অশোক কুমার চাকমা
সংশ্লিষ্ট গ্রামবাসীরা কী হারিয়েছে আর কী পেয়েছে?
আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি, দেড় বছর পরে ছুটিতে গ্রামে গিয়েছি। গ্রামে গবেষক হিসেবে যাইনি। চলতি পথে যা দেখেছি এবং গ্রামবাসীদের সাথে কথা বলে যা জানতে পেরেছি সে আলোকে তাদের পাওয়া না পাওয়ার কথা এখানে খুব সাধারণভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
আমার মোটর সাইকেলের মাইলেজ হিসেব করে দেখেছি, লোগাং উচ্চ বিদ্যালয় থেকে আমার গ্রামের বাড়ী পর্যন্ত মোট ৫ কি.মি.র মত সড়ক কাটা হয়েছে। রাস্তার প্রস্থ কম করে হলেও ৩৫ ফুট হবে। চলতি পথে ঘর উচ্ছেদ করা হয়েছে কি না দেখিনি, তবে কিছু ঘর ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। কারণ, ঘর ঘেঁষে সড়কের জন্য মাটি কেটে নেওয়া হয়েছে। অনেক বাড়ীর উঠোন কেটে নেওয়া হয়েছে। সড়কের দুই পাড়ে আম, কাঁঠালসহ যেসব ফলজ গাছ ছিলো সেগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। ধানি জমির উপর দিয়ে সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। সড়ক নির্মাণ মানে অনিবার্যভাবে পাহাড় কাটা, এবং সেটা হয়েছে।
আমার গ্রাম ঘিলাতুলিতেও একই অবস্থা। খোদ আমাদের বাড়ীর উঠোন কেটে নিয়েছে। আমার মেঝো ভাইয়ের বসত বাড়ী এখন হুমকির মুখে। রাস্তা থেকে ঘরের দূরত্ব ৫ ফুটও নেই। বর্ষাকালে অতিবৃষ্টি হলে ভূমি ধ্বস হওয়ার আশংকা রয়েছে। ধারণ দেওয়াল দেওয়া না হলে ঘরটাও ভেঙে পড়তে পারে। মেঝো ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সে কেন দায়িত্বরত অফিসারকে বলেনি – রাস্তাটা ঘর থেকে আরো একটু দূরে সরিয়ে নিতে? আরো ৫-৭ ফুট সরিয়ে নিলেই তো ঘরটা আরো নিরাপদে থাকতো? সে জবাবে বললো, অবশ্যই দায়িত্বরত এক সেনাকে অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তিনি কোন কথা শুনেননি। যে বুলডোজার চালায়, সেই ড্রাইভার ঐ সেনার চেয়ে আরো এক ধাপ উপরে। তাকেও যখন বুলডোজার চালাতে মানা করা হচ্ছিলো, সে নাকি বলেছে, “রাস্তার জন্য যা করার তা করবো। দেশ আমার, মাটি আমার।” মেঝো ভাইয়ের কথা শুনে বুঝলাম, সে হয়তো ভাঙা ভাঙা বাংলায় কথা বলেছিলো। প্রমিত বাংলায় কথা বলতে না পারলে তো অশিক্ষিত হিসেবে গণ্য হবে। অশিক্ষিত মানুষের অনুরোধ তাদের কানে ঢুকেনি। ফলে দেশটাও “আমাদের” হয়নি। সেই “আমার দেশ’-এর বয়ানে গেঁয়ো অশিক্ষিত ‘উপজাতি’র অনুরোধ বা কাকুতি মিনতির খুব একটা মূল্য নেই।
আমাদের লিচু, কাঁঠাল, আম ও কাঠদায়ী গাছ কাটা পড়েছে। দাদুর লাগানো বটগাছের কথা গত লেখায় লিখেছি। দাদুর পবিত্র বিশ্বাসের সাথে জড়িত সেই বটগাছটাও গেছে। শুধু আমাদের নয়, গ্রামের অনেক পরিবারের ফলজ গাছ ও ক্ষেত কেটে ফেলা হয়েছে। আমার কাকা, তিনি গ্রামের কার্বারী। কার্বারী হিসেবে তিনি তার ঘরের উঠোনটাও রক্ষা করতে পারেননি। অথচ গ্রামে একটা পরিবারের জন্য উঠোন কত জরুরী সেটা বলে শহুরে মানুষদের বোঝানো কঠিন। উঠোন ধান শুকোতে লাগে, বিয়ে বা সামাজিক কোন অনুষ্ঠান করতে গ্রামের লোকজনকে দাওয়াত খাওয়াতে উঠোন লাগে। এখন তাঁর ঘরে উঠোন নেই। কার্বারীর ঘরটাই এখন শ্রীহীন।
গ্রামের উত্তরে সীমান্ত সড়ক। পূর্ব-পশ্চিম বরাবর কাটা হচ্ছে। গ্রামবাসীরা শুনেছে, ঐ সীমান্ত সড়কটা পশ্চিমে রামগড় থেকে ভারতের সীমান্ত বরাবর পূর্বে সাজেক পর্যন্ত সংযুক্ত করা হবে। এই সড়কের কাজ করতে গিয়ে অনেকের ধানি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই ধানি জমিগুলোকে সাধারণত চাকমা ভাষায় ‘ঘোনা ভুই’ (দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী ধানি জমি) বলা হয়। সড়ক নির্মাণ করতে গিয়ে অনেক পাহাড় কেটে ফেলা হয়েছে। ঘোনা জমিতে মাটি পড়ে জলাবদ্ধতা তৈরী হয়েছে। কোথাও কোথাও ঘোনা জমির উপর দিয়ে সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে অনেক পরিবার ঘোনা জমিতে আর চাষ করতে পারবে না। জলাবদ্ধতা আর বাঁধের নিম্ন অঞ্চলে মাটির আস্তর বেড়ে যাওয়ার কারণে অনেক ঘোনা জমি চাষের অযোগ্য হয়ে উঠবে।
গ্রামের একজন সমবায়ের মত একটা সমিতি করে আম, পেয়ারা ও বড়ই বাগান করেছিলেন। সেই বাগান দখল করে বিজিবি ক্যাম্প তৈরী করা হয়েছে। ঐ বিজিবি ক্যাম্পে পানি সরবরাহের জন্য একজনের ঘোনা জমিতে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এরকম আরো অনেক পরিবার আছে, যারা ঐ সড়ক প্রকল্পের কারণে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জরিপ করলে সে হিসেব পাওয়া যাবে।
গ্রামবাসীদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, ঘরবাড়ী, ফলজ গাছ, ধানি জমি ও বাগানের ক্ষয় ক্ষতির জন্য কোন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে কী না? সে ব্যাপারে প্রকল্প কর্মকর্তা কিছু বলেছিলেন কী না?
তারা জানিয়েছে, কার কয়টা গাছের ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে সে ব্যাপারে একটা তালিকা করা হয়েছিলো। তাদেরকে নাকি মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে, ভবিষ্যতে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। কিন্তু কী দেওয়া হবে এবং কখন দেওয়া হবে, সে ব্যাপারে তারা কিছুই জানে না। কেউ কেউ এও বলেছেন, দায়িত্বরত প্রকল্প কর্মকর্তা নাকি আশ্বাস দিয়েছিলেন ভবিষ্যতে গ্রামের জন্য স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র বা কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণের জন্য সহায়তা দেওয়া হবে।
এদিকে যার জমি দখল করে বাঁধ দেওয়া হয়েছে তিনি সংশ্লিষ্ট ক্যাম্প কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন যাতে তাকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। ধানি জমি দখল করে নেওয়ার কারণে তিনি খাদ্য উৎপাদন করতে পারবেন না। সে কারণে তিনি ক্ষতিপূরণ পাওয়ার চেষ্টা করছেন।
গ্রামবাসীরা আরো একটা তথ্য দিলো, যাদের ফলজ গাছের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিলো, তাদেরকে দায়িত্বরত সেনাসদস্যরা কিছু টাকা দিয়েছিলেন। তারা নাকি বলেছিলেন, ঐ টাকাটা ক্ষতিপূরণের টাকা হিসেবে নয়, সরকার খুশি হয়ে ‘মাছ মাংস’ কিনে খাওয়ার জন্য দিচ্ছে। গ্রামবাসীরা নিতে চায়নি। এদিকে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতারাও নাকি ঐ টাকা গ্রহণ করতে গ্রামবাসীদের কড়াকড়িভাবে নিষেধ করেছিলেন। অন্যদিকে প্রকল্পে দায়িত্বরত সেনা সদস্যরাও চাপ দিচ্ছিলো টাকাটা গ্রহণ করতে। একদিকে সেনা সদস্য আর অন্যদিকে ‘বাবুরা’ – উভয়ের চাপে পড়ে গ্রামবাসীরা কী করবে বুঝতে পারছিলো না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেনা সদস্যরা বাড়ী বাড়ী গিয়ে তালিকাভুক্ত পরিবার প্রধানদের হাতে টাকা ধরিয়ে দিয়েছিলো। টাকা দিয়ে ছবি তুলেছিলো। কেউ কেউ ২,০০০ টাকা, কেউ কেউ ২,৫০০ টাকা আর কেউ কেউ নাকি ৩,০০০ টাকা পেয়েছিলো। গ্রামবাসীরা জানালো, তারা বুঝতে পারলো না – ঐ টাকা গাছ-গাছালির ক্ষতিপূরণের দাম নাকি সরকারের খুশিতে মাছ-মাংস কিনে খাওয়ার টাকা?
গ্রামবাসীদের এসব কথা শুনে মনে হচ্ছে, সহজ সরল এসব মানুষের জন্য কথা বলার মত কেউ নেই। কোন প্রতিষ্ঠানও নেই। তারা কী পেল আর কী পেল না, তারা তা জানে না, বুঝেও না। না জানার, বুঝতে না পারারই কথা। তারা কী করে জানবে সীমান্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের মত মেগা প্রকল্পে কী আছে, আর কী নেই!
এতক্ষণ সড়কের অনেক ‘মন্দ’র কথা বললাম। ‘ভালো’ কিছু আছে কি না জানতে চাইলাম। তারা বললো, যা হয়ে গেছে সেটা তো আর ফেরানোর সুযোগ নেই। ভালো হোক, আর মন্দ হোক – সেটা নিয়ে বাঁচতে হবে। একটা ‘ভালো’র কথা বললো, অনেক বড় রাস্তা হয়েছে। রাজধানী শহরের মত বড় রাস্তা হয়েছে। এখন সহজে বাজারে যাওয়া যায়। আগে বর্ষাকালে যাতায়াত করতে অসুবিধা হতো, এখন আর সেটা হবে না। সারা বছর যাতায়াতের কোন সমস্যা হবে না।
এর মধ্যে কেউ একজন রসিকতা করে বললো, “আগে তো টাউন এলাকার লোকজন আমাদের ইস্ (অবজ্ঞা) করতো সীমান্ত এলাকার মানুষ গেঁয়ো (‘হিলো ভিদিরে মানুষ’) বলে। এ এলাকায় বিয়ে দিতে চাইতো না। এখন বড় রাস্তা হওয়ার কারণে আমাদের ছেলেদের বিয়ের বাজারে দাম বেড়ে গেছে…।”
তার কথায় হাসতে হলো। ওরাও হাসলো। সহজ সরল মানুষগুলো কারোর বিরুদ্ধে অভিযোগও করলো না তাদের পাওয়া না পাওয়া নিয়ে। দু’বেলা দু’মুঠো ভাত ঠিকমত খেতে পেলেই তারা খুশি থাকে। সরকার খুশি হয়ে ‘মাছ-মাংস’ খাওয়ার টাকা দিয়েছে।
সরকার আরো খুশি হোক। সরকার খুশি হয়ে সড়ক এলাকায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে তাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করুক সেই প্রত্যাশা রাখি। মহা সড়ক সহজ সরল মানুষদের জীবন ব্যবস্থা নানা দিক থেকে প্রভাবিত করবে। তারা যাতে মন্দ দিকগুলো থেকে মুক্ত থাকতে পারে, সে ব্যাপারে সুরক্ষা দিতে, এবং যাতে তারা নিজেদের ভূমি থেকে আর যেন বিতাড়িত না হয় সেদিকেও সুনজর দিতে সরকার খুশি হয় সেটাই একান্তভাবে কাম্য। “দেশ আমার নয়, দেশ আমাদের হোক” – এই চেতনা প্রকল্প বাস্তবায়নের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা/কর্মচারীদের মধ্যেও জাগ্রত হোক।
দেশ যদি আমাদের হয়, তবেই আমরা এগিয়ে যেতে পারবো, নচেৎ নয়। এই চেতনা জাতীয় পর্যায়ে গৃহীত যে কোন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নেও যাতে প্রতিফলিত হয়, সে কামনা করি।
৪. উন্নয়নের আগ্রাসন কী?
শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বে আদিবাসী প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এলাকায় বসবাস করে। যেখানে বন আছে, সেখানে আদিবাসীদের বসবাস। পুঁজিবাদ ও ভোগবাদের বিশ্বে এখন পূঁজিবাদী ও ভোগবাদী মানুষদের দৃষ্টি হলো আদিবাসীদের এলাকাগুলোর উপর। বনজ সম্পদ ও খনিজ সম্পদ আহরণের জন্য রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের সহায়তায় বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানী আদিবাসীদের এলাকায় গিয়ে প্রবেশ করে। তাদের মুখের বুলি হলো “আধুনিকীকরণ ও জাতীয় উন্নয়ন”। আধুনিক উন্নয়নের নামে বড় বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এরকম বড় বড় প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে খনিজ সম্পদ উত্তোলন, কাঠ ও বাঁশ আহরণ, রাবার ও পাম প্লানটেশন এবং বড় বড় সড়ক ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প। আদিবাসীদের ভূখন্ডে এ ধরনের বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট আদিবাসীদের সাথে কোন আলাপ-আলোচনা করা হয় না। উন্নয়নে আদিবাসীদের অংশ না থাকায় এরকম বড় বড় প্রকল্পের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী আদিবাসীরা নিজেদের আবাসভূমি থেকে প্রতিনিয়ত উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিবাদ করলে তারা হত্যা, গুম ও খুনের শিকার হয়। কৃত্রিম গোষ্ঠীগত সংঘাত ও বিভাজন তৈরী করে দেওয়া হয়। বড় বড় প্রকল্পের কারণে তারা নিজেদের প্রথাগত ভূমির অধিকার হারায়, জীবিকার উৎস হারিয়ে ফেলে। প্রথাগত ভূমি অধিকার হারানোর সাথে সাথে তাদের স্বকীয় সাংস্কৃতিক পরিচয়ও হারিয়ে ফেলে।
খুব সহজ কথায়, আদিবাসীদের স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতি (Free Prior Informed Consent-FPIC) ছাড়া বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে যদি আদিবাসীদের মৌলিক মানবাধিকার হরণ করে নেওয়া হয়, সেটাকে আদিবাসী স্কলাররা উন্নয়নের আগ্রাসন (Aggression of development) হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। আদিবাসীদের এলাকায় বাস্তবায়িত কোন উন্নয়ন প্রকল্প যদি আদিবাসীদের মানবাধিকারকে খর্ব করে তাহলে সেটাকে আগ্রাসন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। স্মর্তব্য, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে ‘উন্নয়নের অধিকারকে অবিচ্ছেদ্য মানবাধিকার হিসেবে’ স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এই উন্নয়ন অধিকারের বলে প্রত্যেক মানুষ এবং প্রত্যেক জাতি অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নে অংশগ্রহণ করার, অবদান রাখার এবং ভোগ করার অধিকার রাখে এবং তাদের সব মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা সুরক্ষিত থাকবে (UN Declaration on the Right to Development, 1986)।
এদিকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদে অনেক অধিকারের স্বীকৃতি রয়েছে। আন্তর্জাতিক আদিবাসী অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, কোন উন্নয়ন কর্মসূচির ফলে যদি আদিবাসীদের ভূমি, ভূখন্ড ও সম্পদ হারানোর আশংকা থাকে, তাহলে রাষ্ট্রকে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে [অনুচ্ছেদ ৮ (২খ)]। আদিবাসীদের স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতি (Free Prior Informed Consent-FPIC) ছাড়া আদিবাসীদের নিজেদের ভূমি বা ভূখন্ড থেকে স্থানান্তর করা যাবে না। যদি কোন কারণেও করতে হয়, তাহলে তাদের সাথে আলোচনা করে ন্যায় ও ন্যায্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে, এবং যেখানে সম্ভব ভূমির বদলে ভূমি ফেরত দিতে হবে (অনুচ্ছেদ ১০)। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেন, এ আন্তর্জাতিক আইন বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। কিন্তু তাদের মনে রাখতে হবে, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিভিন্ন সনদগুলো বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের সম্মতিতে গৃহীত আইন। অর্থাৎ সেগুলো হলো বৈশ্বিক সাংবিধানিক ব্যবস্থা (Global constitutionalism), সেগুলো প্রত্যেক রাষ্ট্রকে মানতে হবে। বাংলাদেশ সরকারও আন্তর্জাতিক আদিবাসী অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র ২০০৭ অনুসমর্থনের অঙ্গীকার করেছে (৮ম পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনা, পৃষ্ঠা: ৭৭৪)। কাজেই বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে মানুষের এই মৌলিক অধিকারগুলোকে অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। উন্নয়ন অনুশীলনে তা সম্মান করা না হলে সেটা অবশ্যই আগ্রাসন, যার মাধ্যমে মৌলিক মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ হয়।
বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যাপারে পাহাড়ের আদিবাসীদের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। তাদের মৌলিক অধিকার নানাভাবে লংঘিত হয়েছে। এর জ্বলন্ত উদাহরণ হলো ‘‘আধুনিকতা (modernization) ও জাতীয় উন্নয়নের’ নামে ’৬০ দশকে বাস্তবায়িত বহুমুখী কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ প্রকল্প। এই প্রকল্পের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করা হয়েছিলো। সেই মেগা প্রকল্পের কুপ্রভাব এখনো বিদ্যমান রয়েছে। এরপর ’৭০ দশকের শেষ দিক হতে জুমিয়াদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে বাস্তবায়ন করা হয়েছিলো রাবার প্লানটেশন ও বড় বড় সড়ক নির্মাণ প্রকল্প। অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে উক্ত প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও পাহাড়ি আদিবাসীদের প্রথাগত ভূমি অধিকার ও জীবিকা নানাভাবে খর্ব হয়েছে। স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয়ও ক্ষুণ্ণ হয়েছে। উক্ত প্রকল্পগুলো উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
একবিংশ শতাব্দীতে এসে অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা ও অনুশীলনে নতুন নতুন ধারণা এসেছে। উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়ার (top-down approach) পরিবর্তে নীচ থেকে জনগোষ্ঠীর চাহিদাগুলো (bottom up approach) বিবেচনায় নিয়ে অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিতে উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়ার রীতি চলে এসেছে। আধুনিক গণতান্ত্রিক ও জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে এ ধরনের রীতি ও পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগে পরিবেশগত প্রভাব (Environmental Impact Assessment – EIA) ও সামাজিক প্রভাব (Social Impact Assessment – SIA) নিরূপণ করা হয়ে থাকে। ক্ষতিকর প্রভাব চিহ্নিত হলে ক্ষতি কমানোর জন্য প্রকল্পে প্রতিকারের ব্যবস্থা থাকে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বিশেষত আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী এলাকায় বড় বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হলে আদিবাসীদের জন্য বিশেষ সুরক্ষার (Indigenous Peoples Safeguards) ব্যবস্থা থাকে। এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক ও এশিয় উন্নয়ন ব্যাংকের কথা উল্লেখ করা যায়। পৃথিবীর কোন রাষ্ট্র যদি এসব আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা নিয়ে আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় কোন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায়, তাহলে সে রাষ্ট্রকে আবশ্যিকভাবে আদিবাসী সুরক্ষা নীতি মেনে চলে পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব যাচাই করতে হবে। আদিবাসীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকলে তাদের জন্য বিশেষ উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এটা এখন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অনুশীলনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এখন উপরে উল্লেখিত বিষয় বা মানদন্ডের আলোকে, আমরা প্রশ্ন করতে পারি পার্বত্য অঞ্চলের সীমান্ত সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগে কী পরিবেশগত প্রভাব (Environmental Impact Assessment – EIA) ও সামাজিক প্রভাব (Social Impact Assessment – SIA) নিরূপণ করা হয়েছিলো? কে বা কোন প্রতিষ্ঠান করেছিলো? সেই প্রক্রিয়ায় কী সংশ্লিষ্ট আদিবাসী জনগোষ্ঠী, প্রথাগত প্রতিষ্ঠান ও পার্বত্য অঞ্চলের উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানসমূহের অংশগ্রহণ ছিলো? এ সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নকালে দেশের আইন, নীতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য আইন ও নিয়ম নীতি অনুসরণ করা হয়েছে?
(চলবে…)
লেখক পরিচিতি: উন্নয়নকর্মী। লেখাটি তাঁর ফেসবুক টাইমলাইন থেকে নেওয়া।