হিল ভয়েস, ৮ এপ্রিল ২০২০, রাজশাহী: বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের আদিবাসী জাতিসমূহের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ‘জাতীয় আদিবাসী পরিষদ’ বিশ্বব্যাপী প্রাণঘাতী মহামারী করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) প্রতিরোধে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেশের রাজশাহী-রংপুরের আদিবাসীদের সুরক্ষা প্রদানের আহ্বান জানিয়েছে। ৮ এপ্রিল ২০২০ তারিখে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেনের স্বাক্ষরিত এক বার্তায় এই আহ্বান জানানো হয়।
সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের প্রতি জানানো উক্ত আহ্বানে বলা হয় যে, বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের কমপক্ষে ১৩টি জেলায় ৩৮টিরও অধিক জাতির প্রায় ১৫ লক্ষাধিক আদিবাসী যেমন: সাঁওতাল, উরাও, মুন্ডা, মাহাতো (বেদিয়া/কুড়মি), মালো, মাহালে, মুষহর, কড়া, কোড়া, কোল, ভিল, ভুঁইমালি, বাগদী, তুরি, গঞ্জু, গড়াইত, তেলি, কোচ, কন্দ, রাজোয়াড়, রবিদাস, লোহার, শবর, হো ইত্যাদি জাতিসত্তার বসবাস।
শিক্ষা দীক্ষায় অনগ্রসর এইসব জাতিদের ৯০ শতাংশই আজ ভূমিহীন। আদিবাসীদের বেশির ভাগেরই বাস অজ পাড়াগাঁয়ে। ফলে আধুনিকতার ছোঁয়া থেকে তারা অনেকদূরে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় অনভ্যস্থ আদিবাসীরা তাই বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসের ব্যাপকতা সম্পর্কে এখনো তেমন জ্ঞাত নন।
আরো বলা হয় যে, উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীরা এমনিতেই নীরব নির্যাতন, অবহেলা ও শোষণের বেড়াজালে আবদ্ধ। ভূ-সন্ত্রাস বা জমি জালিয়াতির কারণে তাদের জীবন আজ বিপন্ন। ভূমিহীন দিনমজুর পরিবারে বেশির ভাগ সদস্যই আজ অপুষ্টির শিকার। তাছাড়া বিভিন্ন আদিবাসী এলাকায় এখনো সুপেয় খাবার পানি ও স্বাস্থ্য সম্মত টয়লেটের ঘাটতি রয়েছে। প্রয়োজনীয় ডাক্তারি পরামর্শ ও সেবা থেকেও তারা বঞ্চিত।
ফলে তারা সহজেই বিভিন্ন ধরনের রোগ-জীবানুর সংক্রমণে অসুস্থ হয়ে পড়ে। বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসের প্রার্দুভাব তাই খুব সহজেই তাদের জীবন কেড়ে নিতে পারে। জাতীয় আদিবাসী পরিষদ লক্ষ্য করেছে যে, ইতোমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় হাম ও জল বসন্তের প্রকোপ বেড়েছে কিন্তু প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিতে ব্যর্থ হয়েছে সরকারি প্রশাসন।
উক্ত আহ্বানে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ দাবি জানায় যে, আদিবাসী শিশু, মহিলা, বয়োবৃদ্ধ বা প্রবীন ব্যাক্তিগণ যদি বর্তমান পরিস্থিতিতে অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অহেতুক ভয় না পেয়ে যাতে যথাযথ সেবা ও ঔষধ প্রদান করেন। আদিবাসী অসুস্থ শিশু বা বয়ো বৃদ্ধদের বাংলা ভাষা বোঝার ক্ষেত্রে সমস্যা থাকলে তাদের প্রতি অধিক যতœবান হওয়ার অনুরোধ করেছে এই সংগঠন। ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা অনুষদের ২২তম ব্যাচের আদিবাসী ছাত্র সুমন চাকমার বিনা চিকিৎসায় মারা যাবার পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে তা স্মরণ করে দেন উত্তর বঙ্গের প্রতিনিধিত্বকারী আদিবাসীদের এই সংগঠন।
আহ্বানে আরো বলা হয় যে, ইতোমধ্যে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকার (দ্যা ডেইলি স্টার ও সমকাল) প্রতিবেদনে, ‘গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্মের অর্ন্তগত তিনটি গ্রামের: কুয়ামারা, মাদারপুর, জয়পুরের ত্রাণ সহায়তা বঞ্চিত ১২০০ সাঁওতাল পরিবারের’ কথা উঠে এসেছে। কিন্তু সারা উত্তরবঙ্গের দিন মজুর, দু:স্থ ও গরীব আদিবাসীদের অবস্থা একই রকম।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের জেলা কমিটির প্রদেয় তথ্য মতে, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, দিনাজপুর, রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, সাতক্ষীরা, নড়াইল ও রাজশাহীর সব জায়গায় আদিবাসী গরীব ও খেটে-খাওয়া মানুষেরা প্রয়োজনের অনুপাতে পায়নি রাষ্ট্রীয় ত্রাণ ও সহযোগিতা। জাতীয় আদিবাসী পরিষদ সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের প্রতি উত্তরবঙ্গের দিনমজুর, গরীব ও আদিবাসীদের সংকট মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসার জোর আহ্বান জানায়।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদ উত্তরাঞ্চলের আদিবাসী জনগণকে আহ্বান জানায়, “আপনারা সাবধান থাকুন, অহেতুক ভয় পাবেন না। মহামারী করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সরকারি নিষেধাজ্ঞা মেনে চলুন এবং প্রশাসনকে সহযোগিতা করুন। আজ সারা বিশ্বের সংকটময় পরিস্থিতিতে নিজেদের সমস্যা মোকাবেলায় ঐতিহ্যগত-আদিবাসী জ্ঞান ব্যবহার করুন। সেই সাথে প্রয়োজনীয় মাস্ক, হ্যান্ড-সেনিটাইজার, জীবানু-নাশক-স্প্রে ইত্যাদি প্রতিনিয়ত ব্যবহার করুন।”
করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারীর এ চরম দূর্ভোগের সময় উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবেলায় ও আদিবাসী জনপদের সুরক্ষায় প্রয়েজনে আপনারা জাতীয় আদিবাসী পরিষদের জেলা শাখাগুলোর নেতৃবৃন্দদের সাথে যোগাযোগ করতে উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের প্রতি এবং স্ব স্ব এলাকার আদিবাসী জনগণের খোঁজ খবর নিতে ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা-পরামর্শ দিতে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের নেতৃবৃন্দদের প্রতি আহ্বান জানান জাতীয় আদিবাসী পরিষদ।