১০ই নভেম্বর ‘৮৩’র মাহাত্ম্য

ধীর কুমার চাকমা

দেখতে দেখতে মহান নেতা মাননেন্দ্র নারয়ণ লারমার (এম এন লারমা) ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী দ্বারপ্রান্তে। আর আমাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন পদার্পণ করলো ৫১ বছরে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম জাতির জন্য এই ৫১টি বছর অনেক সময়। এই রকম একটা আন্দোলন চালিয়ে যাবার বেলায় পার্টির সাথে থাকার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্মদের প্রাণঢালা অভিনন্দন। ’৪৭ সালের ব্রিটিশ-ভারত বিভক্তির সময় থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম জনগণ বিভিন্ন আমলের শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা শাসিত হয়ে আসছিল। তাই তাদের জন্য স্বায়ত্বশাসন দাবী ছিল অনস্বীকার্য। কিন্তু যুগ যুগ ধরে এই দাবী আদায়ের সংগ্রাম করার জন্য যুগোপযোগী একটা রাজনৈতিক সংগঠনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল ভারত বিভক্তির সময় থেকে। চার দফা দাবী সম্বলিত আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের দাবী নিয়ে শুরু হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে জুম্ম জনগণের আন্দোলনের পথ চলা। আকন্ঠ সামন্ত চিন্তা-চেতনায় জর্জরিত পার্বত্য চট্টগ্রামের সমাজব্যবস্থা থেকে সঠিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে উঠার জন্য অনেকদিন জুম্ম জাতিকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ইত্যবসরে ঘরে-বাইরে নানাভাবে এই জাতিকে অসহনীয় দুঃখ-কষ্ট নিপীড়ন নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল। যুগ যুগ ধরে নিপীড়ন নির্যাতনের ফলে প্রয়াত নেতা এম এন লারমার নেতৃত্বে আমাদের মহান পার্টি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পতাকাতলে চির অবহেলিত জুম্ম জনগণ সামিল হয়েছিল।

সমাজ-সভ্যতার বিকাশের নিয়মানুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম সমাজব্যবস্থা সামন্ত-পেতিবুর্জোয়া চিন্তাধারায় পরিপুষ্ট। এ চিন্তাধারা জুম্ম জাতির বিপ্লবীদের কাছে নানা রূপে নানা ধঙে হাজির হয়ে পথরোধ করে থাকে বার বার। ১৯৮৩ সাল ছিল তারই একটা মূর্তরূপ। ১০ই নভেম্বর ১৯৮৩ সালে আমাদের প্রিয় মহান নেতা এম এন লারমাকে হারানোর পর থেকে এই চিন্তাধারা আমাদের আন্দোলনের উপর আঘাত হেনেছে; মুক্তিকামী জুম্ম জনগণকে সাথে নিয়ে পার্টি এই প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা-চেতনাতাকে প্রতিহত করে আজকে এতদূর অগ্রসর হয়েছে। ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদনের পর ১৯৮৩ সালের ১০ই নভেম্বরে পরাজিত বিভেদপন্থা আবারো নতুন কায়দার পুনর্জীবিত হয়ে উঠে। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল এবং পশ্চাৎপদ দৃষ্টিভঙ্গী ৫০টি বছরে রাজনৈতিকভাবে পোড় খাওয়া জুম্ম জনগণের চোখকে কখনো ফাঁকি দিতে পারেনি। প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতিকে আদিবাসী জুম্ম জনতা বরাবরই প্রত্যাখ্যান করেছে। যেমনি করেছে ১৯৮৩ সালে। সেদিন দেশপ্রেমিক জুম্ম জনগণ একই রান্না একদিকে বিভেদপন্থী, অন্যদিকে পার্টি কর্মীদেরকে খাইয়েছে। আর উভয় গ্রুপের লোকজনকে সরকারী বাহিনীর আক্রমন থেকে নিরাপদ অবস্থানে রেখেছে। শেষে ১৩৩ জনের একটি গ্রুপ নিয়ে বিভেদপন্থীরা সরকারের কাছে নিঃশর্তভাবে পার্টির সম্পত্তি জমা দেয়। আর এই অস্ত্র জমাদান করার মাধ্যমেই তারা নিজেদের পরিচয় দিয়েছে। অনাগত দিনেও পার্টির বিপদগামীরা এই পরিচিতির পুনরাবির্ভাব ঘটাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। ইতিমধ্যেই সেই করুণ পরিণতির কথা প্রমাণিত হয়ে গেছে যা আঙ্গুল দেখিয়ে বলতে হয় না। জুম্ম জনগণ কিছুক্ষণের জন্য প্রতিক্রিয়াশীলদের কাছে জিম্মি হয়ে থাকলেও চূড়ান্ত বিজয় জুম্ম জনগণের পক্ষে তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।

১৯১৪ সালে সমস্তু ইউরোপ জুড়ে বিশ্বযুদ্ধ বাধার জন্য শক্তিশালী কিন্তু ঔপনিবেশহীন দেশগুলো নানা ছলনার আশ্রয় নেয়। যেমন একটা অছিলা হচ্ছে, অষ্ট্রিয়ার যুবরাজ ফার্দিন্যান্ড সার্ভিয়ার রাজপথে মারা যায়। অষ্ট্রীয়া এই ঘটনার জন্য সার্ভিয়াকে দায়ী করে। কিন্তু সার্ভিয়া এই অভিযোগ অস্বীকার করে। এইভাবেই যুদ্ধের সূত্রপাত বলে আমরা ইতিহাসে পড়েছি। পার্বত্য চট্টগ্রামের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের আন্দোলনও বিভিন্ন চড়াই-উতরায় পেড়িয়ে আজোবধি অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলছে; সকল প্রকার বাধা পদদলিত করে। যদিওবা সরকারের স্বার্থান্বেষেী মহল নানাভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান পরিস্থিতিকে ভুল বা অপব্যাখ্যা দিয়ে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে ব্যাখ্যা দেয়। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের ২৬ বছরেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন না করে বিপরীতে জুম্ম স্বার্থপরিপন্থী এবং চুক্তিবিরোধী নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে চুক্তি সম্পাদনকারী শাসকগোষ্ঠী। আশ্রয় নিয়েছে নানারকম প্রতারণার। আজকে যে জুম্ম জনগণ তাদের নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের একমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পতাকাতলে সমবেত হয়ে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করে যাচ্ছে তাদেরকে নানারকমভাবে হয়রানী করা হচ্ছে। তাই মহান নেতার ৪০তম মৃত্যু বার্ষিকীতে আন্দোলনের নতুন নেতৃত্বকে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে হচ্ছে। ভাবতে হচ্ছে অধিকতর বৃহত্তর আন্দোলনকে জয়যুক্ত করার জন্য নিত্য নূতন কায়দায় আন্দোলন সংগ্রামকে জুম্ম জনগণের বাঁচার সংগ্রাম হিসেবে জুম্ম জনগণের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দেয়া।

অতীতে ১৯৮৩ সালের বিভেদপন্থীরা সে কাজটা করেনি। বরং বিপরীতে যাঁর নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলন বেগবান হবার পরিবেশ তৈরী হয়েছে; সেই নেতা এম এন লারমাকে নিষ্ঠুরভাবে খুন করতে তাঁদের হাত কাঁপেনি। সেই থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্দোলনের ইতিহাসের কলঙ্ক তিলক মীরজাফরের শব্দটা যোগ হয়েছে। তাই এই মীরজাফর শব্দটার বিলুপ্তি ঘটানোর জন্য নতুনভাবে প্রগতিশীল চিন্তাধারায় সজ্জিত ঝাঁক ঝাঁক তরুণ সত্য ন্যায়ের ধ্বজা ধরে এগিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। ষাট দশকের ছাত্র-যুব সমাজ মহান নেতা এম এন লারমার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৯৯৭ সালে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদন পর্যন্ত আন্দোলনে শামিল ছিল এবং আছে। ১৯৮৯ সালে সেটেলার দ্বারা সংঘটিত লংগদুর নৃশংস জুম্ম হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে পিসিপি জন্মলাভ করে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত পার্টির ঝাঁক ঝাঁক তরুণ ঝাঁপিয়ে পড়বে বৃহত্তর আন্দোলনে।

আন্দোলনের ইতিহাস প্রসঙ্গে কিছু না বললে নয়। আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের আন্দোলনে উত্তরাঞ্চলে বিশেষ সেক্টর এলাকায় ১নং সেক্টর থেকে দেবেন (দেবজ্যোতি চাকমা) এসে পার্টি বিরোধী কার্যকলাপ শুরু করেছিল। তখন কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণাধীন সকল অস্ত্রশস্ত্র-গোলা বারুদ (অস্ত্রাগার) ত্রিভঙ্গিল দেওয়ানকে (পলাশকে) সংরক্ষণের দায়িত্ব দিয়েছিলেন প্রয়াত নেতা এম এন লারমা। উত্তরাঞ্চল থেকে দক্ষিণাঞ্চলে আমাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালিত হতো। আমাদের দেশের সর্বত্র যখন ত্রিশক্তির সমন্বয়করণ কার্যক্রম চলছিল, তখন বিশেষ সেক্টর কম্যান্ডার, ত্রিভঙ্গিল দেওয়ান (পলাশ) কেন্দ্রের বিরুদ্ধাচরণ শুরু করে। গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্র বিশেষ সেক্টর এলাকায় তাদের ষড়যন্ত্র ঘনিভূত করে তুলছিল। এমতাবস্থায় পার্টির কেন্দ্রীয় অস্ত্রাগারের জিনিষ-পত্র বিতরণ জরুরী প্রয়োজন হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তৎসময়ে বিশেষ সেক্টরের কর্মীদের উপর অস্ত্রাগার নিয়ন্ত্রণের ভার ছেড়ে দিয়ে নির্বিকার হয়ে ডুব দিয়ে রইল ত্রিভঙ্গিল (পলাশ)। পার্টির জরুরী প্রয়োজনে সেসব সামরিক সরঞ্জামাদি খূঁজে বের করা ছাড়া বিকল্প কোন পথ রইল না। কাজেই ষাট-সত্তর দশক থেকে যার অনুপ্রেরণায় এক ঝাঁক ছাত্র-যুব সমাজ জুম্ম জাতীয় অস্তিত্ব এবং জন্মভূমির অস্তিত্ব সংরক্ষণের জন্য আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল; সেই মহান নেতা এম এন লারমাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখানোর হিম্মত মানে নবীন প্রজন্মকে অবমাননা করা এবং আন্দোলনকে কুঠারাঘাত করার সামিল। বিশেষ সেক্টর শান্তিপূর্ণভাবে আস্ত্রাগার কেন্দ্রকে হস্তান্তরের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। তখন বল প্রয়োগ ছাড়া কেন্দ্রের কাছে বিকল্প কোন পথ রইল না। এমনি একটা পরিস্থিতিতে পরিচালনা করতে হয়েছিল ১৪ জুন ১৯৮৩ সালে পার্টির কেন্দ্রীয় অস্ত্রাগার বিভেদপন্থীদের দখলমুক্ত করার অভিযান। তার পরবর্তী সময়ে বিভেদপন্থীদের দ্বারা সংঘটিত হলো ১০ই নভেম্বর ১৯৮৩, বৃহষ্পতিবার এম এন লারমার উপর অতর্কিত এবং বিশ্বাসঘাতকতামূলক হামলা। আজকে এই দিনে ১০ই নভেম্বরর‘৮৩ যাতে পুনরাবির্ভাব না ঘটে সেটাই হবে সবার কাম্য।

More From Author