হিল ভয়েস, ৫ জানুয়ারি ২০২৪, ঢাকা: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র তিনদিন বাকি। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর চাপ ক্রমশ বাড়ছে বলে অভিযোগ করেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। আজ বৃহস্পতিবার (৫ জানুয়ারি) সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্তের সাক্ষরিত এক বিবৃতির মাধ্যমে এই অভিযোগ করেন।
নির্বাচনের পূর্বাপর সময়ে সম্ভাব্য সাম্প্রদায়িক ঘটনাবলীর তথ্য গ্রহণ ও কার্যকর পদক্ষেপের নিমিত্তে গঠিত বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেলের প্রাপ্ত তথ্যমতে বেশ কিছু প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারনায় ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক উস্কানীমূলক বক্তব্য এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্প্রদায়ের নাম উল্লেখ করে অকথ্য ভাষায় ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে। প্রার্থী বিবেচনায় এলাকাভিত্তিক হিন্দু সম্প্রদায়কে হুমকি দিয়ে কোথাও বলা হচ্ছে তারা যেন কেন্দ্রে ভোট দিতে না যায়, আবার কোথাও বলা হচ্ছে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে বিশেষ মার্কায় ভোট দিতে হবে নইলে খবর আছে। সবার হিসেব রাখা হচ্ছে। হুমকিদাতাদের নির্দেশানুযায়ী কেন্দ্রে গেলে বা না গেলে পরবর্তীতে দেখে নেওয়া হবে। এর সাথে যোগ হচ্ছে নির্বাচনী মিছিলে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে প্রকাশ্যে হুমকি-ধমকি।
ঐক্য পরিষদ আশংকা করছে, এখনই যদি নির্বাচন কমিশন ও নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত সকল বাহিনী ত্বরিৎ ও দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ না করে, তবে নির্বাচনের দিন ও নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরপরই সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। উদাহরণ হিসেবে কয়েকটি সংসদীয় আসনের ঘটনা নিম্নে উল্লেখ করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জ-১ আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী রঞ্জিত সরকার। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বর্তমান এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতন প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন। তাঁরই উপস্থিতিতে সম্প্রতি সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার গোলকপুরে নির্বাচনী জনসভায় তাঁরই পক্ষে জামালগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম নবী হোসেন প্রকাশ্যে বলেছেন, ‘আপনারা এখন নৌকার প্রার্থীর জন্য সবাই এক হয়ে গেছেন। আমাদের এমপি. মোয়াজ্জেম হোসেন রতন গত ১৫ বছর হিন্দুদের যে সুযোগ সুবিধা দিয়েছেন তা আমরা মুসলমানরা পাইনি। আমাদের আসনে আমরা মুসলমানরা ৮৭ পার্সেন্ট। সনাতনরা মাত্র ১৩ পার্সেন্ট। এখন আপনারাই সিদ্ধান্ত নেন, ভগবান আমাদের শাসন করবেন, না আমরা ৮৭ পার্সেন্ট মুসলমান ঈমানি দায়িত্ব পালন করব?’
একই জনসভায় এম নবী হোসেন সুনামগঞ্জ-২ সংসদীয় আসনে জয়া সেনগুপ্ত সম্পর্কে বলেছেন, আমাদের মনোনয়ন না দেয়ার কারণ হলো ‘হিন্দু কোটা’। এবার আমাদের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা হিন্দু কোটায় ১৫টি সিট দিয়েছেন। তাদের কোটা আছে। এই কোটা প্রথায় ৫০ বছর ধরে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কোটাগত নির্বাচন করতেন। তাঁর স্ত্রী জয়া সেনগুপ্তও দুইবার একই আসন থেকে নির্বাচন করেছেন।
ঝিনাইদহ-১ সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আবদুল হাইয়ের পক্ষে ভোট চাইতে না যাওয়ায় তার অনুসারী ধলাহরচন্দ্র ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান বিশ্বাসসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে যেসব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন কাজ করছেন তাদেরকে অব্যাহতভাবে হুমকি প্রদান করে আসছে। নৌকায় ভোট না দিলে তাদেরকে ঘরবাড়ি ছাড়ার হুমকি দেয়া হচ্ছে।
কক্সবাজার চকরিয়াতে আওয়ামী লীগ অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিমকে সমর্থন দেয়ায় বিদ্রোহী প্রার্থী বর্তমান এমপি. হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করে চলেছে এবং ভয়ভীতি প্রদর্শন করছে তার অনুসারীরা।
বাগেরহাট-৩ সংসদীয় আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ইদ্রিস আলীর ঈগল প্রতীকের পক্ষে প্রচারণা করার সন্দেহে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়ক উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহারের নৌকা প্রতিকের কর্মী ও সমর্থকরা ইউনিয়ন পর্যায়ে ও বিভিন্ন গ্রামসহ বাড়ি বাড়ি গিয়ে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ভোটারদের নানাভাবে হুমকি-ধমকিসহ তাদের ওপর জুলুম, অত্যাচার—নির্যাতন ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলছে। এমনকি ভোট কেন্দ্রে প্রকাশ্যে নৗকা প্রতীকে সিল দিতে হবে বলেও শাসানো হচ্ছে। স্থানীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন এ ব্যাপারে গত ০২/০১/২০২৪ ইং তারিখ দুপুরে মোংলা প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করেছে।
গাইবান্ধা-২ সংসদীয় আসনে গাইবান্ধা সদর থানার অফিসার-ইন-চার্জ জনাব মাসুদ রানা বেশ কয়েকদিন যাবৎ বিভিন্নভাবে সদর থানার সনাতন সম্প্রদায়ের ভোটারদের জাতীয় পার্টির প্রার্থী জনাব আবদুর রশিদ সরকারের লাঙ্গল প্রতীকে ভোট দেয়ার জন্যে চাপ সৃষ্টি করছে এবং একই সাথে হিন্দু সম্প্রদায়কে ভোট কেন্দ্রে যেতে নিষেধ করছে। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের গাইবান্ধা জেলার সাধারণ সম্পাদক চঞ্চল সাহা এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার, ঢাকা বরাবরে গত ০৩/০১/২০২৪ ইং তারিখে একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন।
সাতক্ষীরা-২ সংসদীয় আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী ঈগল প্রতীকের মীর মোস্তাক আহম্মেদ রবি এমপি. জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ও অন্যান্য সনাতনী সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সাথে মতবিনিময় সভার আয়োজন করায় সাতক্ষীরা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদম মো: শাহ্জাহান ঐক্য পরিষদের নেতাদের দেখে নেয়ার হুমকি দিয়েছেন।
বরিশাল-২ সংসদীয় আসনে সংখ্যালঘু ও নিরীহ ভোটারদের ওপর হামলা হয়েছে। হামলাকারীরা গত ৩১/১২/২০২৩ ইং তারিখ ২নং হারতা ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ড নাথারকান্দিতে দীপঙ্কর পাড় ও উত্তম বিশ্বাসকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করেছে। তারা এখন বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেলে ভর্তি আছেন।
এছাড়াও সংখ্যালঘু এলাকায় গিয়ে ভোটারদেরকে হামলার হুমকি দেয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা বরাবরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
চট্টগ্রামের পটিয়া সংসদীয় নির্বাচনী এলাকায় নৌকার প্রার্থীর ক্যাম্প থেকে শ্লোগান দিয়ে স্থানীয় কেলিশহর ৪নং ওয়ার্ডের মহাজন পাড়ায় শ্রী শ্রী বিশ্বমঙ্গল গীতা সংঘ ও দুর্গা মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটেছে। গত ৩০/১২/২০২৩ ইং তারিখ রাত ৮টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার বিচার চেয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন গ্রামের লোকজন। হামলাকারীরা সবাই স্থানীয় এবং তারা মন্দিরে রক্ষিত মহোৎসবের মালপত্র নষ্ট ও ভাঙচুর করেছে। ঘটনার পরপরই পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
যশোর-৪ সংসদীয় আসন থেকেও প্রায় একই ধরনের অভিযোগ এসেছে।