বাচ্চু চাকমা
প্রথমে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সম্পর্কে সাধারণ থেকে বিশেষ আর বিশেষ থেকে সাধারণ উভয় দিক সম্যকভাবে ধারণা রাখা দরকার। যুগ যুগ ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম জাতিসমূহ অতীতের বহু শাসকগোষ্ঠীর অন্যায় শাসন-শোষণের শিকার হয়েছে। আজ পর্যন্ত কোনো শাসকই পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করে সমাধানের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা দেখায়নি। এ অঞ্চলের সমস্যা সমাধানের লক্ষে বাংলাদেশের যখন যে দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন তাদের সাথে প্রায় ২৬ বার দ্বিপাক্ষিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং রাজনৈতিক উপায়ে সমাধানের সূত্র ধরে স্থায়ী শান্তি আনয়নের লক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর পর্যন্ত উপনীত হওয়া সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশের সরকারি বাহিনীর সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী সংঘাত-সংঘর্ষ অবসান করে ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতার প্রতি পূর্ণ ও অবিচল আনুগত্য রেখে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সকল নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমুন্নত এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা এবং বাংলাদেশের সকল নাগরিকের স্ব স্ব অধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়নের লক্ষে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের লক্ষে প্রক্রিয়া শুরু হলেও চুক্তি অনুযায়ী সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষে সময়সূচি ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনাসহ রোডম্যাপও ঘোষণা করা হয়নি। বরঞ্চ, পার্বত্য চট্টগ্রামের মৌলিক সমস্যাসমূহ ইচ্ছে করে দীর্ঘ ২৫টি বছর ধরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। ফলে জুম্ম জনগণ এক সময় যে চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিল, সে বিপর্যয় থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী আদিবাসী জুম্ম জনগণের পাহাড়সম দুঃখ-কষ্টকে আজও মাথার উপর দিয়ে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। কোনো শাসকই পার্বত্য চট্টগ্রামের সহজ-সরল জুম্ম জনগণের দুঃখগুলোকে আপন করে নিতে পারেনি। পাহাড়ের চোখ দিয়ে পাহাড়ের সমস্যাকে গভীরভাবে অনুভব করতে পারেনি। যে শাসকগোষ্ঠী এযাবতকালে আমাদের দুঃখ-কষ্ট বুঝার চেষ্টা করেনি, তারা কী করে পাহাড়ের সমস্যা বুঝবার চেষ্টা করবেন? পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান সমস্যা শাসকগোষ্ঠীকে দুই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার পরেও তা সমাধানের লক্ষ্যে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা একটি রাজনৈতিক ও জাতীয় সমস্যা। কাজেই, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে রাজনৈতিক এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধান করতে শাসকগোষ্ঠীকে অবশ্যই রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও উদার মন-মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশ সরকারকে আরও বড় মনের পরিচয় দিতে হবে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাটি দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর আকার ধারণ করতে চলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের যতই দিন যাচ্ছে ততই কৃত্রিম উপায়ে একটি সমস্যা থেকে বহু সমস্যা সৃষ্টি করা হচ্ছে। একটি সমস্যা থেকে বহু সমস্যার ডাল-পালা, শাখা-প্রশাখা জন্ম দিয়ে সমাধানের সমস্ত রাস্তা অবরুদ্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে পাকিস্তান আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে সংকট তৈরি হয়েছিল, সেই সংকট নিরসনে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা নেই বললেই চলে। বরঞ্চ পাহাড়ের সমস্যাকে জটিল করার জন্য বহুমূখী ষড়যন্ত্র গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ সরকার নিজের উদ্যোগে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের যথাযথ কোনো চেষ্টাই করেনি। একদিকে জুম্ম জনগণের বলপ্রয়োগের মধ্য দিয়ে অভ্যন্তরীণভাবে প্রবল গণআন্দোলন, অপরদিকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চাপের মুখে এক সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে বাংলাদেশ সরকার আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়েছে। আলোচনার এক পর্যায়ে ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে সম্যকভাবে জানার জন্য অতীতের কিছু ইতিহাসের পটভূমিকে সামনে তুলে আনার প্রয়োজন মনে করি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধের বিনিময়ে পাকিস্তানের অংশ পূর্ব পাকিস্তানই বাংলাদেশ নামে আত্মপ্রকাশ করেছল। উত্তরাধিকার সূত্রে বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের কর্তৃত্ব পেয়ে যায় এবং এই কর্তৃত্ব পাবার সাথে সাথেই বাঙালি মুসলমান শাসকগোষ্ঠী পাকিস্তানের রেখে যাওয়া বশংবদ নীতির ভিত্তিতে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়। পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর মতো বাংলাদেশ সরকারও পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণকে জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের হীন ষড়যন্ত্রে মেঠে উঠে। পার্বত্য চট্টগ্রামে মুসলমান বাঙালি পরিবার পুনর্বাসনের মাধ্যমে জুম্মদের সংখ্যালঘু হতে সংখ্যালঘুতে পরিণত করার হীন চক্রান্ত, জুম্মদের গ্রাম ধ্বংসকরণ ও গুচ্ছগ্রাম গঠন, সামরিক অভিযানের মাধ্যমে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে এক বিভীষিকাময় অবস্থা বাংলাদেশ শাসকগোষ্ঠী সৃষ্টি করেছিল। এই সূত্র ধরে বাংলাদেশ শাসকগোষ্ঠী অমুসলমান অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলমান অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিণত করার দৃঢ় প্রয়াসী হয়ে এগিয়ে আসতে থাকে। জুম্ম জনগণ বাংলাদেশ শাসকগোষ্ঠীর হীন ষড়যন্ত্র থেকে মুক্তি পেতে চায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ চায় অধিকার প্রতিষ্ঠা আর বিপরীতে বাংলাদেশ শাসকগোষ্ঠী চায় জুম্ম জনগণের বিলুপ্তি। তাই বাংলাদেশ শাসকগোষ্ঠী ও জুম্ম জনগণের মধ্যে তীব্র সংঘাত গড়ে উঠবে তা স্বাভাবিক। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী যা চেয়েছিল করতে এবং করতে গিয়ে যা সমাপ্ত করতে পারেনি তা বাংলাদেশ শাসকগোষ্ঠী আজ পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে দিতে বদ্ধপরিকর বলে প্রমাণিত হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার মধ্যে অন্যতম সমস্যাসমূহ হচ্ছে সামরিকায়নের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন ও সম্প্রসারণ, জোরপূর্বক ভূমি বেদখলের মাধ্যমে ভূমি সমস্যা জিইয়ে রাখা, সমতল অঞ্চল থেকে বহিরাগত মুসলমান সেটেলার বাঙালি অনুপ্রবেশ, পার্বত্য চট্টগ্রামে ইসলামীকরণ জোরদার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসন ব্যবস্থা কার্যকর না হওয়া ইত্যাদি। উপরোক্ত সমস্যাসমূহ বাংলাদেশ শাসকগোষ্ঠী তার নিজের স্বার্থের কারণে ইচ্ছে করে এখনও জিইয়ে রেখেছে। আমরা জানি যে, সামরিক উপস্থিতির বিচারে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে বাংলাদেশের এক দশমাংশ জায়গা জুড়ে অবস্থিত আদিবাসী জুম্ম জাতিগোষ্ঠীর আবাসভূমি ও অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল হচ্ছে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে সামরিকায়িত অঞ্চল। বস্তুত বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে চলছে নির্দয়, নির্মম তথা নিষ্ঠুরতম সামরিক শাসন। অর্ধ-শতাব্দী ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে চালু রাখা হয়েছে এই নির্দয় সেনাশাসন! অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করতেই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই দেশের প্রতিটি ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক হারে সামরিক বাহিনী মোতায়েনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৩ সাল থেকে প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিকায়ন শুরু হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির বিরুদ্ধে ১৯৭৩ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের রুমা, আলিকদম ও দীঘিনালায় তিনটি সেনানিবাস তৈরি করা হয়েছিল। সেই সময়ে জুম্ম জনগণের প্রাণপ্রিয় নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এই সেনানিবাস স্থাপনের বিরুদ্ধে জাতীয় সংসদে জোরালো বক্তব্য রেখেছিলেন। তারপরও পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে সেনানিবাস স্থাপন ও সেনাক্যাম্প সম্প্রসারণ থেমে থাকেনি।
১৯৭৫ হতে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৬ বছর ধরে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সামরিক শাসনামল চলেছিল বাংলাদেশে। সেসময় পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিকায়নের কাজ অধিকতর জোরদার হয়ে উঠে। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ও জাতীয় সমস্যার মতো একটি সমস্যাকে সমাধান করার চেষ্টা করা হয়েছিল কেবলমাত্র সামরিক উপায়ে। ফলশ্রুতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের সাথে বাংলাদেশ শাসকগোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব ও সংঘাত তীব্র হয়ে উঠেছিল। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর সংখ্যা প্রচন্ডভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। ১৯৭৭ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে “অপারেশন দাবানল” জারি করে সামরিকীকরণের অধীনে পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে ১,১৫,০০০ সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছিল। যা পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতি ৬ জন জুম্ম জনগণের পেছনে ১ জন সেনা দায়িত্বরত থাকতেন। এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম স্বল্প সময়ের মধ্যে সামরিক বাহিনীর সেনা ছাউনিতে পরিণত হয়েছিল। ছোট্ট একটি অঞ্চলে স্থাপন করা হয় ৫০০ এর বেশি সেনাক্যাম্প। একই সাথে সমতল অঞ্চল থেকে হাজার হাজার বহিরাগত মুসলিম সেটেলার বাঙালি পরিবার বসতি প্রদানের মাধ্যমে জোরদার করা হয় ইসলামীকরণের প্রক্রিয়া। একে একে পার্বত্য চট্টগ্রামে শত শত, হাজারে হাজারে মসজিদ ও মাদ্রাসা ব্যাঙের ছাতার মতোই গজিয়ে ওঠে। জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনামলের পর ক্ষমতায় আসেন আরেক সামরিক শাসক জেনারেল হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ। সামরিকায়নের পাশাপাশি ইসলামিকরণ নীতি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে জেনারেল জিয়ার শাসনামলে ১৯৭৯ সাল হতে জেনারেল এরশাদের শাসনামলের ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত সরকারি অর্থায়নে সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্মদের জায়গা-জমির উপর চার লক্ষাধিক বহিরাগত মুসলমান বাঙালিকে বসতি প্রদান করা হয়। মুসলিম সেটেলারদের সেনাবাহিনী শুধুমাত্র মানবঢাল হিসেবে নয়, নিজেদের নিয়ন্ত্রণে ভূমিদখলে রাখার হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার করেছিল। ১৯৭৭ সালে ‘অপারেশন দাবানল’ ঘোষণা করে পার্বত্য চট্টগ্রামে এক প্রকার সামরিক শাসন প্রবর্তন করা হয়। আশি দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘোষণা করা হয় ‘উপদ্রুত এলাকা’ হিসেবে।
৮০ দশকে পাহাড় ছিল সেনাবাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ এক আতংকের জনপদ। জুম্মদের গ্রামে গ্রামে একের পর এক গণহত্যা ও সাম্প্রদায়িক হামলা চালিয়েছিল সেনাবাহিনী ও বহিরাগত সেটেলাররা যৌথভাবে। সেনাবাহিনীর ভয়ে জুম্ম জনগণ যখন পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল, তখন বহিরাগত মুসলিম সেটেলাররা জুম্মদের সম্পত্তি লুটপাট করার পরে ঘরবাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। আর যখন জুম্ম জনগণ একত্রিত হয়ে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছিল, তখন সেনা সদস্যরা গুলি করে জুম্মদের তাড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। এরই সুযোগে বহিরাগত মুসলিম সেটেলাররা বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে আদিবাসীদের উচ্ছেদের মাধ্যমে সর্বস্বান্ত করেছিল। পাহাড়ের বুকে সশস্ত্র আন্দোলন চলাকালে সেনাবাহিনী ও মুসলিম সেটেলারদের দ্বারা পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৫টি গণহত্যা ও অসংখ্য সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছিল। জুম্মদের শত শত ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল। কয়েকশত জুম্ম অধিবাসীকে হত্যা-খুন করা হয়েছিল। জুম্ম নারী ও শিশুদের শিকার হতে হয়েছিল পাশবিক নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার। ফলে শত শত পরিবার জুম্ম নর-নারী নিজ জায়গা-জমি ও বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ হতে বাধ্য হয়েছিল। জুম্ম জনগণ বার বার নিজ বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ হয়ে বনে-জঙ্গলে ও বিদেশের মাটিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হতে হয়েছিল। অনেকে নিজ দেশে পরবাসী হয়ে নিরাপত্তাহীন জীবনযাপন অথবা গভীর অরণ্যে পলাতক জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছিল। আর অনেকে চিরতরে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। এগুলোই ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের জাতীয় দূর্যোগের মতোই দুঃখজনক ঘটনা।
পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামে মুসলমান অনুপ্রবেশ, ৬০ দশকে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ এবং ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান আমলে সংবিধান সংশোধনসহ এসব ত্রিমুখী ষড়যন্ত্র এবং বাংলাদেশ শাসনামলে নৃশংস ও বর্বর অসংখ্য গণহত্যা, সাম্প্রদায়িক হামলা, জুম্মদের নজিরবিহীন ভূমি বেদখল, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের ঘটনার মতো বিভৎসতা আমাদের জুম্ম জাতির জন্য আরও বেশি বেদনাদায়ক। জুম্ম জনগণের এইসব বেদনা ও যন্ত্রণার গভীর তাড়নাবোধ থেকে জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সংরক্ষণের সংগ্রাম তথা জাতীয় মুক্তির সংগ্রামের সক্রিয় মানসিকতা গড়ে উঠেছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘ দুই যুগের অধিক পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জনগণের সাথে বাংলাদেশ সরকারের মধ্যেকার রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চলেছিল। ফলশ্রুতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তি স্বাক্ষরের পরও পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিকায়ন ও সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায় সাম্প্রদায়িক হামলা, ভূমি জবরদখলসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের নানা প্রান্তে ইসলামীকরণ বন্ধ করা যায়নি। চুক্তি স্বাক্ষরের পর ২৫ বছর অতিক্রান্ত হলেও সরকার চুক্তির মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অবাস্তবায়িত অবস্থায় রেখে দিয়েছে। বিপরীত পক্ষে সরকার একদিকে ইসলামীকরণ নীতি বাস্তবায়ন এবং অপরদিকে জুম্ম জনগণের জাতীয় পরিচিতি একেবারে বিলুপ্ত করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক শাসন তথা সামরিকায়ন অব্যাহত রেখেছে। ১৯৮০ সালে প্রবর্তিত ‘অপারেশন দাবানল’ এর পরিবর্তে ২০০১ সাল থেকে ‘অপারেশ উত্তরণ’ প্রতিস্থাপন করে পার্বত্য চট্টগ্রামে একপ্রকার সামরিক শাসন জারী রাখা হয়েছে। সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদে ও সহায়তায় সমতল ভূমি থেকে মুসলিম জনগোষ্ঠী ও মায়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে অব্যাহতভাবে অনুপ্রবেশ ঘটানো হচ্ছে। এছাড়াও সরকারের বিশেষ মহল কর্তৃক একদিকে নামে-বেনামে ভূঁইফোড় সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় ও সরাসরি মদদ দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে দিন দিন বিশ্রী ও ভীতিকর করে তুলছে, অপরদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ জাতীয় দলগুলোতে যুক্ত জুম্মদের সুবিধাবাদী ও চরম তোষামোদী লোকদের মদদ দিয়ে পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ও জুম্মস্বার্থ পরিপন্থী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। বস্তুতপক্ষে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের বিপরীতে সরকার সম্ভাব্য জুম্ম বিরোধী সকল শক্তিসমূহ কাজে লাগিয়ে জুম্ম জনগণকে জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করে চলেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
সবশেষে জুম্ম তরুণদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলতে চাই-পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি জুম্ম জনগণের মুক্তির সনদ। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি শত-শত জুম্ম বীর শহীদদের আত্মত্যাগের ফসল এবং হাজারো জুম্ম নর-নারীর লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, অক্লান্ত পরিশ্রম, ঘাম ও রক্তে গড়া একমাত্র ফসল। এই চুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জনগণের অধিকারের সনদ। এই চুক্তির সাথে বিপ্লবী নেতা এম এন লারমার স্বপ্ন একাকার হয়ে রয়েছে। কাজেই, পার্বত্য চুক্তি কখনো বৃথা যেতে দিতে পারি না। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন থেকে জুম্ম জনগণ যেমনি পিছপা হতে পারে না, তেমনি এই আন্দোলন থেকে সরে যাওয়া মানে একধরনের হঠকারিতার সামিল। যেকোনো আন্দোলন এগিয়ে নেওয়ার জন্য আন্দোলনের কর্মসূচি দরকার। তারই প্রেক্ষাপটে আমাদের পার্টির আশু লক্ষ্য পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি দেওয়া আছে এবং এর আলোকে ১০ দফা ভিত্তিক কর্মসূচিও হাতে নেওয়া হয়েছে। জুম্ম জনগণের বর্তমান প্রাণপ্রিয় নেতা জে বি লারমা পার্বত্য চুক্তির ১৭ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০১৫ সালে ২৯ নভেম্বর রাজধানী ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, আগামী ২০১৬ সালে ৩০ এপ্রিলের মধ্যে চুক্তি বাস্তবায়নে সময়সূচি ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করা না হলে ২০১৬ সালে ১লা মে থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হবে। অসহযোগ আন্দোলনের অংশ হিসেবে জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে জুম্ম জনগণের প্রিয়নেতা জে বি লারমা ১০ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি ও বাস্তবতা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চরম প্রতিকূল হওয়ার কারণে আমাদের সেই কর্মসূচিগুলো অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে আছে।
তাই আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে হলে পূর্বঘোষিত কর্মসূচির ভিত্তিতে আমাদের পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে আন্দোলনের স্লোগান তুলতে হবে। পূর্বঘোষিত ১০ দফা কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে-হরতাল, অবরোধ, সরকারি-বেসরকারি অফিস বর্জন, চুক্তি বিরোধী ও সরকারের দালালদের সামাজিকভাবে বয়কট, কালো পতাকা মিছিল, ছাত্র ধর্মঘট, অর্থনৈতিক অবরোধ, জুম্ম জনগণ কর্তৃক আদালত বর্জন, পর্যটন কেন্দ্রের বিরোধীতা, অবৈধ পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনে প্রতিরোধ, চুক্তি বিরোধী ও জুম্মস্বার্থ পরিপন্থীদের প্রতিরোধ, ভূমি অধিগ্রহণ ও বেদখল প্রতিরোধ। গণতান্ত্রিক উপায়ে এসকল কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে জনসংহতি সমিতির অধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে পাইকারী হারে মিথ্যা মামলা, হুমকি, ধরপাকড়, গ্রেপ্তার, জেল-জুলুম, হুলিয়া, রাতে-বিরাতে সেনাবাহিনীর অভিযান, অন্যায়ভাবে সাধারণ মানুষের উপর নির্যাতন, মারধর, জুম্ম বাড়িঘরের জিনিসপত্র তছনছ ও সম্পত্তি লুটপাট ইত্যাদি হীন কার্যকলাপ ও ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিয়ে চুক্তির আগের মতোই পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করে চলেছে বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী। যার কারণে অসংখ্য অধিকার কর্মীসহ সাধারণ মানুষ আজ নিজের ঘরছাড়া ও এলাকাছাড়া হয়ে ভবঘুরের মতোই পালিয়ে বেড়াতে বাধ্য হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের লেশমাত্র না থাকায় জুম্ম জনগণ বিকল্প উপায়ে চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য হবে। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে জুম্ম তরুণরাই আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তিরূপে জুম্ম-জনতার সামনে আর্বিভূত হবে। পার্বত্য চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত ব্যাপক জুম্ম তরুণরাই প্রয়োজনে শাসকগোষ্ঠীর বন্দুকের ব্যারেলের সামনে লড়ে যাবে-সব ফ্রন্টে সমানতালে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠাসহ পার্বত্য চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়ন তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের লক্ষে বৃহত্তর আন্দোলনের কোন বিকল্প নেই।