হিল ভয়েস, ১৪ জুলাই ২০২৩, বিশেষ প্রতিবেদন (প্রতিবেদনটি জুম্মবার্তা, ১১শ সংখ্যা, জানুয়ারি-জুন ২০২৩ থেকে নেয়া):
হেডম্যানদের কাছ থেকে জোরপূর্বক দস্তখত আদায়:
জুরাছড়ি উপজেলার দুমদুম্যা ইউনিয়নে সীমান্ত সড়ক নির্মাণকারী বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক জোরপূর্বক ও বেআইনীভাবে স্থানীয় হেডম্যানদের কাছ থেকে স্বাক্ষর গ্রহণ করা হচ্ছে। সেনাবাহিনী সীমান্ত সড়ক ও সংযোগ সড়ক সংলগ্ন আশেপাশের সকল ভূমি খাসজমির অন্তর্ভুক্ত বলে স্বীকারোক্তি নিয়ে সংশ্লিষ্ট মৌজার হেডম্যানের কাছ থেকে এই স্বাক্ষর গ্রহণ করছে।
উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি, পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ১৯৮৯ (১৯৯৮ সালে সংশোধিত), পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ (২০১৬ সংশোধিত) এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০-এ স্বীকৃত পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের প্রথাগত ভূমি অধিকার অনুসারে সংশ্লিষ্ট মৌজার সকল ভূমি মৌজাবাসীর প্রথাগত ভূমি হিসেবে স্বীকৃত। এসব ভূমি হেডম্যানের পরিচালনায় জুম চাষ, বন সংরক্ষণ, চারণ ভূমি, বসতভিটা, শ্মশান ভূমি হিসেবে বন্টন ও ব্যবহার হয়ে থাকে। ফলে জুম্মদের প্রথাগত ভূমি অধিকার মোতাবেক হেডম্যানের অধীন এসব মৌজা ভূমি খাস বলে বিবেচিত নয় এবং খাস ভূমি হিসেবে কোনো হেডম্যান কোনো প্রত্যয়নপত্রও প্রদান করতে পারে না।
দুমদুম্যা ইউনিয়নে সীমান্ত সড়ক নির্মাণকারী সেনাবাহিনীর সদস্যরা স্থানীয় গন্ডাছড়া মৌজার হেডম্যান সুংঙুর পাংখোয়াকে সীমান্ত সড়কের জায়গা ও এর আশেপাশের ভূমি সরকারি খাস জমি হিসেবে উল্লেখ করে সেনাবাহিনীর তৈরিকৃত একটি সনদপত্রে স্বাক্ষর দিতে নির্দেশ পাঠায় বলে জানা যায়। সেনাবাহিনীর তৈরিকৃত ঐ সনদপত্রে ‘নির্মিতব্য সীমান্ত সড়কটি সরকারি খাস জমির উপর দিয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে। উক্ত সড়কটির এলাইনমেন্ট এবং এলাইনমেন্ট সংলগ্ন সকল জমি সরকারি খাস জমির অন্তর্ভুক্ত’ বলে উল্লেখ করে মনগড়া বক্তব্য প্রদান করা হয়।
ইতোমধ্যে দুমদুম্যা ইউনিয়নে অবস্থিত গাছবাগান সেনা ক্যাম্পের ওয়ারেন্ট অফিসার সাইফুল উক্ত বক্তব্য সম্বলিত সনদপত্র শীর্ষক একটি কাগজ ১৫০নং দুমদুম্যা মৌজার হেডম্যান ও কার্বারিদের পাঠিয়েছেন এবং তাদের এতে স্বাক্ষর দিতে হবে বলে নির্দেশ দিয়েছেন। তবে ওয়ারেন্ট অফিসার সাইফুল হেডম্যান ও কার্বারিদের উদ্দেশ্য করে এটাও বলেছেন যে, ‘আপনারা স্বাক্ষর না করলেও তাতে কোনো কিছু আসে যায় না। সরকার তার কাজ সে করেই চলবে।’
অপরদিকে পার্শ্ববর্তী রেংখ্যং চংড়াছড়ি মৌজার হেডম্যান বলভদ্র চাকমার কাছ থেকেও এ ধরনের স্বাক্ষর আদায় করা হয়েছে বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন। মূলত ক্ষতিগ্রস্ত জুম্মদেরকে ক্ষতিপূরণ প্রদান না করা এবং সীমান্ত সংলগ্ন প্রথাগত জায়গা-জমিতে জুম্মদেরকে জুম চাষ ও বসতবাড়ি নির্মাণে বাধা প্রদানের হীনউদ্দেশ্যেই সেনাবাহিনী হেডম্যানদের কাছ থেকে এসব ভূমিকে খাস ভূমি হিসেবে প্রত্যয়ন প্রদানের জন্য জোরপূর্বক স্বাক্ষর নেয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। সীমান্ত সড়ক সংলগ্ন ব্যাপক এলাকা থেকে জুম্মদের বিতাড়নের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে সেনাবাহিনী এধরনের হীনতৎপরতা চালাচ্ছে বলে অনেক গ্রামবাসী অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
পর্যটনের জন্য সেনাবাহিনী কর্তৃক আকর্ষণীয় জায়গা জবরদখল:
সেনাবাহিনী কর্তৃক রাঙামাটি জেলাধীন বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়নে সীমান্ত ও সংযোগ সড়ক সংলগ্ন প্রত্যন্ত এলাকার জুম্ম অধ্যুষিত গাছবান গ্রামটি দীর্ঘদিন ধরে উচ্ছেদের পাঁয়তারা চলছে। ইতোমধ্যে ওই গ্রামের ২৬ পরিবারের মধ্যে ১৭ পরিবার অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে এবং বাকী ৯ পরিবারকেও সেনাবাহিনী কর্তৃক সেখান থেকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
অবশিষ্ট ৯ জুম্ম পরিবারকে গ্রাম থেকে উচ্ছেদের জন্য সেনাবাহিনী কর্তৃক প্রতিনিয়ত গ্রামবাসীদের হুমকি-ধামকি প্রদান, গালিগালাজ ও হয়রানি করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। সেনাবাহিনী কর্তৃক জুম্মদের একটি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া, দু’টি দোকান ভাঙচুর এবং চার পরিবারের জুমে কাটা মাটি ফেলে দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। অপরদিকে জুম্মদের উচ্ছেদ করা হলেও সড়কের পাশে নতুন সেনা ক্যাম্প এবং বড় মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে বলে জানান গ্রামবাসীরা।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ গাছবান সেনা ক্যাম্পের ২৬ বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কোর এর ক্যাপ্টেন মারুফ ও সুবেদার মো: আহম্মেদ ফারুয়া ইউনিয়নের গাছবান পাড়া এলাকার কার্বারি (গ্রাম প্রধান) সহ ৯ জুম্ম পরিবারকে নিয়ে এক সভা ডেকে ১৫ দিনের মধ্যে নিজেদের বাড়িঘর ও জিনিসপত্র নিয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। এর আগে ৩০ জানুয়ারি ২০২৩ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ বিলাইছড়ি-বরকল এলাকার সীমান্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্প পরিদর্শনে গেলে তিনিই উক্ত ৯ জুম্ম পরিবারকে তাদের আবাসস্থল থেকে উঠিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়ে যান বলে জানান ক্যাপ্টেন মারুফ।
গত ১ মার্চ ২০২৩ সেনাবাহিনীর ৩৪ বীর বেঙ্গলের গাছবান সেনা ক্যাম্পের সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার আহমেদ ও ওয়ারেন্ট অফিসার গোবিন্দের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি দল গাছবান গ্রামে গিয়ে জুম্মদের দুটি দোকান ভেঙে দেয়। উক্ত ঘটনার প্রায় এক ঘন্টা পর, সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার আহমেদ আরও দুই সেনা সদস্য সঙ্গে নিয়ে বাত্যে লাল চাকমা (২৫) পিতা-বুদ্ধলীলা চাকমা নামে এক গ্রামবাসীর বাড়ি ভেঙে ফেলে এবং বাড়িটি জ্বালিয়ে দেয়।
নিজেদের আয়ের উৎস দোকান ও আশ্রয়স্থল বাড়ি হারিয়ে উক্ত গ্রামবাসীরা বর্তমানে চরম অনিশ্চয়তা, আতঙ্ক ও কঠিন অবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। গাছবান সেনা ক্যাম্পের সেনা সদস্যরা উচ্ছেদের উদ্দেশ্যে ওই ৯ পরিবারকে জুম চাষেও নানাভাবে বাধা সৃষ্টি করছে। এর কিছুদিন আগে সেনা সদস্যরা তাদের ট্রাক্টর দিয়ে মাটি কেটে এনে জুমের জন্য নির্ধারিত জায়গার উপর সেই মাটি ঢেলে দিয়েছে। এতে চার পরিবারের জুমচাষ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। উক্ত ঘটনার কিছুদিন আগে ক্যাম্পের ক্যাপ্টেন মারুফ গ্রামে গিয়ে গ্রামের কেউ জুমে আগুন দিতে পারবে না বলে নির্দেশ দিয়ে আসেন। ক্যাপ্টেন মারুফ আরও বলেন, ‘এখানে আমি তিনমাস থাকবো, দেখবো তোমরা কিভাবে জুমে আগুন দাও।’ তারপর তিনি গ্রামবাসীদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন।
সেনাবাহিনী মূলত ওই এলাকায় তাদের বিলাসবহুল পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করার উদ্দেশ্যেই উক্ত গ্রামবাসীদের জায়গাটি দখলে নেয়ার চেষ্টা করছে। সেনাবাহিনী শুধু সীমান্ত সড়ক নির্মাণ করছে না, তারা সীমান্ত সড়কের নামে জুম্মদের ধনসম্পদ ধ্বংসসহ স্বভূমি থেকে উচ্ছেদ করছে এবং পর্যটন ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে আকর্ষণীয় জায়গাগুলো নিজেদের দখলে নিচ্ছে। কোনো কোনো জায়গায় সংরক্ষিত এলাকা বা সেনাবাহিনীর জায়গা বলে সাইনবোর্ডও টানিয়ে দিয়েছে।
আলোচনা করা হয়নি পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠানের সাথে:
গ্রামের সাধারণ লোকজন এই সীমান্ত সড়ক ও সংযোগ প্রকল্প সম্পর্কে আগে থেকেই কেউ কিছুই জানতেন না। এমনকি স্থানীয় সরকার পরিষদের জনপ্রতিনিধিরাও কিছুই জানেন না। শুধু এটুকুই জানে, সরকার রাস্তা বানাচ্ছে। পুরো সীমান্ত ঘিরে ফেলবে। পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থায় সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ কিংবা প্রথাগত প্রতিষ্ঠানের সাথে কোনরূপ আলোচনা ও সম্মতি গ্রহণ করা হয়নি বলে জানা গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থার অধীনে স্থাপিত আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও স্থানীয় জুম্ম জনগণের মতামত এবং স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতি ব্যতিরেকে সরকার সেনাবাহিনীর মাধ্যমে তিন পার্বত্য জেলায় সীমান্ত সড়ক ও সংযোগ সড়ক নির্মাণ করছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও চুক্তি মোতাবেক প্রণীত আইনে পার্বত্য জেলা পরিষদ কর্তৃক হস্তান্তরিত বিষয়সমূহের উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা এবং জাতীয় পর্যায়ে গৃহীত সকল উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ কর্তৃক সকল উন্নয়ন কার্যক্রম সমন্বয় সাধন ও তত্ত্বাবধান করার বিধান করা হয়েছে। কিন্তু আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদকে পাশ কাটিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে উপর থেকে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, যা আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের সিদ্ধান্ত-নির্ধারণী অধিকার তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থাকে ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে এবং প্রশাসন ও উন্নয়নে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। (সমাপ্ত)
*জুম্ম বার্তা: জনসংহতি সমিতির অনিয়মিত মুখপত্র