্যাম্পের সেনাবাহিনীর চেকপোস্টে দায়িত্বরত সেনা সদস্যদের তল্লাশির নামে নির্দয় ও অবিবেচক আটকাবস্থাকে দায়ী করেন। দীর্ঘ সময় যাবৎ যদি সেখানে সেনা সদস্যরা আটকে না রাখতো তাহলে ঐ নারীকে মরতে হতো না বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তবে রূপম চাকমা নামে এক ব্যক্তি ২৪ এপ্রিল ২০২০ তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে সামাজিক কুসংস্কারকে দায়ী করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘এদায় আমাদের, সমাজকেও নিতে হবে।’ তিনি গ্রামের ক্লিনিকেই নিরাপদ মাতৃত্ব সম্ভব বলে মনে করে বলেন, ‘প্রান্তিক জনগোষ্ঠীদের ও আমাদের জানা থাকা উচিত এখন গ্রামের সরকারি কমিউনিটি ক্লিনিক কিংবা স্বাস্থ্য বিভাগে নিরাপদে মাতৃত্ব সেবা দেওয়া হচ্ছে।’
তবে তার এ বক্তব্য আংশিকভাবে সত্য হলেও, সর্বাংশে সত্য নয় বলে অনেকে ফেসবুকে মন্তব প্রদান করেন। তাছাড়া এই মর্মান্তিক ঘটনাটির ক্ষেত্রে সেই সামাজিক কুসংস্কারটি মূখ্য ভূমিকা পালন করেনি। তারা যদি এতই কুসংস্কারাচ্ছন্ন থাকতো তাহলে তারা রাঙ্গামাটি শহরের হাসপাতালে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দিতো না।
মহামারী করোনার প্রাদুর্ভাবের বিশেষ অবস্থার কারণেই তারা শেষ পর্যন্ত রাঙ্গামাটি শহরের হাসপাতালে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এক্ষেত্রে বরং এই বিশেষ পরিস্থিতি ও বিশেষ অবস্থার কথা বিবেচনা করে সেনাসদস্যরা যদি এহেন অমানবিক আচরণ না করতো তাহলে ঐ নারীর এহেন মৃত্যু হতো না বলে অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
ঘটনার বিবরণে অমর সিদ্ধু চাকমা উল্লেখ করেন যে, নিহত গর্ভবর্তী নারীর পিতার বাড়ি হচ্ছে জুরাছড়ি উপজেলায়। তার বিয়ে হয়েছিল বরকল উপজেলায়। গত ২৪ এপ্রিল ভোরে তার প্রসব বেদনা শুরু হলে তাকে রাঙ্গামাটি জেলা সদর হাসপাতালে নেওয়ার জন্য রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় তার স্বামীসহ পরিবারের আত্মীয়-স্বজন। সচরাচর জুরাছড়ি থেকে রাঙ্গামাটি আসার একমাত্র উপায় জলপথ বিধায় লঞ্চে করে তাকে হাসাপাতালে নেওয়া হচ্ছিল।
বরকল উপজেলাধীন সুবলং-এ পৌঁছলে সেখানকার চেকপোস্টে থাকা আর্মি’রা তাদের লঞ্চ আটকায়। আনুমানিক ৪৫ মিনিট আটকিয়ে রাখার পর গর্ভবতীর অবস্থা গুরুতর হলে পরে তাদের লঞ্চ ছেড়ে দেওয়া হয় বলে অমর সিন্ধু চাকমা উল্লেখ করেন।
তিনি আরো উল্লেক করেন যে, যখনই উক্ত গর্ভবর্তী নারী প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন এবং বার বার অজ্ঞান হয়ে পড়ছিলেন, ঠিক তখনই সেনাবাহিনীরা তাদের লঞ্চকে ছেড়ে দেয়।
গত ২৪ এপ্রিল ২০২০ সকাল আনুমানিক ৭:৩০ টায় গর্ভবতী অবস্থায় উক্ত নারীর মৃত্যুবরণ হয়েছে বলে অমর সিন্ধু জানান। সেনাবাহিনী যদি ৪৫ মিনিট লঞ্চটাকে আটকিয়ে না রাখত, এভাবে গর্ভবতী অবস্থায় এই নারীকে মরতে হতো না এবং মায়ের সাথে যে শিশুটি মায়ের গর্ভে মৃত্যু বরণ করলো সেই শিশুও পৃথিবীর মুখ দেখতো বলে তিনি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
অমর সিন্ধু চাকমা ক্ষোভ জানিয়ে তার ফেসবুক ওয়ালে উল্লেখ করেন যে, নিরাপত্তার অজুহাতে কারোর জীবন হুমকির মুখে ফেলে দেওয়া সেনাবাহিনী বা অন্য কারোরই অধিকার নেই।
তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার কর্তৃক ২০০১ ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামে একপ্রকার সেনা শাসন জারির ফলে সেনাবাহিনী আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে তল্লাসী ও টহলের নামে অবাধে এধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে।