হিল ভয়েস, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ঢাকা: পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের জন্য ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার জন্য দেশের প্রগতিশীল নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক দলসমূহের সমন্বিত প্লাটফর্ম হিসেবে গত ২০ ডিসেম্বর ২০২২ আত্মপ্রকাশ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন।
এই প্লাটফর্মটির ১ম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে গত শনিবার (২৩ ডিসেম্বর) আয়োজন করা হয় সংহতি আলোচনা সভার। প্লাটফর্মটির যুগ্ম সমন্বয়কারী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরীর সভাপতিত্বের এবং বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাবেক সভাপতি সুলভ চাকমা’র সঞ্চালনায় শুভেচ্ছা প্রারম্ভিক বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন এর যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন।
এছাড়া সংহতি বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতি কর্মী ও কবি শাহেদ কায়েস, ঐক্য ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ তারেক, এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য শরিফ সমশির, বাসদ এর সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ, সাবেক সাংসদ ও বাংলাদেশ জাসদ এর সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স প্রমুখ।
২৩ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের সদস্য মুর্শিদা আক্তার ডেইজীর স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন এর যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন বলেন, গতবছর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৫ বছর পেরিয়ে গেল। তখন আমরা লক্ষ্য করলাম পার্বত্য চুক্তি যে উদ্দেশ্যে করা হল তা পূরণ হয়নি। যদি পূরণ হত আমরা পাহাড়ের মানুষের মধ্যে আনন্দ উচ্ছ্বাস দেখতাম। কিন্তু সেটার বদলে আমরা দেখছি পার্বত্য চুক্তির মূল ধারাগুলো বাস্তবায়ন করা হয়নি। তাই আমরা নাগরিক সমাজ ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোসহ বৃহত্তর পর্যায়ে এই চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য একটি প্লাটফর্ম গড়ে তুললাম। এই এক বছরে আমরা নানাভাবে এই চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সচেতনতা গড়ে তুলেছি এবং বিভিন্ন বিভাগীয় পর্যায়ে সমাবেশেরও আয়োজন করেছি। আমরা সম্মিলিতভাবে আমাদের প্রয়াস অব্যাহত রাখবো।
ঐক্য ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ তারেক বলেন, যে সরকার পার্বত্য চুক্তি করেছিল সেই সরকারই টানা ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে। কিন্তু তাদের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তারা এই চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করেনি। ফলে পাহাড়ের মানুষকে এখনো এই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য লড়াই করতে হচ্ছে। এই সরকারকে অনুরোধ জানাই, হয় আপনারা বলেন কবে এই চুক্তি বাস্তবায়ন করবেন, নতুবা বলেন কেন এই চুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। চুক্তি ভঙ্গের জন্য এই সরকারকে নিন্দা জানাচ্ছি।
সংস্কৃতি কর্মী শাহেদ কায়েস বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার ফলে পাহাড়ে এক ধরনের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি চলছে। সেখানে এখনো পর্যন্ত জুম চাষের ভূমি হারাচ্ছে। এছাড়া বান্দরবানের রাবার কোম্পানি থেকে শুরু বিভিন্ন কোম্পানি পাহাড়ীদের ভূমি বেদখল করছে। আমরা আশা করেছিলাম এই চুক্তির ফলে পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।কিন্তু তা এখনো হয়নি।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য শরিফ সমশির বলেন, আমি যেসময় ছাত্র ছিলাম সেসময় পাহাড়ে গিয়ে একবার সেনাক্যাম্পে হয়রানির শিকার হয়েছিলাম। আমাকে নামিয়ে সেখানে নানা জিজ্ঞাসা করা হল। আমি সে এলাকার মানুষ নয়, তারপরও সেটা আমার মানবিক মর্যাদাবোধে আঘাত লেগেছে। তাহলে সেখানকার আদিবাসীরা যারা প্রতিনিয়ত এই ধরনের আচরণের শিকার হচ্ছেন তাদের ক্ষেত্রে কেমন লাগবে সেটা ভেবে দেখুন। পরে এই সমস্যাগুলো সমাধানে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিটি এ অঞ্চলের মানুষের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার একটা পদক্ষেপ হিসেবে নানা মহলের কাছে সমাদৃত হয়েছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত এই চুক্তির বাস্তবায়ন হযনি। বরং এই চুক্তিকে বিরোধীতা করে ইউপিডিএফ নামে যে সংগঠনটির সৃষ্টি হয় এবং ক্রমান্বয়ে তাদের যে সশস্ত্র বিরোধীতা সেটাকে আমরা অনেক বাঙালি বামপন্থি ও ডানপন্থিরা সমর্থন করছি। এগুলো পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের পথকে আরো জটিল করেছে বলে মনে করি।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, রাষ্ট্রের পক্ষে যারা চুক্তি করেছিল, তারা যে এটি বাস্তবায়ন করবে সেটা আশা করা যাচ্ছে না। কেননা, এই চুক্তি বাস্তবায়ন করতে গেলে প্রথমেই রাজনৈতিকভাবে ঐক্যমত্য থাকতে হবে। কিন্তু যে দলটি করেছিল তাদের যে রাজনৈতিক দর্শন আমার মনে হয় না তারা দলীয়ভাবেও একমত ছিল। অন্যদিকে আমলারাও এই চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একমত নয়। কেননা, যদি রাজনৈতিকভাবে ঐক্যমত্যে পৌঁছা যেত তখন সামরিক, বেসামরিক আমলাদেরকে বুঝিয়ে এই চুক্তি বাস্তবায়ন করা যেত। কিন্তু সেসবের কোনোটাই হয়নি কেননা, রাজনৈতিকভাবে এই চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে ঐক্যমত্য নেই।
বাসদ এর সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, সরকার চুক্তি করেছে চুক্তি ভঙ্গ করার জন্য। আমরা দেখতে পাচ্ছি জনসংহতি সমিতি বলছে ২৯ ধারা কোনোভাবেই হাত দেয়নি সরকার। অন্যদিকে পাহাড়ে অঘোষিত সেনাশাসন জারি রয়েছে। কিন্তু সরকার তার প্রচারযন্ত্রের মধ্য দিয়ে নানাভাবে বিভ্রান্ত করছে। সরকার বলছে পার্বত্য চুক্তির ৭২ টি ধারার মধ্যে ৬৫ টি ধারা বাস্তবায়ন করেছে। এসবের বিরুদ্ধে আমাদের যে আন্দোলন সেটার অনুপস্থিতি দেখি আমি। এখন আমাদের কাজ হচ্ছে এই চুক্তি বাস্তবায়নের প্রকৃত চিত্র জনগণের সামনে নিয়ে যাওয়া।
এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, সরকার স্বেচ্ছায় হোক বা চাপে পড়ে হোক এই পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু এই চুক্তি যদি বাস্তবায়ন না করে তবে জাতি হিসেবে আমরা প্রতারক হয়ে থাকবো। অন্যদিকে পাহাড়ী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় চুক্তি বাস্তবায়ন জরুরি।
সাবেক সাংসদ ও বাংলাদেশ জাদস এর সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান, সরকারের চুক্তি মানে রাষ্ট্রীয় চুক্তি। কাজেই এই চুক্তি বাস্তবায়ন করতেই হবে। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকেই আছেন যারা পাহাড়ি মানুষদেরকে মানুষই মনে করে না। কিন্তু সরকারকে বলবো- অনেক সময় গড়িয়ে গেছে। আর কাল বিলম্ব না করে এই চুক্তি বাস্তবায়ন করুন। পাহাড়িদের আত্মমর্যাদা বোধে আঘাত ও বঞ্চনা দীর্ঘায়িত হলে যদি পাহাড় আরো অশান্ত হয় তবে এ দায় দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে যুগ্ম সমন্বয়কারী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হলে এবং সব মানুষের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে হলে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করার কোনো বিকল্প নেই। আমরা যদি মনে করি পাহাড়ীদের আন্দোলন পাহাড়িরা করবে- এই দিন ফুরিয়ে গেছে। আমাদেরকে সম্মিলিতভাবেই এই সংগ্রাম জারি রাখতে হবে।