হিল ভয়েস, ১৪ আগস্ট ২০২৩, রাঙ্গামাটি: গতকাল ১৩ আগস্ট ২০২৩ রাঙ্গামাটিতে চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পার্বত্য চট্টগ্রামের নারী নেত্রী কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। সর্বশেষ পুলিশ সুপার কর্তৃক আদালতে প্রদত্ত কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলার প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে মামলার বাদী ও কল্পনা চাকমার বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমার না রাজি আবেদনের প্রেক্ষিতে এই শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে।
শুনানিতে বাদীপক্ষ পুলিশের তদন্তে ত্রুটির অভিযোগ তোলেন এবং অধিকতর তদন্তের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানান। অপরদিকে তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তার পক্ষ মামলাটি বন্ধ করার আবেদন জানান। আদালতের অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট স্বর্ণ কমল সেন শুনানিতে উভয়পক্ষের বক্তব্য শুনলেও এইদিন কোনো আদেশ দেননি।
পরে যেকোনো সময় আদালত উক্ত শুনানির আদেশ দিতে পারে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শুনানিতে বাদীর পক্ষে উপস্থিত ছিলেন বাদীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট জুয়েল দেওয়ান ও অ্যাডভোকেট রাজীব চাকমা এবং মামলার বাদী ও কল্পনার বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা। অপরদিকে তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ সুপারের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আদালত পরিদর্শক মোঃ আজম ও পুলিশ উপ-পরিদর্শক গণেশ শীল।
শুনানি চলাকালে পুলিশ সুপারের প্রতিনিধি আদালত পরিদর্শক মোঃ আজম এবং পুলিশ উপ-পরিদর্শক গনেশ শীল পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনের স্বপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন এবং মামলাটি ক্লোজ করে দেয়ার আবেদন জানান বলে জানা যায়।
মামলার বাদী ও কল্পনা চাকমরার বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা বলেন, ১৯৯৬ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত মামলা চলে আসলেও রাষ্ট্রপক্ষ মামলার রায় এখনো দিচ্ছে না। পাশাপাশি মামলায় প্রকৃত দোষীদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। চুড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদনে আদালতের কাছে না রাজি দাবি আবেদন জানিয়ে অধিকতর তদন্তের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্তের আবেদন জানিয়েছি। তিনি এ মামলার দ্রুত একটি সুষ্ঠু বিচারের কামনা করেন।
অ্যাডভোকেট জুয়েল দেওয়ান বলেন, গত ২০১৬ সালের তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ সুপার যে চুড়ান্ত রিপোর্ট আদালতে দাখিল করেছেন তার বিরুদ্ধে আমরা না রাজির আবেদন জানিয়েছি। কারণ তদন্তে আদালতের যে নির্দেশনা ছিল তা যথাযথভাবে তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসেনি। সর্বশেষ যে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে সেটা আদালতের নির্দেশ মতে তদন্ত করা হয়নি। আদালত কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলায় যাদের নাম বাদী উল্লেখ করেছেন তাদের নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দিলেও তদন্তকারী কর্মকর্তা সেভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। যার প্রেক্ষিতে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে পুনরায় অধিকতর তদন্তের জন্য আবেদন করা হয়েছে। এ আবেদনের প্রেক্ষিতে রোববার এ শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে।
তিনি বলেন, বাদী ব্যতীত অন্য কোনো স্বাক্ষীর জবানবন্দী ফৌজদারি আইনের ১৬১ ধারায় লিপিবদ্ধ করা হয় নি। এছাড়াও এই মামলার তিনজন মূল অভিযুক্ত লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস, তৎকালীন ভিডিপি সদস্য নূরুল হক ও সালেহ আহমেদকে নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদের ব্যাপারে আদালতের পূর্বেকার যে আদেশ ছিল সেটাও অনুসরণ করা হয়নি।
অ্যাডভোকেট জুয়েল দেওয়ান আরও বলেন, কল্পনা চাকমা কার দ্বারা অপহৃত হয়েছেন তা উদঘাটনের দায়িত্ব পুলিশের। কিন্তু সেটা উদঘাটন করা সম্ভব হচ্ছে না। কাজেই কোনোটাই না করায় মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকারের লংঘন ও ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটেছে। তাই অপহরণ ঘটনার প্রকৃত তদন্ত ও সত্য উদঘাটন করে প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করে যথাযথ বিচার করা হোক।
উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন, মধ্যরাতে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমা রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাধীন বাঘাইছড়ি উপজেলার লাল্যাঘোনা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে নির্মমভাবে অপহরণের শিকার হন। অভিযোগ ওঠে কল্পনা চাকমার বাড়ির পার্শ্ববর্তী কজইছড়ি সেনাক্যাম্পের কমান্ডার লেঃ ফেরদৌসের নেতৃত্বে একদল ভিডিপি ও সেনা সদস্য কতৃর্ক অপহরণ করা হয়।
এ সময় অপহরণকারীরা কল্পনার দুই বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা ও লাল বিহারী চাকমাকেও বাড়ির বাইরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মেরে ফেলার চেষ্টা করে। কল্পনার দুই ভাই টর্চের আলোতে স্পষ্টতই অপহরণকারীদের মধ্য থেকে বাড়ির পাশ^র্বতী কজইছড়ি সেনাক্যাম্পের কমান্ডার লে: ফেরদৌস (মো: ফেরদৌস কায়ছার খান) এবং তার পাশে দাঁড়ানো ভিডিপি প্লাটুন কমান্ডার মো: নুরুল হক ও মো: সালেহ আহমদকে চিনতে পারেন বলে জানান।
ঘটনার পরদিন বাঘাইছড়ি থানায় এ ঘটনায় মামলা দায়ের করেন কল্পনার বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা। বাঘাইছড়ি থানার তৎকালীন ওসি শহিদউল্ল্যা নিজেই মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন। এরপর একে একে ৩৯ জন তদন্ত কর্মকর্তা বদল হন। পরে এটি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডিকে। সিআইডি ২০১০ সালের ২১ মে মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিলে, প্রতিবেদনে প্রকৃত অপরাধীদের এড়িয়ে যাওয়া হলে মামলার বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা সিআইডির প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে আদালতে নারাজি আবেদন দেন।
গত ১৯ অক্টোবর ২০১৬ সালে আদালত রাঙ্গামাটির পুলিশ সুপার সৈয়দ তারিকুল হাসানকে এ মামলার তদন্তভার দেন। তিনি দুই বছর পর ২০১৮ সালে কারও বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ না পাওয়ার কথা বলে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। এ প্রতিবেদনেও নারাজি দেন কল্পনার ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা।