হিল ভয়েস, ১৪ মার্চ ২০২৩, বান্দরবান: ইসলামী জঙ্গী ও জঙ্গীদের প্রশ্রয় প্রদানকারী বমপার্টি সন্ত্রাসীদের খোঁজার দোহাই দিয়ে বান্দরবান জেলার রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলায় সেনাবাহিনী আবারো কম্বিং অপারেশন শুরু করেছে। এতে এলাকায় জনমনে ব্যাপক আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে যে, গতকাল সোমবার (১৩ মার্চ) বিকাল থেকে সেনা অপারেশন শুরু হয়েছে। এই লক্ষ্যে থানচি উপজেলার সীমান্ত সড়ক সংলগ্ন এলাকা ও রুমা উপজেলার রেমাক্রি প্রাংসা ইউনিয়নেরর বম পাড়াগুলোতে সেনাবাহিনীর আলিকদম সেনাজোনের ৩১ বীর এবং বিজিবি বলিপাড়া জোনের ৩৮ ব্যাটেলিয়ন, রুমা উপজেলার পাইন্দু ইউনিয়ন ও এর তৎসংলগ্ন এলাকার বম পাড়াগুলোতে রুমা সেনাজোনের ২৮ বীর এবং রোয়াংছড়ি এলাকার বম পাড়াগুলোতে বান্দরবান সদর জোনের ৫ ইবিআর-কে মোতায়েন করা হচ্ছে।
এর আগে ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথবাহিনী রেইংক্ষ্যং ভ্যালীর অন্তর্গত বান্দরবানের রুমা ও রোয়াংছড়ি এবং রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি উপজেলায় ইসলামী জঙ্গী ও জঙ্গী আশ্রয়দাতাদের বিরুদ্ধে বান্দরবানে কম্বিং অপারেশন শুরু করেছিল। কিন্তু উক্ত অপারেশনে সেনাবাহিনী এসব এলাকা থেকে কোনো ইসলামী জঙ্গী সদস্য কিংবা বমপার্টি সন্ত্রাসী আটক করতে ব্যর্থ হয়। বরঞ্চ এতে তিন উপজেলার নিরীহ সাধারণ গ্রামবাসীর উপর নানা হয়রানি ও দূর্ভোগ নেমে আসে।
অপারেশন চলাকালে ১৫ অক্টোবর ২০২২ সালে রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার বড়থলি ইউনিয়নের সাইজাম পাড়া থেকে ৬ জন তঞ্চঙ্গ্যা গ্রামবাসী বমপার্টি ও ইসলামী জঙ্গীদের কর্তৃক অপহরণ এবং তাদের মধ্যে একজন হত্যার শিকার হয়।
এমনকি কম্বিং অপারেশন চলাকালে ১২ অক্টোবর ২০২২ বমপার্টি সশস্ত্র সন্ত্রাসী ও ইসলামী জঙ্গীরা বিলাইছড়ির বড়থলি ইউনিয়নের সাইজাম পাড়ায় সেনাবাহিনীর উপর সশস্ত্র হামলা করলে সেনাবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি ও অস্ত্র-গোলাবারূদ হারানোর খবর পাওয়া গিয়েছিল।
অপারেশনের ১৯ দিনের মাথায় ২১ অক্টোবর ২০২২ র্যাব এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রচার করেছিল যে, অপারেশনে বমপার্টির আস্তানা থেকে ৭ জন ইসলামী জঙ্গী ও ৩ জন বমপার্টি সশস্ত্র সন্ত্রাসীকে আটক করেছিল। বমপার্টির তিনজন সদস্যকে আটকের যে দাবি করা হয়েছিল, তার সত্যতা মেলেনি। তারা সরাসরি বমপার্টির সশস্ত্র সদস্য ছিল বলেও সত্যতা মেলেনি। তবে তারা কেএনএফের স্থানীয় ডিভিশন কমিটির সাথে যুক্ত ছিল এবং তাদেরকে রুমা বাজার ও বিভিন্ন সড়ক থেকে আটক করা হয়েছিল বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
এমনকি আটককৃত ৭ জন ইসলামী জঙ্গীদেরকেও বিভিন্ন জায়গা থেকে অপারেশন চলাকালে আটক করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
সর্বশেষ গত ১২ মার্চ ২০২৩ বান্দরবানের টংকাবতী থেকে ৯ জন ইসলামীজঙ্গীকে গ্রেপ্তার করেছে বলে র্যাব যে দাবি করছে, তারও এখনো সত্যতা মেলেনি। সেদিন বা তার আগে টংকাবতীর কোনো এলাকায় রাবের অভিযান পরিচালনা হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানতে পারেনি। আটককৃত ইসলামী জঙ্গীদেরকে অন্য কোনো স্থানে গ্রেফতার করে টংকাবতী এলাকা থেকে আটক করা হয়েছে মর্মে র্যাব দাবি করছে বলে প্রতীয়মান হয়।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ হলরুমে র্যাবের এক সংবাদ সম্মেলনে রেমাক্রী প্রাংসা ইউনিয়নের দুর্গম রেমাক্রী ব্রিজ এলাকায় র্যাবের সঙ্গে নব্য ইসলামী জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারকিয়া ও বমপাপাটি সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। গোলাগুলির সময় ঘটনাস্থল থেকে ১৭ ইসলামী জঙ্গি ও ৩ জন কেএনএফ সদস্যকে আটকের দাবিও সম্পূর্ণ ভূয়া বলে ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে।
মূলত আন্তর্জাতিক জনমতকে বিভ্রান্ত করার হীনলক্ষ্যে বমপার্টির ক্যাম্পে আশ্রিত ইসলামী জঙ্গীদের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানের সফলতা দেখাতে র্যাব এধরনের একের পর এক ভুয়া আটকের ঘটনা প্রচার করছে বলে প্রতীয়মান হয়।
তবে যেসব ইসলামী জঙ্গীদেরকে র্যাব সিটিটিসি (কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট) কর্তৃক অন্য জায়গা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে তারা অধিকাংশই কেএনএফ ক্যাম্প থেকে পালানো জঙ্গী সদস্য বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। পালিয়ে যাওয়া সেসব জঙ্গীদেরকে র্যাব ও সিটিটিসি বিভিন্ন জায়গা থেকে গ্রেফতার করে বমপার্টি ক্যাম্প থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে দেখানো হচ্ছে।
আরো উল্লেখ্য যে, প্রথমত দেশে-বিদেশে প্রবল জনমতের চাপে পড়ে বমপার্টি সন্ত্রাসীরা তাদের ক্যাম্পে আশ্রিত ও সামরিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ইসলামী জঙ্গীদেরকে নিরাপদ প্যাসেজ দিয়ে ক্যাম্প থেকে অন্যত্র পাঠিয়ে দিচ্ছে। দ্বিতীয়ত আরেকটা অন্যতম উদ্দেশ্য হলো দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে অর্থ সংগ্রহ করে পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য তারা যাতে বমপার্টিকে আরো অর্থ প্রেরণ করতে পারে।
সূত্র আরো জানিয়েছে যে, রুমার সিলৌপি পাড়া সংলগ্ন বমপার্টির ক্যাম্পে এখনো ‘জামায়াতুল আনসার হিল ফিন্দাল শারক্বীয়া’র নেতৃবৃন্দসহ ডজন খানেক সদস্য অবস্থান করছে। বমপার্টি এখনো ইসলামী জঙ্গীদের আশ্রয় ও সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদানের কার্যক্রম থেকে সরে আসেনি।
বস্তুত ইসলামী জঙ্গী ও জঙ্গীদের প্রশ্রয় প্রদানকারী বমপার্টি সন্ত্রাসীদের খোঁজার নামে অপারেশন শুরু নিরীহ সাধারণ গ্রামবাসীদের হয়রানির শিকার হতে হয় বলে স্থানীয় অনেক গ্রামবাসী অভিমত জানিয়েছেন।
যেমন গত ১১ মার্চ ২০২৩ রেমাক্রি প্রাংসা ইউনিয়নের তামলৌ পাড়ার জৌনুন কুং বম নামে এক গর্ভবতী মহিলাকে হয়রানির অভিযোগ এসেছে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। হয়রানির শিকার উক্ত নারী থানচি থেকে ডাক্তার দেখিয়ে নিজ পাড়ায় ফিরছিলেন। এসময় সেনাবাহিনীর বাকতলাই ক্যাম্পে তাকে ডেকে নিয়ে তাকে মানসিকভাবে ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। এসময় সেনা সদস্যরা উক্ত নারীকে হুমকি দেয় যে, ‘তোমাদের পাড়ায় কেএনএফ সন্ত্রাসীরা ৩/৪ বার এসেছে। কিন্তু তোমাদের পাড়ার কেউই সেনাবাহিনীকে খবর দাওনি।’ বর্তমানে উক্ত নারীটি শারীরিক ও মানসিকভাবে ট্রমার শিকার হয়েছে বলে জানা গেছে।