হিল ভয়েস, ৩১ মার্চ ২০২০, বান্দরবান: বিশ্বব্যাপী মহামারী করোনার ভয়াবহতার আভাস পৌঁছেছে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের বান্দরবান পার্বত্য জেলার প্রত্যন্ত আদিবাসী ম্রো জাতিগোষ্ঠীর গ্রামেও। দেশের সরকার এখনও লকডাউন জারি না করলেও বান্দরবানের ম্রো সম্প্রদায় তাদের গ্রামে গ্রামে স্বউদ্যোগে সম্ভাব্য করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে লকডাউন চালু করেছে।
স্বেচ্ছায় তারা নিজেদের এলাকার প্রাকৃতিক বন থেকে বাঁশ ও গাছ সংগ্রহ করে তা দিয়ে বেড়া বা দেয়াল তৈরি করে গ্রামে প্রবেশের সকল পথ বন্ধ করে দিয়েছে। যাতে বহিরাগত কেউ গ্রামে প্রবেশ করতে না পারে। মূলত বিভিন্ন সময় মহামারী রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে গ্রামে তা প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণের জন্য এই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়ে থাকে। যুগ যুগ ধরে মহামারী পরিস্থিতিতে ম্রোদের সমাজে প্রচলিত গ্রামের প্রবেশ পথ বন্ধ বা লকডাউনকে তারা বলে থাকেন ‘খাসুর’। যতক্ষণ পর্যন্ত না মহামারীর প্রকোপ দূর হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা এই প্রথা চালু রাখেন এবং তা মেনে চলেন।
অনুন্নত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ব্যাপক পশ্চাদপদতা, আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ও গণমাধ্যমের সুবিধার অভাব এবং নানা আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক দূরবস্থার মধ্যে থেকেও করোনা মোকাবেলায় ম্রো সম্প্রদায়ের এই ব্যবস্থা বিভিন্ন মহলের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। সারাদেশে যখন সরকার ও প্রশাসনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বন্ধ ও ছুটি ঘোষণা, চলাচলে নিষেধাজ্ঞা ও হোম কোয়ারেন্টিনসহ নানা নির্দেশনা ও প্রচারণা সত্ত্বেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের অসচেতনতা বা নিয়মভঙ্গের কারণে করোনা বিস্তার রোধ নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগ দেখা দিয়েছে, এমন সময় ম্রোদের এই উদ্যোগ সকলের জন্য এক অনুপ্রেরণা ও শিক্ষার দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক ও বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের বদৌলতে এই আদিবাসী অনন্য সামাজিক ব্যবস্থা যেন নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছে।
জানা গেছে, করোনাভাইরাস ও হাম প্রতিরোধে বান্দরবান জেলার ম্রো অধ্যুষিত অধিকাংশ গ্রামে এই লকডাউন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বান্দরবান জেলার সদর উপজেলার চিম্বুক পাহাড়ের পূর্ব ও পশ্চিম অংশে অবস্থিত ২০টি পাড়া, পূর্বদিকের ৩০টি পাড়া, টংকাবতী ইউনিয়নের ১৭টি পাড়া এবং আলীকদম, রুমা ও লামা উপজেলার বিভিন্ন এলাকার অধিকাংশ পাড়া প্রথাগত উপায়ে লকডাউন ঘোষণা করেছেন আদিবাসী ম্রো গ্রামবাসী। সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন সংস্থা থেকে কোন ত্রাণ বা সাহায্য সামগ্রী দিতে গেলে সেগুলি সেই লকডাউন বা বন্ধ দরজার বাইরে রেখে যেতে অনুরোধ করা হচ্ছে। আপদকালীন সময়ে গ্রামের কারও কোন আত্মীয় বা অতিথি সেখানে আসলে তার থাকার ব্যবস্থা হিসেবে দরজার বাইরে একটি বাড়িও নির্মাণ করা হয়ে থাকে।
শুধু তাই নয়, গ্রামের অধিকাংশ বাংলা ভাষা না জানা জনগণের মাঝে ম্রো ভাষায় করোনা ভাইরাস বিষয়ে সচেতনতামূলক লিফলেট ছাপিয়ে প্রচার করা হচ্ছে। প্রতিটি গ্রামের বন্ধ দরজার সম্মুখে বিভিন্ন নির্দেশনা সম্বলিত লিখিত বিজ্ঞপ্তি টাঙানো হয়েছে। যুগ যুগ ধরে প্রচলিত আদিবাসী ম্রোদের এই ব্যবস্থাকে অনেকেই ‘অনন্য’ বলে অভিহিত করছেন।
বলাবাহুল্য, পার্বত্য চট্টগ্রামের চৌদ্দটি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অন্যতম এই ম্রোরাও এই অঞ্চলের পশ্চাদপদ এক সম্প্রদায়। নানাভাবে তারা অবহেলা, বঞ্চনা ও নিপীড়নের শিকার হয়ে আসছেন। সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন উন্নয়ন আগ্রাসনের কারণে কখনো স্বভূমি থেকে উচ্ছেদের শিকার হচ্ছেন, কখনো উচ্ছেদ আতঙ্কে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন।
সম্প্রতি মার্চ মাসে রাঙ্গামাটির সাজেক ও খাগড়াছড়ির মেরুংয়ের প্রত্যন্ত গ্রামে তিন শতাধিক ত্রিপুরা শিশু ও গ্রামবাসীর হামে আক্রান্ত এবং ৮ শিশুর মৃত্যুবরণের মতো একই সময়ে বান্দরবানের লামা উপজেলার ম্রো জনগোষ্ঠী অধুষিত লাল্যাপাড়া গ্রামেও এই হামের প্রাদুর্ভাবে ৪ মাস বয়সী এক ম্রো শিশু মারা যায় এবং প্রায় ৪২ জন অসুস্থ হয়ে পড়েন, যাদের মধ্যে অন্তত ৩৩ জনই শিশু রয়েছে। অন্যদিকে মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে বান্দরবানের রুমা উপজেলার সদর, গালেঙ্গ্যা ও তিন্দু ইউনিয়ন এবং বান্দরবান সদর উপজেলার সদর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে হামে আক্রান্ত হয়ে আরো ৬ ম্রো শিশুর রুমা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
এছাড়া ম্রো অধ্যুষিত বিভিন্ন এলাকায় ঝিরি, ঝর্ণা ও খাল থেকে বিভিন্ন বহিরাগত ব্যবসায়ী কর্তৃক অবাধে পাথর উত্তোলনের ফলে ম্রোরা মারাত্মক পানীয় সংকটেরও সম্মুখীন হচ্ছেন এবং তাদের এলাকায় প্রাকৃতিক জলাধার, জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ব্যাপক হুমকির মুখে পড়েছে তারা অভিযোগ করে আসছেন। বহিরাগত কিছু ব্যবসায়ী ও তাদের স্থানীয় এজেন্টদের পাথর ব্যবসা এবং অপরদিকে স্থানীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত সড়ক নির্মাণ প্রকল্প এই পাথর উত্তোলনের জন্য দায়ী বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অপরদিকে বিভিন্ন প্রভাবশালী সংস্থা ও মহলের পর্যটন স্থাপন, বহিরাগত কোম্পানী ও ভূমিদস্যুদের কর্তৃক জোরপূর্বক উচ্ছেদ, ভূমি বেদখল, ভূমি ও সম্পদ ধ্বংস করার ফলে অনেক ম্রো আদিবাসীর জীবন-জীবিকা বিপন্ন হয়ে পড়েছে।