হিল ভয়েস, ২১ এপ্রিল ২০২০, বান্দরবান: দেশে যখন করোনাভাইরাসের ক্রান্তিকাল চলছে, তখনও বান্দরবানে থেমে নেই বহিরাগত ভূমিদস্যু এবং আদিবাসী জুম্মদের উচ্ছেদকারী এমএস গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জিকে শামীম এবং জসিম উদ্দীন মন্টুদের বর্বরতা। তাদের মালিকানাধীন সিলভান ওয়াই রিসোর্ট ও স্পা লিমিটেড-এর লোকজন গত ১৮ এপ্রিল ২০২০ শনিবার স্থানীয় খেটে খাওয়া জুম্ম গ্রামবাসীদের পাঁচ হাজারের অধিক রাবার গাছ পুড়ে ছাই করে দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। এতে বাগানের অনেক আম ও কলা গাছও পুড়ে যায় বলে জানা গেছে।
স্থানীয় সূত্র থেকে যাচাই করে ঘটনার সত্যতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। জানা যায় যে, ভুক্তভোগী বাগানের মালিক ও সাইঙ্গ্যা ত্রিপুরা পাড়ার কার্বারী বীরেন্দ্র ত্রিপুরা গত রবিবার ১৯ এপ্রিল বান্দরবান সদর থানায় মামলা করতে গেলে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো: শহিদুল ইসলাম মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানান।
এ সময় থানার ওসি গ্রামবাসীদেরকে পরামর্শ দেন অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার মো: শহিদুল আলমের কাছে বিষয়টি জানানোর জন্য। কিন্তু এডিসির সাথে দেখা করার জন্য তার অফিসে গেলে চলমান লকডাউনের কারণে তার দেখা পাননি গ্রামবাসীরা। অন্যদিকে ফোনে যোগাযোগ করা হলে এডিসি ব্যস্ত আছেন বলে জানিয়ে দেয়া হয় গ্রামবাসীদেরকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বস্তুত স্থানীয় আদিবাসী জুম্মদের উচ্ছেদ এবং তাদের বাস্তুভিটা ও জুম ভূমি বেদখলের হীনউদ্দেশ্য নিয়েই জিকে শামীম এবং জসিম উদ্দীন মন্টুর লোকেরা জুম্মদের রাবার বাগান ও ফলের বাগানে আগুন দিয়েছে। ইতোমধ্যে এই জিকে শামীম এবং জসিম উদ্দীন মন্টু পর্যটন রিসোর্ট ও বিলাস বহুল হোটেল নির্মাণের নামে ভয়ভীতি দেখিয়ে, ষড়যন্ত্র করে, সরকারি দলের স্থানীয় নেতা ও প্রশাসনের লোকদের হাত করে স্থানীয় জুম্মদের কয়েকশ একর ভূমি বেদখল করে নিয়েছে। ফলে এই এলাকার বহু আদিবাসী জুম্ম পরিবার তাদের পূর্বপুরুষের ভিটে মাটি ছেড়ে অন্যত্র যেতে বাধ্য হয়েছে।
আদিবাসীদের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের নিকট বারবার অভিযোগ করা হলেও এবং বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে এবিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও সরকার ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কার্যকর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। উপরন্তু সরকারি দলের স্থানীয় নেতৃত্বের পক্ষ থেকে এই জিকে শামীম এবং জসিম উদ্দীন মন্টুদের পক্ষে সাফাই গাইতে দেখা গেছে।
জানা গেছে, গত ২০১৯ সালের জুন মাসের প্রথম দিকেও একবার জুম্ম গ্রামবাসীদের রাবার বাগানে আগুন দেয় জিকে শামীম এবং জসিম উদ্দীন মন্টুর লোকজন। সেসময় সাইঙ্গ্যা ত্রিপুরা পাড়ার গ্রাম প্রধান বীরেন্দ্র ত্রিপুরা পুলিশের নিকট তাদের রাবার বাগানে আগুন দেয়ার কথা জানালে, পুলিশ উল্টো গ্রামবাসীদের বিরুদ্ধে জিকে শামীম এবং জসিম উদ্দীন মন্টুর বাগানে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে মামলা রয়েছে বলে জানায়।
ভুক্তভোগী গ্রামবাসীরা জানান যে, গত ২৯ জানুয়ারি ২০১৯ তারিখে জসিম উদ্দিন ‘অবৈধ অনুপ্রবেশ’-এর অভিযোগ এনে চারজন জুম্ম গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে বান্দরবান সদর থানায় ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এই সাজানো মামলাটি দায়ের করেন। সেই মামলায় দেরি না করে সাইঙ্গ্যা পাড়ার সুর্য সেন ত্রিপুরাসহ মৌজার হেডম্যান পাইনচা থোয়াই মারমা ও তার ছেলেকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ।
গত ৯ জুন ২০১৯ তারিখে কয়েকটি গ্রামের জুম্ম অধিবাসীরা সিলভান ওয়াই রিসোর্ট ও স্পা লিমিটেডের বিরুদ্ধে তাদের জুম ভূমি জবর দখল, রাবার বাগান পুড়িয়ে দেয়া এবং মিথ্যা মামলা দায়ের করে হয়রানি করার অভিযোগ জানিয়ে বান্দরবান ডেপুটি কমিশনারের নিকট স্মারকলিপি পেশ করেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সিলভান ওয়াই রিসোর্ট ওস্পা লিমিটেডের বিরুদ্ধে কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
জিকে শামীমের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বদৌলতে সিলভান ওয়াই রিসোর্ট ও স্পা লিমিটেডের তান্ডবে ইতোপূর্বে বান্দরবান সদর উপজেলার সাইঙ্গা মারমা পাড়া উচ্ছেদ হয়ে গেছে। এরপর পার্শ্ববর্তী গ্রামের স্থানীয় গ্রামবাসীদের জমি ধীরে ধীরে বেদখল করতে থাকে। সাইঙ্গ্যা ত্রিপুরা পাড়া, লাইমি পাড়া ও হাতিভাঙ্গা পাড়ার প্রায় ১৭০ পরিবার আদিবাসী জুম্ম উচ্ছেদের হুমকিতে রয়েছে। জানা গেছে, রিসোর্টের কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে পার্শ্ববর্তী আদিবাসী গ্রামের অন্তত ২৫০ একর ভূমি বেদখল করে নিয়েছে।
স্থানীয় প্রশাসনের কাছে বারবার বিষয়টি অবগত করা সত্ত্বেও শুধু তদন্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখে রিসোর্ট মালিকদেরকে অবাধে ভূমি বেদখলের সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। এমনকি প্রশাসনের তরফ থেকে নির্দেশনা দেয়া হলেও তা সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে চলছে সিল্ভান ওয়াই রিসোর্ট ও স্পা লিমিটেড কর্তৃপক্ষ। পুলিশ প্রশাসনকে নিজেদের পক্ষে রাখার জন্য এবং নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ ক্যাম্পের দ্বিতল ভবন নির্মাণার্থে জিকে শামীম ও জসিম উদ্দিন তাদের বেদখলকৃত জমি থেকে প্রায় এক একরের মতো জমি এবং ২৬ লাখ টাকা প্রদান করেন বলে ডেইলী স্টারে সংবাদ প্রকাশিত হয়।
যোসেফ ত্রিপুরা জানান যে, ২০১৯ সালের নভেম্বরে তারা প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করেন এবং এক্ষেত্রে তাঁর হস্তক্ষেপ কামনা করে জন্য এ বিষয়টি তুলে ধরেন। তৎপ্রেক্ষিতে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কাজের কাজ কোন অগ্রগতি লাভ করেনি। ক্ষমতাসীন দলের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার জোরে সিলভান ওয়াই রিসোর্ট ও স্পা লিমিটেড বরঞ্চ আরো জোরালোভাবে স্থানীয় জুম্মদের উচ্ছেদ করে তাদের চিরায়ত ভূমি দখল করে চলেছে বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছে।
উল্লেখ্য যে, জিকে শামীম এবং জসিম উদ্দীন মন্টু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরই লোক। গত ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ তারিখে ঢাকা থেকে অস্ত্র ও মানি লন্ডারিং মামলায় গ্রেফতারকৃত এবং বহুল আলোচিত অবৈধ ক্যাসিনো কারবারের সাথে জড়িত এই জিকে শামীম ছিলেন যুবলীগের সমবায় বিষয়ক সম্পাদক এবং সিলভান ওয়াই রিসোর্ট ও স্পা লিমিটেডের পরিচালক। আর জসিম উদ্দিন মন্টু হচ্ছেন সিলভান ওয়াই রিসোর্টের চেয়ারম্যান এবং চট্টগ্রাম-১৪ সংসদীয় আসনের সরকারি দল আওয়ামী লীগের সাংসদ নজরুল ইসলাম চৌধুরীর ছোট ভাই। জিকে শামীম ও জসিম উদ্দীন মন্টু তারা কেউই পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা নয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও চুক্তি মোতাবেক প্রণীত পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ১৯৯৮ অনুসারে পার্বত্য জেলা পরিষদের পূর্বানুমোদন ব্যতীত পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দা নন এমন কোন ব্যক্তি পার্বত্য জেলায় জায়গা-জমি ক্রয় ও বন্দোবস্তী নিতে পারেন না।
জানা গেছে, জিকে শামীম ও জসিম উদ্দীন মন্টু মাত্র বছর তিনেক আগে বান্দরবানে আসা-যাওয়া শুরু করেন এবং পাঁচ তারকা হোটেলের জন্য একটি জায়গা বাছাই করেন। ভূমি বেদখলে গোড়াতেই তারা ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়। তারা প্রথমে সাইঙ্গ্যা পাড়ার আদিবাসী পরিবারগুলোকে অর্থ হাওলাত দিতে থাকে। যখন এসব পরিবারগুলো হাওলাত শোধ করতে ব্যর্থ হয়, তখন তাদেরকে উচ্ছেদ করে জায়গা-জমি বেদখল করে ফেলে। এভাবে ১৩টি গ্রামের মধ্যে সর্বশেষ উচ্ছেদের শিকার হলো সাইঙ্গ্যা পাড়াটি।
জানা গেছে, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পরও বহিরাগত সেটেলার বাঙালিদের কর্তৃক এ পর্যন্ত বান্দরবান পার্বত্য জেলার বিভিন্ন উপজেলার অন্তত ৩০টি গ্রামের ভূমি বেদখল করা হয়েছে এবং স্থানীয় আদিবাসী জুম্মদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। আদিবাসী বন ও ভূমি অধিকার বিষয়ক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলনের বান্দরবান শাখার তথ্য অনুযায়ী কেবল চারটি উপজেলার বেদখলকৃত গ্রামগুলি হল- লামা উপজেলার আমতলি ম্রো পাড়া, মংবাইচর বাচিং মারমা পাড়া, চারিগ্যা ত্রিপুরা কার্বারী পাড়া, লু-লাইন মুখ ম্রো পাড়া ও সুনং ম্রো পাড়া; নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার রাঙ্গাঝিরি চাকমা পাড়া, ডালুঝিরি মারমা পাড়া, বাদুরঝিরি চাক পাড়া, লংগদু চাক পাড়া, হামরা ঝিরি মারমা পাড়া ও সাপমারা ঝিরিপাড়া; আলিকদম উপজেলার উকলিং পাড়া এবং বান্দরবান সদর উপজেলার সাইঙ্গ্যা মারমা পাড়া। সাইঙ্গ্যা মারমা পাড়া হচ্ছে সর্বশেষ উচ্ছেদের শিকার আদিবাসী গ্রাম। ২০১৮ সালে এই পাড়ার সর্বশেষ ৬ পরিবার উচ্ছেদ হয়ে যায়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও চুক্তি মোতাবেক প্রণীত পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ১৯৯৮ অনুসারে পার্বত্য জেলার এলাকাধীন বন্দোবস্ত যোগ্য খাসজমিসহ কোন জায়গা-জমি পরিষদের পূর্বানুমোদন ব্যতিরেকে ইজারা প্রদানসহ বন্দোবস্ত, ক্রয়, বিক্রয় ওহস্তান্তর করা এবং পার্বত্য জেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণ ও আওতাধীন কোন প্রকারের জমি, পাহাড় ও বনাঞ্চল পরিষদের সাথে আলোচনা ও ইহার সম্মতি ব্যতিরেকে অধিগ্রহণ ও হস্তান্তর করার উপর বিধিনিষেধ রয়েছে।
উপরন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক ‘ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা’ পার্বত্য জেলা পরিষদের আওতাধীন বিষয়। কিন্তু আজ অবধি উক্ত বিষয় ও ক্ষমতা পার্বত্য জেলা পরিষদে যথাযথভাবে হস্তান্তর করা হয়নি। অপরদিকে ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি অনুসরণে ডেপুটি কমিশনারগণ নামজারি, অধিগ্রহণ, ইজারা ও বন্দোবস্ত প্রদান প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছেন। একদিকে যেমন অবৈধভাবে ও দুর্নীতির মাধ্যমে বহিরাগত ব্যক্তিরা পার্বত্য চট্টগ্রামে জায়গা-জমি ক্রয় ও বন্দোবস্তী করে চলেছে, অন্যদিকে বনায়ন ও সেটেলারদের গুচ্ছগ্রাম সম্প্রসারণ এবং সেনা ক্যাম্প ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন ও সম্প্রসারণের নামে হাজার হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে।
এভাবেই পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরকারী বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে পদদলিত করে প্রতিনিয়ত চুক্তিবিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে চলেছে। তার মধ্য দিয়ে একদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণকে জাতিগত নির্মূলীকরণের কার্যক্রম, অন্যদিকে অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার পাকিস্তানী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে চলেছে।