হিল ভয়েস, ১৩ জুলাই ২০২৩, বিশেষ প্রতিবেদন (প্রতিবেদনটি জুম্মবার্তা, ১১শ সংখ্যা, জানুয়ারি-জুন ২০২৩ থেকে নেয়া):
সড়ক নির্মাণের ফলে ক্ষয়ক্ষতি, উচ্ছেদ ও বিতাড়ন:
এই সীমান্ত সড়ক নির্মাণ এবং এ সড়কের সাথে সংযোগ সড়ক নির্মাণের ফলে জুম্মদের শত শত পরিবারের বসতবাড়ি, বাগান-বাগিচা, স্কুল, মন্দির উচ্ছেদ ও ধ্বংস করা হচ্ছে। কিন্তু তাদেরকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়নি। সীমান্ত সড়কের চেয়ে সংযোগ সড়ক নির্মাণে বেশি ক্ষয়ক্ষতি করা হচ্ছে। সেনাবাহিনী তাদের ইচ্ছা মতো সংযোগ সড়ক তৈরি করছে। স্থানীয় জুম্ম জনগণকে কীভাবে কম ক্ষতি করা যায় সে বিষয়টি বিবেচনা করছে না সেনাবাহিনী। নিম্নে এর কিছু উদাহরণ তুলে ধরা হলো-
১। রাজস্থলী-বিলাইছড়ি-জুরাছড়ি-বরকল-ঠেগামুখ সংযোগ সড়ক: ২০১৬ সালের জুনে বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের প্রকাশিত এক রিপোর্টে রাজস্থলী-বিলাইছড়ি-জুরাছড়ি-বরকল-ঠেগামুখ সংযোগ সড়ক বাস্তবায়নের জন্য আনুমানিক ৬১১ একর ভূমির প্রয়োজন হবে বলে উল্লেখ করা হয়। সমীক্ষায় জানানো হয় যে, উক্ত রাজস্থলী-বিলাইছড়ি-জুরাছড়ি-বরকল-ঠেগামুখ সড়ক নির্মাণ করা হলে ১১৪ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে, ৫৬৪ পরিবার প্রভাবিত/ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ২৪১টি বাগান ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ১৫৭ পরিবার ব্যবসায়িক কাঠামো হারাবে, ১০টি সাংস্কৃতিক অবকাঠামো (৩টি মসজিদ, ৩টি মন্দির ও ৪টি স্কুল) ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং ৩২টি পুকুর ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে জানানো হয়।
এই সড়ক নির্মাণ কাজের ফলে ইতোমধ্যে দুই উপজেলায় অন্তত ১২৯ পরিবার জুম্ম ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছে। তন্মধ্যে রাজস্থলী উপজেলায় ৫৫ পরিবার জুম্ম প্রায় ২৭.০৫ একর ভূমি এবং ২,১৫১টি বনজ ও ফলজ গাছ হারিয়েছে। অপরদিকে বিলাইছড়ি উপজেলায় ৭৪টি পরিবার ৯.৮ একর পরিমাণ ভূমি এবং ১,৪১৫টি বনজ ও ফলজ গাছ হারিয়েছে। এছাড়া এই সড়ক নির্মাণের ফলে বিলাইছড়ির ফারুয়া ইউনিয়নের এগুজ্যাছড়ি এলাকা থেকে ৮ পরিবার, শুক্করছড়ি এলাকা থেকে ৫ পরিবার ও গবছড়ি এলাকা থেকে ৬ পরিবার জুম্ম নিজ বসতভিটা থেকে উচ্ছেদের শিকার হয়েছে বলে জানা গেছে। অধিকন্তু ২০২২ সালের আগষ্ট মাস থেকে রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ির ফারুয়া ইউনিয়নে সেনাবাহিনীর বীর ৩২ রেজিমেন্ট কর্তৃক গাছ-বাঁশের ব্যবসা ও গ্রামের প্রথাগত ভূমিতে চাষাবাদ করতে বাধা দেয়া হয়েছে।
২। সিজকছড়া থেকে সাজেক-শিলদা-বেতলিং সংযোগ সড়ক: বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২০ ইসিবি (ইঞ্জিনিয়ার্স কন্সট্রাকশন ব্যাটিলিয়ন) শিজকছড়া থেকে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী এলাকা উদয়পুর পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ করছে। এছাড়া উদয়পুর থেকে উত্তরে ১০ কিলোমিটার এবং দক্ষিণে ১০ কিলোমিটার সীমান্ত সড়ক নির্মাণাধীন রয়েছে। কমলাক সাজেক ইউনিয়নের অন্তর্গত রুইলুই মৌজা ও লংকর মৌজার রুইলুই, শিজকছড়া, দাড়ি পাড়া হতে মিজোরামের শিলছড়ি সীমান্ত পাড় পর্যন্ত সড়ক নির্মাণের ফলে নিজস্ব বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ এবং আংশিক বাগান-বাগিচা ও জুমভূমি হারিয়ে ২১১ পরিবারের আনুমানিক প্রায় ৮৫০ একর ভূমি ক্ষতিগ্রস্ত বা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কমলাক এলাকায় ৬ পরিবার জুম্ম গ্রামবাসীর প্রায় ২০ একর পরিমাণ ভূমি বেদখল করে একটি বিজিবি ক্যাম্প নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া সিজকছড়া হতে উদয়পুর পর্যন্ত ৫টি সেনা ক্যাম্প স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যে জুম্মদের ভূমি বেদখল করে সিজকছড়া মুখ নামক স্থানে একটি এবং উদয়পুর এলাকায় একটি সেনা ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে।
সেনাবাহিনী কর্তৃক ৩২ কিলোমিটার পরিমাণ সড়ক নির্মাণ করার জন্য সাজেকের দাঁড়ি পাড়া, ছয়নালপাড়া, বড় কমলাক পাড়া ও উদয়পুর গ্রামের ৬০ পরিবারের অন্তত ৪৩ একর ভূমি বেদখল করা হয় এবং সেখানে গড়ে তোলা দীর্ঘ দিনের সেগুন, কলা, আম, লিচু, সুপারি, ফুল ঝাড়ু ইত্যাদি বাগান ও হলুদ, তিল ইত্যাদি ক্ষেত ধ্বংস করে দেয়া হয়। সড়কের পাশে থাকা বেশকিছু জুম্ম গ্রামবাসীর বাড়িঘরও ভেঙে দেয়া হয়েছে। এমনকি বড় বড় বুলডোজার ও ট্রাক্টর দিয়ে একরের পর একর প্রাকৃতিক বন ও পাহাড়ও কাটা হয়।
৩। আলিকদম-কুরুকপাতা-পোয়ামুহুরী সংযোগ সড়ক নির্মাণের ফলে কুরুকপাতা ইউনিয়নের অধীন ১৩টি গ্রামের ৬০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে ৩৯ পরিবারের ঘরবাড়ি উচ্ছেদ হয়, ২৬ পরিবারের বাগান-বাগিচা ও ৩ পরিবারের জুমভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে জানা গেছে। এমনকি ঘরবাড়ি উচ্ছেদ হয়ে ৩৯ পরিবারকে নিজ বাস্তুভিটা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে হয়। ৬০ পরিবারের মধ্যে ৪৫ পরিবার ম্রো জনগোষ্ঠী, ২৩ পরিবার ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী ও ২ পরিবার মারমা জনগোষ্ঠীর বলে জানা গেছে।
৬০ পরিবারের মধ্যে ক্রাতপুং ম্রো চেয়ারম্যান কুরুকপাড়ার ৪ পরিবার (২ ত্রিপুরা ও ২ মারমা পরিবার)-এর বাগান ক্ষতিগ্রস্ত; করুকপাড়া বাজারের মেনপাত পাড়ার ৬টি ম্রো পরিবারের ঘর উচ্ছেদ; বুচিছড়া মেত্তলা পাড়ার ১ ম্রো পরিবারের বাগান ও ২ ম্রো পরিবারের জুমভূমি ক্ষতিগ্রস্ত; ছোট বেটি খরচং পাড়ার ১ ম্রো পরিবারের বাগান ক্ষতিগ্রস্ত; দুঃখা পাড়ার ১ ম্রো পরিবারের বাগান ক্ষতিগ্রস্ত; বড় বেটি ইয়াংরি পাড়ার ৯ ম্রো পরিবারের বাগান ক্ষতিগ্রস্ত; দরিঅলেং পাড়ার ৩ ম্রো পরিবারের জুমভূমি ক্ষতিগ্রস্ত; জানালী পাড়ার ৪ ম্রো পরিবারের বাগান ক্ষতিগ্রস্ত; মেরিংচর কেংক পাড়ার ৬ ম্রো পরিবারের বাগান ক্ষতিগ্রস্ত; সাথিরাম ত্রিপুরা পাড়ার ১ পরিবারের বাগান ক্ষতিগ্রস্তসহ ৩ ত্রিপুরা পরিবারের ঘর উচ্ছেদ; জিরা পাড়ায় ২ পরিবারের বাগান ক্ষতিগ্রস্তসহ ১৮ ত্রিপুরা পরিবার উচ্ছেদ ও অন্যত্র স্থানান্তর; মেননিক ম্রো পাড়ায় ৮ পরিবারের ঘর উচ্ছেদ; এবং মেনদন পাড়ায় ২ পরিবারের ঘর উচ্ছেদসহ ৪ ম্রো পরিবারের বাগান ক্ষতির শিকার হয়।
৪। বাঘাইছড়ি আর্য্যপুর বনবিহারের কাছাকাছি উগলছড়ি গ্রাম হতে সংযোগ সড়ক নির্মাণের ফলে বাঘাইছড়িতে ১৮৮ পরিবারসহ জুম্ম গ্রামবাসীদের অন্তত ৫০০ পরিবারের বসতবাড়ি, বাগান-বাগিচা, স্কুল, মন্দির উচ্ছেদ করা হচ্ছে। সেনাবাহিনীর ২০ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্যাটেলিয়ন কর্তৃক জুম্মদের বসতবাড়ি, বাগান-বাগিচা ও বিভিন্ন স্থাপনা ধ্বংস করে জোরপূর্বক এ ধরনের সংযোগ সড়ক নির্মাণের বিরুদ্ধে গত ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ বিক্ষোভ প্রদর্শন ও ক্ষতিপূরণ চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিকট স্মারকলিপি দিয়েছে বাঘাইছড়ির ক্ষতিগ্রস্ত ১৮৮ পরিবারের লোকজন। পরে তাদেরকে খুবই সামান্য পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে। সর্বমোট ২৪ লক্ষ ৭৫ হাজার ২১৫ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
৫। পানছড়ি ও মাটিরাঙ্গা উপজেলায়ও সীমান্ত সড়ক নির্মাণের নামে জুম্মদের বাগান-বাগিচা ও স্থাপনা ধ্বংস করা হচ্ছে। পানছড়ি উপজেলায় জুম্ম গ্রামবাসীদের ঘরবাড়ি ঘেঁষে সীমান্ত সড়কের জন্য মাটি কেটে নেয়া হয়েছে। অনেক বাড়ির উঠোন কেটে নেয়া হয়েছে। সড়কের দুই পাড়ে আম, কাঁঠালসহ যেসব ফলজ গাছ ছিলো সেগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। ধানি জমির উপর দিয়ে সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। উন্নয়ন কর্মী অশোক কুমার চাকমা বলেন, লোগাং ইউনিয়নের ঘিলাতুলিতে একজনের বাড়ির উঠোন কেটে নেয়া হয়েছে। তার বসত বাড়ি এখন হুমকির মুখে। সড়ক থেকে ঘরের দূরত্ব ৫ ফুটও নেই। বর্ষাকালে অতিবৃষ্টি হলে ভূমি ধ্বস হওয়ার আশংকা রয়েছে। ধারণ দেওয়াল দেয়া না হলে ঘরটাও ভেঙে পড়তে পারে। উক্ত গ্রামবাসীর লিচু, কাঁঠাল, আম ও কাঠদায়ী গাছ কাটা পড়েছে। একজনের লাগানো ছায়াশীতল বটগাছও কাটা হয়েছে।
উক্ত গ্রামবাসী সড়কের মাটি কাটার সময় দায়িত্বরত এক সেনাকে অনুরোধ করেছিলেন একটু দূরে করে মাটি কাটতে। কিন্তু তিনি কোনো কথা শুনেননি। সেনা সদস্যকে যখন বুলডোজার চালাতে মানা করা হচ্ছিলো, তিনি নাকি বলেছেন, “রাস্তার জন্য যা করার তা করবো। দেশ আমার, মাটি আমার।” এভাবে ঘিলাতুলি গ্রামের অনেক পরিবারের ফলজ গাছ ও ক্ষেত কেটে ফেলা হয়েছে। ঘিলাতুলি গ্রামের কার্বারী ঘরের উঠোনটাও সীমান্ত সড়কের মাটি কাটা থেকে রক্ষা করতে পারেননি।
পানছড়ি অঞ্চলে সীমান্ত সড়কের কাজ করতে গিয়ে অনেকের ধানি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই ধানি জমিগুলোকে সাধারণত চাকমা ভাষায় ‘ঘোনা ভুই’ (দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী ধানি জমি) বলা হয়। সড়ক নির্মাণ করতে গিয়ে অনেক পাহাড় কেটে ফেলা হয়েছে। ঘোনা জমিতে মাটি পড়ে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। কোথাও কোথাও ঘোনা জমির উপর দিয়ে সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে অনেক পরিবার ঘোনা জমিতে আর চাষ করতে পারবে না। জলাবদ্ধতা আর বাঁধের নিম্ন অঞ্চলে মাটির আস্তর বেড়ে যাওয়ার কারণে অনেক ঘোনা জমি চাষের অযোগ্য হয়ে উঠেছে।
লোগাং ইউনিয়নের ঘিলাতুলি গ্রামে সমবায়ের মত একটা সমিতি করে আম, পেয়ারা ও বড়ই বাগান করা হয়েছে। সড়ক নির্মাণের জন্য সেই বাগান দখল করে বিজিবি ক্যাম্প তৈরী করা হয়েছে। ঐ বিজিবি ক্যাম্পে পানি সরবরাহের জন্য একজনের ঘোনা জমিতে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এরকম আরো অনেক পরিবার আছে, যারা ঐ সড়ক প্রকল্পের কারণে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পানছড়ি উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোর কার কয়টা গাছের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সে ব্যাপারে একটা তালিকা করা হয়েছিলো। তাদেরকে নাকি মৌখিকভাবে জানানো হয়, ভবিষ্যতে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। কিন্তু কী দেয়া হবে এবং কখন দেয়া হবে, সে ব্যাপারে তাদেরকে কিছুই জানানো হয়নি। যাদের ফলজ গাছের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিলো, তাদেরকে দায়িত্বরত সেনাসদস্যরা কিছু টাকা দিয়েছিলেন। তারা নাকি বলেছিলেন, ঐ টাকাটা ক্ষতিপূরণের টাকা হিসেবে নয়, সরকার খুশি হয়ে ‘মাছ মাংস’ কিনে খাওয়ার জন্য দিচ্ছে। গ্রামবাসীরা নিতে চায়নি। শেষ পর্যন্ত সেনা সদস্যরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তালিকাভুক্ত পরিবার প্রধানদের হাতে টাকা ধরিয়ে দিয়েছিলেন। টাকা দিয়ে ছবি তুলেছিলেন। কেউ কেউ ২,০০০ টাকা, কেউ কেউ ২,৫০০ টাকা আর কেউ কেউ নাকি ৩,০০০ টাকা পেয়েছিলেন। গ্রামবাসীরা জানালেন, তারা বুঝতে পারলো না, ঐ টাকা গাছ-গাছালির ক্ষতিপূরণের দাম নাকি সরকারের খুশিতে মাছ-মাংস কিনে খাওয়ার টাকা।
৬। অন্যান্য অঞ্চল: বরকল উপজেলাস্থ হরিণা ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের ১৬০ নং তৈবাং মৌজায় ঘাসকাবাছড়া বিজিবি ক্যাম্প থেকে শ্রীনগর বাজার পর্যন্ত বিজিবি কর্তৃক সীমান্ত সড়ক নির্মাণে ৭ জন গ্রামবাসীর অনেক সেগুন বাগান কেটে ধ্বংস করা হয়েছে। বিজিবি ঘাসকাবাছড়া বিওপি ক্যাম্পের কমান্ডার নাম মোঃ হায়দার এর নেতৃত্বে ঘাসকাবাছড়া ক্যাম্প থেকে শ্রীনগর বাজার পর্যন্ত বিজিবি কর্তৃক ১০ ফুট চওড়া আনুমানিক ৩ কিলোমিটার একটি সীমান্ত সড়ক নির্মাণের সময় উক্ত ৭ জন গ্রামবাসীর ২৫ টি সেগুন গাছ কেটে দেয়া হয়। যার বাজার মূল্য ১ লক্ষ টাকার উপরে।
উল্লেখ্য, রাস্তা না কাটার আগে ক্যাম্প কমান্ডার মো: হায়দার শ্রীনগর বাজারের স্থানীয় কার্বারী জ্ঞানশ্রী চাকমার সাথে রাস্তাটির বিষয়ে কথা বললে তিনি স্থানীয় গ্রামবাসীদের ক্ষয়ক্ষতির কথা বিবেচনা করে রাস্তাটি না কাটার অনুরোধ করেন। কিন্তু গ্রামবাসীদের ক্ষয়ক্ষতি ও ক্ষতিপূরণের কথা বিবেচনা না করে বর্তমানে রাস্তাটি বিজিবি নির্মাণ করছে।
সড়ক সংলগ্ন জায়গাতে ঘরবাড়ি নির্মাণে বাধা, জনগণের প্রতিবাদ ও ক্ষতিপূরণের দাবি
বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক এলাকার আদিবাসী জুম্ম জনগণ বাঁচার আকুতি এবং ভূমি বেদখল বন্ধ করে আদিবাসীদের ভূমি অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। তারা বলছেন, উন্নয়ন নয়, আগে বাঁচতে হবে। আমার ভূমি আমার মা, কেড়ে নিতে দেবো না; আদিবাসীদের ভূমি অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। গত ২৮ এপ্রিল ২০২১ সাজেকের কমলাক, তালছড়া ও ছয়নালছড়া এলাকাবাসী জুম্ম জনগণ এক মানববন্ধন আয়োজন করে এসব দাবি ও মতামত উত্থাপন করেন। মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারী জুম্মরা স্থানীয় জুম্মদের ভূমি জোরপূর্বক বেদখল করে বিজিবি ও সেনা ক্যাম্প স্থাপন এবং সাজেক সড়ক নির্মাণের বিরোধিতা করেন এবং প্রতিবাদ জানান।
মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারী গ্রামবাসীরা কমলাক এলাকায় জুম্মদের জুম চাষে বাধা দিয়ে ও তাদের জুম ভূমি বেদখল করে এবং জুম্মদের সেগুন বাগান ও ফলজ বাগান ধ্বংস করে সেনাবাহিনীর ইসিবি (ইঞ্জিনিয়ার্স কনস্ট্রাকশন ব্যাটিলিয়ন) সড়ক নির্মাণ এবং বিজিবি নতুন ক্যাম্প স্থাপন করছে। জানা গেছে, সেখানে ৬ পরিবার জুম্ম গ্রামবাসীর প্রায় ২০ একর পরিমাণ ভূমি বেদখল করে সড়ক ও বিজিবি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে।
কমলাক পাড়ার জনৈক বাসিন্দা জানান, ‘এই এলাকার মানুষের বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন হচ্ছে জুম। এখন আমাদের জুমচাষে বাধা দেয়া হচ্ছে এবং জুমভূমি বেদখল করা হচ্ছে। এখন আমরা কী খেয়ে বাঁচবো?’ জানা গেছে, কেবল সিজকছড়া হতে উদয়পুর পর্যন্ত ৫টি সেনা ক্যাম্প স্থাপনের উদ্যোগ রয়েছে। ইতোমধ্যে জুম্মদের ভূমি বেদখল করে সিজকছড়া মুখ নামক স্থানে একটি এবং উদয়পুর এলাকায় একটি সেনা ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে।
পানছড়ি উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী গ্রাম নতুন শনখোলা ও ঘিলাতলি পাড়া এলাকায় সেনাবাহিনী কর্তৃক জুম্মদের জায়গায় সীমান্ত সড়ক নির্মাণ ও সেনা ক্যাম্প স্থাপনের নামে ভুমি বেদখলের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে পানছড়ি এলকাবাসী। উক্ত সড়কটি দক্ষিণে মাটিরাঙ্গার তানাক্কা পাড়া এবং উত্তরে দীঘিনালা-সাজেকে সংযুক্ত করা হবে বলে জানা যায়। সড়কটি নির্মাণের ফলে সড়কের আশেপাশে অনেকজন জুম্ম গ্রামবাসীর বাগান-বাগিচা, ফসল, ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হবার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। এতে স্থানীয় জনগণ ব্যাপক ক্ষতির শিকার হবেন।
২৯ মে ২০২২ পানছড়ি উপজেলার ২নং চেংঙ্গী ইউনিয়ন এলাকায় উক্ত সীমান্ত সড়ক নির্মাণ ও ক্যাম্প স্থাপনের নামে ভূমি বেদখলের প্রতিবাদে এই মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। পানছড়ি উপজেলার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও হেডম্যান-কার্বারীরা এক বিবৃতিতে মাটিরাঙ্গা-পানছড়ি-দীঘিনালা সীমান্ত সড়ক নির্মাণ ও পানছড়ির শনখোলা পাড়ায় সেনাবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপনের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। ৩০ মে ২০২২ প্রদত্ত এক যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে ১৮৪ জন বর্তমান ও সাবেক জনপ্রতিনিধি, হেডম্যান ও কার্বারী এই দাবির কথা জানান।
(চলবে…)
*জুম্ম বার্তা: জনসংহতি সমিতির অনিয়মিত মুখপত্র