হিল ভয়েস, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বান্দরবান: পার্বত্য চট্টগ্রামে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ও বসতি বন্ধ রাখার জন্য বান্দরবানে রোহিঙ্গ্যা ক্যাম্প স্থাপন না করার সরকারের পূর্বের ঘোষণা লংঘন করে সম্প্রতি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে একটি প্রত্যাবাসন শিবির ও সাময়িক বিশ্রামশিবির (ট্রানজিট ক্যাম্প) নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্তের কথা জানা না গেলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পূর্ব প্রস্তুতির কথা বলে এইসব শিবির নির্মাণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি) কর্মকর্তারা।
আরআরআরসির দপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হলে রাখাইনের মংডু জেলার উত্তর-পশ্চিম এলাকার বাসিন্দাদের ওই পথে স্বদেশে ফেরত পাঠানো হবে। আগেভাগে প্রস্তুতি হিসেবে দুটি অস্থায়ী শিবির নির্মাণ করে রাখা হচ্ছে।
নাইক্ষ্যংছড়িতে ওই দুটি শিবির নির্মাণের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে ইতিমধ্যে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে জানান শরণার্থী সেলের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব শামীম রহমান। এই নির্মাণকাজের সবটাই কক্সবাজারের শরণার্থী, ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশন তদারক করছে বলে জানা গেছে।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রোমেন শর্মা এ বিষয়ে বলেন, নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নে সাময়িক বিশ্রাম ও প্রত্যাবাসনশিবিরের জন্য আরআরআরসি থেকে সাড়ে তিন একর জায়গা চাওয়া হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর সময় সাময়িক অবস্থানের জন্য ঘুমধুমে ২০ শতাংশ জমির ওপর সাময়িক বিশ্রামশিবির করা হবে। সীমান্তসংলগ্ন তুমব্রুতে ৩ দশমিক ২০ একর জমিতে প্রত্যাবাসনশিবির হবে।
এদিকে নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকায় রোহিঙ্গাদের জন্য প্রত্যাবাসন ও বিশ্রাম শিবির নির্মাণের খবরে স্থানীয় জনগণের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা গেছে। গ্রামবাসীদের মতে, যেহেতু সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের নাজুক পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে শুরু থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ও বসতির উপর নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, সেই জায়গায় এখন তাদের জন্য প্রত্যাবাসন ও আশ্রয় শিবির নির্মাণ করলে তাতে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ বৃদ্ধি পারে। এমনিতে তারা প্রতিনিয়ত অনুপ্রবেশ ও বসতির চেষ্টা করছে।
ইতিমধ্যে নাইক্ষ্যংছড়িতে ১৯৭৮ সাল থেকে রোহিঙ্গ্যা বসতি স্থাপন হয়ে আসছে। ফলে নাইক্ষ্যংছড়ির কিছু ইউনিয়নে বসতিকারী রোহিঙ্গ্যারাই জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। এছাড়া ইতিমধ্যে কেবল বান্দরবান জেলায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গ্যা বসতি স্থাপন করেছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। এমনকি রোহিঙ্গ্যারা নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত অঞ্চলে মাদক দ্রব্য, অস্ত্র, স্বর্ণ, গরু ইত্যাদি পাচারের সাথে জড়িত হয়ে এলাকার পরিস্থিতিকে অশান্ত করে তুলেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকার এক আদিবাসী অধিকারকর্মী বলেন, নানা অজুহাতে সরকারের একটি কায়েমি স্বার্থবাদী মহল রোহিঙ্গাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে অনুপ্রবেশ ও বসতির সুযোগ দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
উল্লেখ্য যে, গত ৮ অক্টোবর ২০১৭ বান্দরবানে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় বান্দরবানের পুলিশ সুপার সঞ্জিত কুমার রায় বলেন, একজন রোহিঙ্গাকেও পার্বত্য চট্টগ্রামে রাখা হবে না। এবিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্ত হয়েছে।
৬ ডিসেম্বর ২০১৭ পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কামাল উদ্দিন তালুকদার বলেন, তিন পার্বত্য জেলার নাজুক পরিবেশ ও আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকার সেখানে রোহিঙ্গা বসতি নির্মাণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
পরে ২০১৯ সালের শুরুতেও পার্বত্য মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় কোনো রোহিঙ্গা শরণার্থী থাকতে পারবে না বলে ঘোষণা দেন।
উল্লেখ্য, মিয়ানমারের রাখাইনে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট সহিংস ঘটনার পর পার্বত্য চট্টগ্রামের পার্শ্ববর্তী কক্সবাজার জেলায় ব্যাপক হারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অনুপ্রবেশ শুরু হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা ১১ লক্ষ ১৮ হাজার ৫৭৬ জন।
আরও উল্লেখ্য যে, সম্প্রতি লামার সরই ইউনিয়নে ৩০ রোহিঙ্গা পরিবারের বসতিস্থাপনের খবর পাওয়া গেছে। গত ৯ মে ২০২১ বান্দরবানে অনুপ্রবেশ কালে ৪৫ জন রোহিঙ্গাকে সেনাবাহিনী আটক করে।
ইতিপূর্বে রাঙ্গামাটির ৭টি উপজেলায় ১২০টি রোহিঙ্গা পরিবারের সন্ধান পাওয়া যায়। অপরদিকে খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ৫৬টি রোহিঙ্গা পরিবারের সন্ধান পাওয়ার খবর পাওয়া যায়।