হিল ভয়েস, ১২ মার্চ ২০২৩, বিশেষ প্রতিবেদক: পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সকল বিষয়সমূহ বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)। চুক্তির অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে অনতিবিলম্বে ভূমি কমিশনের বিধিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করা জরুরী বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
গত ৯ মার্চ ২০২৩ বৃহস্পতিবার পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় গ্র্যান্ড হোটেলে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির সপ্তম বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন সন্তু লারমা। ঢাকার বাইরে এই প্রথম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হলো। গত ৩ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ৬ষ্ঠ সভার সাড়ে তিন মাস পর কমিটির ৭ম সভা অনুষ্ঠিত হলো।
কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় কমিটির সদস্য পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) এবং কমিটির সদস্য ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থী প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন এবং অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণ ও পুনর্বাসন সম্পর্কিত টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপি, অংশগ্রহণ করেন।
এছাড়া সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর ঊশৈসিং এমপি, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সদস্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য গৌতম কুমার চাকমা, খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি দীপংকর তালুকদার এমপি, সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি বাসন্তী চাকমা, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য সচিব ও রাষ্ট্রদূত আবদুস সোবহান সিকদার, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মুসাম্মৎ হামিদা বেগমসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় বিগত ৬ষ্ঠ সভার কার্যবিরণী অনুমোদন, বিগত সভার সিদ্ধান্তাবলী পর্যালোচনা ও অগ্রগতি, পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক পরিস্থিতি এবং বিবিধ বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
আলোচিত বিষয়সমূহের মধ্যে অন্যতম হলো ভূমি কমিশনের বিধিমালা প্রণয়ন, নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে বিষয় বা কার্যাবলী হস্তান্তর, চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির ২৭ জনবল বিশিষ্ট অর্গানোগ্রাম কার্যকরকরণ, জনসংহতি সমিতির সদস্য ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার, তিন পার্বত্য জেলার আইন-শৃঙ্খলা, শিক্ষক নিয়োগ কমিটিতে জেলা প্রশাসকদের প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্তির জন্য পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের বিধি-বহির্ভূত নির্দেশনা প্রত্যাহার, টাস্ক ফোর্স কর্তৃক প্রত্যাগত পাহাড়ি শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ ত্বরান্বিতকরণ ও টাস্কফোর্সের সদস্য-সচিবের দায়িত্ব চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনারের পরিবর্তে টাস্কফোসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট অর্পণ ইত্যাদি।
নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে বিষয়/কার্যাবলী হস্তান্তর প্রসঙ্গে আলোচনাকালে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মুসাম্মৎ হামিদা বেগম জানান যে, পুলিশ (স্থানীয়), ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ, বিআরটিএ ও জেলা সড়ক ইত্যাদি বিষয়/কার্যাবলী হস্তান্তরের জন্য পার্বত্য মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে ২৭ মার্চ ২০২১, ১লা নভেম্বর ২০২২ এবং ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তিনবার পত্র প্রেরণ করা হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে কোন প্রত্যুত্তর আসেনি বলে জানান পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের সচিব। ফলে এ বিষয়ে তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়।
উল্লেখ্য, দীর্ঘ ১৫ বছর আন্দোলনের পর গত ২০১৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের বিরোধাত্মক ধারা সংশোধন করা হয়। আইন সংশোধনের পর ভূমি কমিশনের বিধিমালার খসড়া তৈরি করে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের তরফ থেকে ০১ জানুয়ারি ২০১৭ ভূমি মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে। কিন্তু সরকার এখনো সেই বিধিমালা চূড়ান্ত করেনি। এর ফলে ভূমি কমিশনের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির বিচারিক কাজ এখনো শুরু করা যায়নি। এ প্রসঙ্গে ৭ম সভায় পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মুসাম্মৎ হামিদা বেগম জানান যে, সর্বশেষ গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তারিখে এক পত্র প্রেরণের মাধ্যমে তাগাদা দেয়া হলেও ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে কোন প্রত্যুত্তর আসেনি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত সভার কার্যবিবরণী পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটি এবং আঞ্চলিক পরিষদের নিকট প্রেরণের জন্য ৬ষ্ঠ সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও এ বিষয়ে তেমন অগ্রগতি লাভ করেনি। এ বিষয়ে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মুসাম্মৎ হামিদা বেগম জানান যে, এ বিষয়টি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য পার্বত্য মন্ত্রণালয় থেকে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তিন পার্বত্য জেলার জেলা প্রশাসকদেরকে পত্র দেয়া হয়েছে। কিন্তু এরপর কোন অগ্রগতি লাভ করেনি।
প্রত্যাহৃত সেনা ক্যাম্পের জায়গায় এপিবিএন ক্যাম্প স্থাপনের বিষয়টি ৫ম সভার কার্যবিবরণীতে সরকারের পক্ষ থেকে একতরফাভাবে লিপিবদ্ধ করা হলেও ৬ষ্ঠ সভায় উক্ত বিষয়টি অনুমোদন করা হয়নি। এ বিষয়ে পরবর্তীতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে আলোচনা করা যেতে পারে বলে ৬ষ্ঠ সভায় আলোচিত হয়। কিন্তু ৭ম সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনুপস্থিত থাকার কারণে এ বিষয়ে কোন আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়নি।
উল্লেখ্য যে, চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির একাধিক সভায় নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে ‘পুলিশ (স্থানীয়)’ ও ‘আইন-শৃঙ্খলা সংরক্ষণ ও উন্নয়ন’ বিষয় হস্তান্তর করা ও পার্বত্য জেলা পুলিশ বাহিনী গঠন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না করে ১৩ এপ্রিল ২০২২ এপিবিএন হেডকোয়ার্টার্স থেকে এক নির্দেশনার মাধ্যমে প্রত্যাহারকৃত সেনা ক্যাম্পের জায়গায় এপিবিএন ক্যাম্প স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সরাসরি বরখেলাপ।
আরো উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক পার্বত্যাঞ্চল থেকে সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের জন্য ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির অনেক সভায়। কিন্তু এখনো প্রায় চার শতাধিক অস্থায়ী ক্যাম্প পার্বত্য চট্টগ্রামে বলবৎ রয়েছে। উপরস্তু চুক্তি লঙ্ঘন করে সরকার প্রত্যাহৃত ক্যাম্পের জায়গায় এপিবিএন ক্যাম্প স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। অন্যদিকে ২০০১ সালে তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার কর্তৃক জারিকৃত ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামক সেনা শাসনের বদৌলতে সেনাবাহিনী সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, বিচার ব্যবস্থাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব করে চলেছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা হিসেবে কাজ করছে।