উদয়ন তঞ্চঙ্গ্যা
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অরুণাচলে বসবাসরত চাকমাদের রাজনৈতিক অধিকারের বঞ্চনার কথা আজ কারো কাছে অজানা নয়। সেই রাজনৈতিক বঞ্চনার মাঝেও তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন চেতনা ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা গেছে। দেখা দিয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও সচেতনতা। মানুষের মধ্যে শ্রমশক্তি হচ্ছে আত্মনির্ভরতার মূল ভিত্তি। তাই স্বয়ম্ভরতা অর্জনের জন্য অরুণাচলের প্রায় অধিকাংশ চাকমাদের মধ্যে উৎপাদনমুখী সচেতনতা লক্ষ্যনীয়। সেজন্য তাদের মধ্যে পরিশ্রমমুখী চেতনা ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করতে দেখা গেছে।
বলা নিষ্প্রয়োজন যে, উনিশ্শ ষাট দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামের কাপ্তাই নামক স্থানে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক জলবিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণ করায় এক লক্ষাধিক জুম্ম জনগণ তাদের চিরায়ত ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে পড়ে, যারা সিংহভাগই ছিলেন চাকমা। পার্বত্যাঞ্চলের মোট ধান্যজমির ৪০ শতাংশ জমি – যার পরিমাণ ৫৪ হাজার একর – কাপ্তাই হ্রদের জলে তলিয়ে যায়। পাকিস্তান সরকার কর্তৃক উপযুক্ত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না নেয়ায় এবং সমমানের জমির অপ্রতুলতার কারণে এই উদ্বাস্তু জনগণের মধ্যে প্রায় ৪০ হাজার চাকমা অরুণাচলে পাড়ি জমায়, যেখানে ভারত সরকার কর্তৃক তাদেরকে পুনর্বাসন করা হয়। সেই ৪০ হাজার জনগোষ্ঠীর বংশধর ‘বড় পরং’-এর ৬০ বছর পর এখন প্রায় এক লক্ষ জনসংখ্যায় রূপান্তরিত হয়েছে বলে মনে করা হয়।
ষাট দশকে কেবল চাকমা জনগোষ্ঠীকে অরুণাচলে পুনর্বাসন করা হয়নি, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত ’৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে উদ্বাস্তু হাজং জনগোষ্ঠীর কিছু লোককেও অরুণাচলে পুনর্বাসন করা হয়। বর্তমানে চাকমা ও হাজং জনগোষ্ঠীর প্রতিবেশী হিসেবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে বসবাস করছে। হাজংদের জনসংখ্যা বর্তমানে আনুমানিক ১০ হাজারের মতো হতে পারে বলে জানা গেছে।
এটা জানা যায় যে, অরুণাচলে চাকমা-হাজংদের পুনর্বাসন প্রদানের ক্ষেত্রে প্রাথমিক অবস্থায় স্থানীয় অরুণাচলী আদিবাসী জনগণের সহযোগিতা ছিল। চাকমা-হাজংদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে তাদের কোন আপত্তি ছিল না বলে জানা গেছে। তখন অরুণাচলের পরিচয় ছিল নর্থ ইষ্টার্ণ ফ্রন্টিয়ার এজেন্সী বা নেফা নামে। সেই সময় নেফা কর্তৃপক্ষ চাকমা-হাজংদের রেশন কার্ড, বন্দুকের লাইসেন্স, পিআরসি (স্থায়ী বাসিন্দার সার্টিফিকেট), আধা-সামারিক বাহিনীসহ সরকারি চাকরি নিয়োগ থেকে শুরু করে তফসিলী জনজাতি হিসেবেও স্বীকৃতি প্রদান করেছিল বলে জানা যায়। এমনকি নাগরিকত্ব সার্টিফিকেট নেয়ার জন্যও চাকমা-হাজংদেরকে প্রশাসনের তরফ থেকে বলা হয়েছিল। মুষ্ঠিমেয় কিছু লোক সেই নাগরিকত্ব সার্টিফিকেট নিলেও অধিকাংশ লোক নেননি। তৎসময়ে নাগরিকত্ব সার্টিফিকেট না নেয়ার ক্ষেত্রে চাকমা-হাজংদের মধ্যে প্রকৃতি-নির্ভর ক্ষুদে ও সরল উৎপাদকের সরলতা, সচেতনতার অভাব, দূরদর্শিতার ঘাটতি ইত্যাদি কাজ করেছিল।
পরবর্তীতে এই অঞ্চলটি ইউনিয়ন টেরিটরি থেকে ১৯৮৭ সালে অরুণাচল নামে প্রদেশে রূপান্তরিত হলে রাজ্য রাজনীতিতে চাকমা-হাজংদের নিয়ে একটি রাজনৈতিক ইস্যু তৈরি হয়। চাকমা-হাজংদেরকে অরুণাচল থেকে তাড়িয়ে দিতে রাজ্যের ছাত্র সংগঠন থেকে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ক্ষেত্র বিশেষে রাজনৈতিক শ্লোগান তুলে ধরেন। ফলে রাজ্য প্রশাসন থেকে ধীরে ধীরে চাকমা-হাজংদের রেশন কার্ড, বন্দুকের লাইসেন্স, স্থায়ী বাসিন্দা ও তফসিলী জনজাতির সার্টিফিকেট নানা অজুহাতে কেড়ে নেয়া হয় বলে জানা যায়। তাদেরকে অরুণাচলের নাগরিক হিসেবে অস্বীকার করা হয়। ভোটার হিসেবে তাদেরকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। ভারতের মাটিতে জন্ম নেয়া তাদের ছেলেমেয়েদেরকে জন্ম সনদপত্র লাভ থেকেও বঞ্চিত করা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
তবে হাজার দুয়েক চাকমা ভোটার হিসেবে তালিকাভুক্ত রয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে নতুন কেউ ভোটার তালিকাভুক্ত হতে পারছেন না নাগরিকত্ব সার্টিফিকেট ও জন্ম সনদপত্র না থাকার কারণে। ফলে তারা রাজনৈতিক ও নাগরিকত্ব অধিকার থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। ’৬৪ সালে ‘বড় পরং’-এর সময় যারা প্রাপ্ত বয়স্ক ছিলেন তারা অধিকাংশই বর্তমানে মারা যাচ্ছেন কিংবা বৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন। বসতি স্থাপনের পর ভারতের মাটিতে জন্ম নেয়া চাকমা-হাজংরাও নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকারের মতো সহজাত রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। অধিকন্তু তাদের উপর প্রতিনিয়ত অরুণাচল থেকে তাড়িয়ে দেয়ার রাজনৈতিক চাপ তো রয়েছেই। অরুণাচলের চাকমাদের আরো দু:খ হচ্ছে তারা আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সরকারি কোন সহায়তা লাভ করেন না। কৃষি ও জুম চাষ, গবাদি পশু পালন, মৎস্য, সমবায়, সমাজকল্যাণ, সংস্কৃতি, নারী ও যুব উন্নয়ন, শিল্প ও বাণিজ্য ইত্যাদির ক্ষেত্রে তারা রাজ্য সরকার থেকে কোন উন্নয়ন বরাদ্দ লাভ করেন না।
তবে তাদের উপর যে অব্যাহত রাজনৈতিক চাপ এবং তাদের প্রতি যে বঞ্চনা-অবহেলা রয়েছে, তাতে চাকমাদের মধ্যে এক ধরনের মাটি কামড়ে থাকার, পায়ের মাটির ভর করে উঠে দাঁড়ানোর, বাস্তুভিটায় টিকে থাকার উদগ্র আকাক্সক্ষা তৈরি হয়েছে। ফলে ছেলেমেয়েদের শিক্ষায় শিক্ষিত করা, আত্মনির্ভরতা অর্জনে উৎপাদনে মনোনিবেশ করা, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কঠোর পরিশ্রম করা, ব্যবসা-বাণিজ্যে আত্মনিয়োজিত হওয়া ইত্যাদি সচেতনতা দেখা দিয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। বলা যায়, তাদের উপর যে বঞ্চনার অভিশাপ রয়েছে, সেটাকে তারা প্রায় আশীর্বাদে রূপান্তর করে নিচ্ছে।
এটা নি:সন্দেহে একটা ইতিবাচক দিকে যে, অরুণাচলের চাকমা-হাজংরা নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকারের মতো রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকলেও শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ইত্যাদি থেকে রাজ্য সরকারের নাগরিক সুবিধা থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত নয়। চাকমা-হাজং অধ্যুষিত প্রায় প্রতিটি এলাকায় সরকারি স্কুল রয়েছে। আরো উল্লেখ্য যে, ষাট দশকে চাকমা-হাজংদের পুনর্বাসনের সাথে সাথে ভারত সরকার প্রতিটি এলাকায় স্কুল প্রদান করেছিল, যেসব স্কুলে সেসময় পুনর্বাসিত অনেক চাকমা শিক্ষকতা করেছেন। তবে বর্তমান সময়ে প্রতিটি স্কুলে শিক্ষকরা হচ্ছেন স্থানীয় আদিবাসী খামতি, নিশি, মিশমি, সিংফো, নকতে জনগোষ্ঠীর।
চাকমা-হাজং অধ্যুষিত এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থাও এত খারাপ বলা যাবে না। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা না হলেও অন্তত গাড়ি চলাচলের মতো রাস্তা রয়েছে। এসব রাস্তাঘাট মিজোরামের চাকমা অধ্যুষিত অঞ্চলের রাস্তাঘাট থেকে বহুলাংশে উন্নত সেটা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এনজিও’র মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে ‘আশা’ নামক একটি এনজিও প্রতিটি এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক কাজ করে থাকে। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা একেবারেই নেই সেটা বলা যাবে না। তবে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা তেমন উন্নত ও সম্প্রীতি-বান্ধব নয়। ফলে অনেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আসামের তিনসুকিয়া কিংবা গৌহাটিতে গিয়ে থাকেন।
সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো দিক হচ্ছে চাকমাদের মধ্যে উৎপাদনমুখী চেতনা ও সন্তান-সন্তুতিদের শিক্ষায় শিক্ষিত করার উদগ্র বাসনা। কাপ্তাই বাঁধে উদ্বাস্তু হওয়ার পর পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমাদের মধ্যে যেমন শিক্ষার জোয়ার এসেছিল, অরুণাচলের চাকমাদের মধ্যেও সেধরনের শিক্ষার জোয়ার চলছে বলে বলা যেতে পারে। অনেকের পক্ষে হয়তো ছেলেমেয়েদেরকে উচ্চ শিক্ষা দিতে পারছেনা না বটে, তবে প্রাইমারী বা মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করানোর প্রয়াস চলছে, যে শিক্ষা চাকমাদের মধ্যে উৎপাদনমুখী চেতনা তৈরি করে দিচ্ছে। যার ফলে প্রায় মানুষকে ফসল উৎপাদন, দোকান ব্যবসা, কাঁচা তরকারি ব্যবসা, ড্রাইভিং, মেকানিক্যাল ও নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতে দেখা যায়। শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে অনেক যুবক-যুবতী বিদেশে যেমন দুবাই, দক্ষিণ কোরিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপে কাজ করতে পাড়ি জমাচ্ছেন, তেমনি ভারতের অভ্যন্তরে দিল্লীর নয়ডা ও কর্নাটকের ব্যাঙ্গালোরের মতো বিভিন্ন শিল্প এলাকায় কাজের খোঁজে শহরমুখী হচ্ছেন।
অধিকাংশ পরিবার যার যতটুকু বাস্তুভিটা রয়েছে, প্রায় সবখানেই বাগান-বাগিচা ও ক্ষেত-খামার গড়ে তুলেছে। বিশেষ করে অধিকাংশ পরিবার সুপারী ও কলা বাগান গড়ে তুলেছে। এখন অনেকে ধীরে ধীরে আম, লেবু, বড়ই, মাল্টা ইত্যাদি ফলজ বাগানে মনোনিবেশ করছেন। তবে এখনো বাজারজাতকরণের সমস্যা রয়েছে। উৎপাদিত পণ্যের দাম অত্যন্ত কম। কেবল বাস্তুভিটায় নয়, স্থানীয় আদিবাসীদের কাছ থেকে জমি ভাড়া নিয়েও অনেকে উৎপাদনে নিয়োজিত হচ্ছেন। এসব উৎপাদনকে ‘জুম’ হিসেবে গণ্য করা হয়। স্থানীয় আদিবাসীদের কাছ থেকে এক কুরো জমি (এক কুরো সমান সাড়ে তিন কানি) বাৎসরিক ৯০০ টাকা থেকে ১,২০০ টাকায় ভাড়া নেয়া হয়। বলা যায় লোহিত, নামসাই ও চাংলাং জেলায় স্থানীয় আদিবাসীদের জঙ্গলা ভূমি চাকমাদের দ্বারাই চাষোপযোগী করা হচ্ছে। চাকমাদেরকে জমি ভাড়া দিয়ে চাষোপযোগী হওয়ার পর স্থানীয় আদিবাসীরা চা বাগান, ধান চাষ, বাস্তভিটা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কাজে লাগাচ্ছেন। উল্লেখ্য যে, লোহিত, নামসাই ও চাংলাং জেলাধীন চাকমা অধ্যুষিত এলাকা ও পার্শ্ববতী এলাকাগুলো সমতল ও খুবই উর্বর অঞ্চল।
যেমন ২নং ডায়ুন অঞ্চলের মণি ভূষন দেওয়ান মিশমি অধ্যুষিত অঞ্চলে গিয়ে মিশমিদের কাছ থেকে জমি ভাড়ায় নিয়ে এবছর প্রায় ১০ কুরো জমি চাষ করেছেন। সেই জমিতে তিনি ধান, কুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, আলু, পাপড়, ডাল ইত্যাদি চাষ করেন। ব্যবসায়ীরা ক্ষেত থেকে উৎপাদিত কৃষি পণ্য কিনে নিয়ে থাকেন। মণি ভূষন দেওয়ান সামনের বছর আরো অতিরিক্ত ১০ কুরো জমিতে তার উৎপাদন সম্প্রসারণ করবেন বলে জানিয়েছেন।
লোহিত জেলার চাংকাম এলাকার ২নং চাকমা বস্তীর বাসিন্দা কজমা চাকমার স্বামী ৫ বছর ধরে দক্ষিণ কোরিয়ায় রয়েছেন। তার শ্বাশুরীসহ স্বামীদের তিনভাই ও এক বোন যার যার সংসার নিয়ে মোটামুটি আর্থিক সঙ্গতি নিয়ে বসবাস করছেন। তাদের সকলের সুপারী বাগান ও ক্ষেত-খামার রয়েছে। তার একমাত্র ছেলে মাধ্যমিকে পরীক্ষা দিয়েছে। তাদের রয়েছে নিজস্ব ট্রাক্টর, যেগুলো দিয়ে নিজের জমি হাল দেন, অন্যের জমি ভাড়ায় কর্ষণ করে দেন এবং অন্যান্য মালামাল পরিবহনের কাজে ব্যবহার করেন। কজমা চাকমার ননদের (স্বামীর বড় বোন) স্বামী সুখবিন্দু চাকমা বলেছেন, তাদের এলাকায় সরকারি প্রাইমারী স্কুল আছে। সেখানে এলাকার ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করতে পারে। তবে মাধ্যমিক স্তরে পার্শ্ববর্তী স্থানীয় আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার হাই স্কুলে লেখাপড়া করতে যেতে হয়। ৯ম শ্রেণিতে ভর্তি হলে ডকুমেন্ট হিসেবে আধার কার্ড জমা দিতে হয়। স্কুলে চাকমা ও স্থানীয় আদিবাসী ছেলেমেয়েদের মধ্যে মাঝেমধ্যে ঝামেলা হলেও পাঠদানের ক্ষেত্রে স্কুলে চাকমা ছাত্রছাত্রীদেরকে তেমন কোনো বৈষম্য করা হয় না বলে জানান তিনি।
ডায়ুনের অধিবাসী চিগুলো চাকমা পেশায় একজন ড্রাইভার। ভাড়ায় চালিত তার নিজস্ব একটি মহেন্দ্র জীপ রয়েছে। আগামী বছর তিনি আরেকটি মহেন্দ্র পিকআপ কেনার পরিকল্পনা রয়েছে। তার দুই মেয়ে। দু’টো মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে ক্লাস টুয়েল্ভ-এ ও ছোট মেয়ে ক্লাশ সেভেনে লেখাপড়া করে। পড়াশুনায় তার মেয়েরা মেধাবী বলে সুনাম রয়েছে। গাড়ি ভাড়ায় চালিয়ে তাদের সংসার মোটামুটি চলে। না খেয়ে না পরে থাকতে হয়নি তার পরিবারের সদস্যদের।
মদোইদিপ এলাকার সুমতি প্রভাত চাকমা জানান, বড় পরং-এর সময় তিনি বয়সে ছোট ছিলেন। তবে অনেক ঘটনা তার স্মরণে আছে। তার চার ছেলেমেয়ে। এক ছেলে বিএ পাশ করেছেন। বাকি ছেলেমেয়েরা একজন ক্লাস নাইন, একজন সেভেন ও আরেকজন ক্লাস টুয়েলভে পড়াশুনা করেছেন। তিনি জানান, পুনর্বাসনের পর পরই ভারত সরকার ১নং থেকে ৬নং এলাকার জন্য ৬টি স্কুল স্থাপন করে দিয়েছিল। তিনি আরো জানান, বড় পরং-এর সময় মিজোরামের প্রায় ২৫টি ট্রানজিট ক্যাম্পে সাময়িক রেখে চাকমাদেরকে অরুণাচলে নিয়ে আসা হয়েছিল। তার বাবা সেই ক্যাম্পগুলোর নাম একে একে লিখে রেখেছিলেন, যা বর্তমানে একটি ঐতিহাসিক তথ্য হিসেবে বিবেচিত।
ডায়ুনের ধুমপাথারের কালাসোনা চাকমা ‘আশা’ নামক একটি এনজিওকে কাজ করেন। তার অধীনে এ প্রকল্পের কর্মএলাকায় প্রায় ৫০০ পরিবার রয়েছে। এ প্রকল্পের অধীনে তাকে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত জরিপ চালাতে হয়। স্বাস্থ্য সচেতনতা, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, প্রাথমিক চিকিৎসার ঔষধপত্র প্রদান ইত্যাদি সেবা দেয়া হয় এই প্রকল্পের অধীনে। তিনি জানান, এক সময় তাদের বসতি ছিল ডিহিং নদীর পাড়ে। কিন্তু ডিহিং নদীর প্রবল স্রোতে তাদের বাড়িসহ অনেকের বসতি নদীর গর্ভে তলিয়ে গিয়েছিল। তাই তাদের নতুন জায়গায় বসতি করতে হয়েছিল। বর্তমানে তাদের বসতভিটায় সুপারী বাগান রয়েছে। সুপারী গাছে গুলমরিচও চাষ করেন তারা। সুপারী বাগান থেকে বছরে প্রায় এক লক্ষ টাকা আয় করে থাকেন। তাদের চার মেয়ের মধ্যে দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। আর দুই মেয়ে পড়াশুনা করছেন।
ডায়ুনের অভয়পুরের অধিবাসী গগণ চন্দ্র চাকমা ওরফে ঘাঙারা সিআরপি’তে চাকরি করেন। সিআরপি’তে তিনি একজন পদস্থ কর্মকর্তা। বড় পরং-এর সময় তার বয়স ছিল ৭ বছর। বড় পরং-এর পর ভারত সরকার কর্তৃক স্থাপিত স্কুলে পড়াশুনা করেছেন তিনি অহমিয়া মিডিয়ামে। বড় পরং-এর গোড়াতেই যখন চাকমাদেরকে তফসিলী জনজাতি ও স্থায়ী বাসিন্দার সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছিল, সেসব সার্টিফিকেট দিয়ে তিনি সিআরপি’তে চাকরি লাভ করেছেন। আরো অনেকে আছেন সেরকম সার্টিফিকেট দিয়ে আধা-সামরিক বাহিনীসহ বিভিন্ন সরকারি অফিসে চাকরি লাভ করেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে অরুণাচলের রাজ্য সরকার সেসব সার্টিফিকেট বন্ধ করে দেয়ায় শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও চাকমা যুবক-যুবতীরা চাকরি পাচ্ছেন না।
এম-পেনের ৬ মাইল এলাকায় ক্ষেতি ও দোকানী দম্পতি হৃদ্ধিময় চাকমা ও জয়মতি চাকমা। দুইজনই খুব পরিশ্রমী। মেইন রাস্তার ধারে তাদের একটি গ্রোসারী দোকান রয়েছে। রয়েছে সুপারী, বড়ই বাগান। ২,০০০টি সুপারী গাছ রোপন করেছেন তারা। প্রায় ৭ কুরো বা ২৫ কানির মতো জায়গা রয়েছে। ডিহিং নদীর পাড়ে ধানী জমিও রয়েছে তাদের। তাদের এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে টুয়েলভ পাশ করার পর আইটি শিখেছেন। মেয়ে টুয়েল্ভ-এ পড়ছেন। মেয়েকে বিদেশে পাঠানোর ইচ্ছে আছে তাদের।
এম-পেনের ৬ মাইল এলাকায় ঠান্ডামুনি চাকমার একটি গ্রোসারী দোকান রয়েছে। সরকার থেকে কোনো ধরনের উন্নয়ন সুযোগ-সুবিধা পান না বলে তিনি দু:খ প্রকাশ করেন। তবে তার সুপারী, আম, লেবু, মাল্টা বাগান রয়েছে। আরো রয়েছে ধান্য জমি। তিনি বলেছেন এম-পেন এলাকায় একজন সিংফো নারীর সাথে জমি নিয়ে বিরোধ চলছে। সেই বিরোধপূর্ণ জমিতে বড় পরং-এর সময় থেকে প্রায় ১০০-এর অধিক চাকমা পরিবার বসবাস করে। ১৫/১৬ আগে হঠাৎ করে টইয়েন নামে উক্ত সিংফো নারী সেই জমির মালিকানা দাবি করেন। তিনি আরো জানান, উক্ত বিরোধপূর্ণ জায়গাটির জন্য একসময় চাকমা ও সিংপো জনগোষ্ঠীর মধ্যে মারামারি, গোলাগুলি ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনাও সংঘটিত হয়েছিল। সেই থেকে গৌহাটি হাই কোর্টে দুই পক্ষের মধ্যে আইনী লড়াই চলছে। তবে এখনো পর্যন্ত মামলাটি তাদের পক্ষে রয়েছে। প্রায় প্রতি মাসে ওকিলের জন্য তাদের অর্থ ব্যয় করতে হয়। তবে তিনি জানান, টইয়েন সিংফোর শ্বাশুড় পিচিলা সিংফো হচ্ছেন একজন সজ্জন মানুষ। তিনি চাকমাদের সাথে মিলেমিশে থাকার পক্ষে বলে ঠান্ডামুনি চাকমা জানান।
ডায়ুন বাজারের অধিবাসী জীতেন চাকমা ও পূর্ণিমা চাকমার দম্পতি। পূর্ণিমা চাকমার বাপের বাড়ি ত্রিপুরায়। তার বিয়ে হয় ডায়ুনের অধিবাসী জীতেন চাকমার সাথে। পূর্ণিমা চাকমা ইন্ডাষ্ট্রিয়াল পুলিশে চাকরি করে। তার এয়ারপোর্টেও পোষ্টিং ছিল। পদস্থ কর্মকর্তা। তারা অনেকটা চাকরিজীবী পরিবার। ডায়ুন বাজার সংলগ্ন এলাকায় তাদের রয়েছে একতলা পাকা বাড়ি। অরুণাচলের চাকমাদের সাথে ত্রিপুরা, মিজোরাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমাদের বিয়েশাদী হচ্ছে। বিয়েশাদীর মধ্য দিয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমাদের সাথে অরুণাচলের চাকমাদের ঐক্য-সংহতি ও বন্ধন ধরে রাখা হচ্ছে। কেবল অন্য অঞ্চলের চাকমাদের সাথে অরুণাচলের চাকমাদের বিয়ে হচ্ছে তা নয়, অরুণাচলের স্থানীয় আদিবাসী খামতি, নিশি, মিশমি, সিংফো, নকতে জনগোষ্ঠীর সাথেও কখনো সখনো বিয়ে হচ্ছে না তা কিন্তু নয়।
চাংলাং জেলার ৩নং বিজয়পুর এলাকার দম্পতি শোভা রঞ্জন চাকমা ও শোভাপ্রিয়া চাকমা। স্বামী ড্রাইভার ও ব্যবসায়ী। আর স্ত্রী গৃহিনী ও ক্ষেতি। তাদের দুই মেয়ে এক ছেলে। বড় মেয়ে ফ্রান্সে স্থায়ী হয়েছে। ছোট মেয়ে ব্যাঙ্গালোরে পড়ে। ছেলে বিকম পাশ করেছে। তাদের ১৫/১৬ বিঘা জমি রয়েছে। জমিতে সুপারী বাগান করেছে। শোভা রঞ্জন চাকমা জানান, অরুণাচলে স্থানীয় আদিবাসী ছেলেমেয়েরা মাদকাসক্তিতে আক্রান্ত। চাকমা ছেলেমেয়েরাও তা থেকে মুক্ত নয়। চাকমা ছেলেমেয়েদের মধ্যে ব্যাপকভাবে মাদকাসক্তি ছড়িয়ে পড়ছে। এতে করে যুব সমাজের নৈতিক অবক্ষয় ঘটছে। তবে তিনি জানান, বিজয়পুরের ইয়থ এসোসিয়েশন মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার রয়েছে। তাদের প্রচেষ্টায় বিজয়পুরে মাদকের প্রভাব অনেক কমে এসেছে। এক্ষেত্রে ইয়থ এসোসিয়েশন স্থানীয় প্রশাসনের সাথে একযোগে কাজ করছে। কেউ মাদকাসক্তিতে আক্রান্ত হওয়ার খবর পেলে তাকে ধরে সংশোধনাগারে নিয়ে রাখা হয় তিন মাস ব্যাপী। নৈতিক শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে সেখানে তাদেরকে সংশোধন করা হয়। তিন মাসের পর মুচালিকা নিয়ে মাদকমুক্ত ছেলেমেয়েদেরকে অভিভাবকের নিকট সোপর্দ করা হয়। এভাবেই বিজয়পুর এলাকায় মাদকাসক্তি অনেক কমে এসেছে বলে জানান শোভা রঞ্জন চাকমা।
অরুণাচল চাকমাদের মধ্যে ধর্মীয় প্রভাব যথেষ্ট লক্ষ্যনীয়। বনবিহার ও পার্বত্য বিহার রয়েছে। রাজ বনবিহারেরও স্বতন্ত্র শাখা বিহার স্থাপিত হয়েছে ৩নং বিজয়পুরে। ধর্মীয় প্রভাবের কারণে ঘর ঘরে হাঁস-মুরগী পালন নেই বললেই চলে। তবে ঘরের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ বেশ পরিচ্ছন্ন ও সাজানো-গোছানো পরিবেশ। ধর্মীয় প্রভাবে হাঁস-মুরগী পালন না থাকলেও মদের প্রভাব কমেছে বলে তেমন মনে হয়নি। সাধারণ মানুষের মধ্যে মদ খাওয়ার অংশ যথেষ্ট বলে প্রতীয়মান হয়। তবে আদিবাসী সমাজের চিরায়ত আচার-ব্যবহার, সরল শিষ্টাচার, মনখোলা আপ্যায়নের সংস্কৃতি অরুণাচলের চাকমাদের মধ্যে এখনো অটুট রয়েছে। পারিপার্শ্বিক পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও সুস্থ স্যানিটেশনের ক্ষেত্রে শিক্ষিত চাকমা যুবক-যুবতীদের ভারতের বিভিন্ন শহরে, বিশেষ করে দিল্লীর নয়ডা, কনাটর্কের ব্যাঙ্গালোরে চাকরির খোঁজে গমন ও শহুরে পরিপাটি জীবনের পরিবেশও ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে বিবেচনা করা যায়। যারা মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক কিংবা স্নাতক পাশ করছেন, জন্মসনদ, পিআরসি ও তফসিলী সার্টিফিকেট না থাকায় সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ফলে তারা নয়ডা বা ব্যাঙ্গালোরের শিল্প এলাকায় কাজের খোঁজে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
তবে এটা অনস্বীকার্য যে, নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকারের রাজনৈতিক অধিকারের বঞ্চনার মধ্যে থাকলেও তারা আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে তাদের অনেক স্বাধীনতা রয়েছে। এক্ষেত্রে স্মর্তব্য যে, চাকমা অধ্যুষিত এলাকা বা গ্রামগুলো অনেকটা কম্পেক এরিয়া। স্থানীয় আদিবাসীদের মিশ্র ও লাগোয়া তেমন এলাকা নেই বললেই চলে। চাকমা অধ্যুষিত এলাকাগুলোর ভৌগলিকগতভাবে এই স্বতন্ত্র অবস্থান চাকমাদের আর্থ-সামাজিক স্বাধীন জীবনযাত্রা ও জীবিকার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে বলে বলা যেতে পারে। বস্তুত অরুণাচলের অধিকাংশ চাকমাদের মধ্যে ন্যূনতম নিম্ন বিত্ত পরিবারের সঙ্গতি রয়েছে। না খেয়ে না পরে কিংবা দিনে এনে দিনে খাওয়ার মতো বিত্তহীন পরিবার নেই বললেই চলে।
সামাজিক ক্ষেত্রে চাকমাদের প্রথা ও রীতি মোতাবেক প্রতিটি গ্রামে গাঁওবুড়ো রয়েছে। সামাজিক ও পারিবারিক বিরোধ এই গাঁওবুড়োর নেতৃত্বে গ্রামের মুরুব্বীদের মাধ্যমে সমাধান হয়ে থাকে। তবে সামাজিক সংগঠনের অস্তিত্ব তেমন চোখে পড়েনি। গ্রামে গ্রামে যুব সংগঠনও তেমন গড়ে উঠেনি। ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে নিজস্ব পোষাক-পরিচ্ছদের ব্যবহার নারীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে দেখা গেছে। সাংস্কৃতিক সংগঠনের অভাব বেশ লক্ষ্যনীয়। ভারতের ত্রিপুরা কিংবা মিজোরামে যেভাবে সাংস্কৃতিক চর্চা লক্ষ্য করা যায়, অরুণাচলে সেই ধারা তেমন লক্ষ্য করা যায় না। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সচেতনতা যেভাবে দেখা গেছে, সে তুলনায় অরুণাচলের চাকমাদের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে তা অনেকাংশে বলা যেতে পারে। সাংস্কৃতিক চর্চা ও জোয়ার আনায়নে তাদেরকে অধিকতর মনোনিবেশ করার প্রয়োজনীয় রয়েছে। তবে একটা কথা নি:সন্দেহে বলা যায় যে, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সচেতনতায় অরুণাচলের চাকমারা ভারতের মিজোরাম কিংবা ত্রিপুরা, এমনকি পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমাদের চেয়েও দ্রুত অগ্রগতি লাভ করছে। তাদের উপর চলমান রাজনৈতিক বঞ্চনা ও চাপই তাদেরকে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধিতে জোরালো ভূমিকা রাখছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।